প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭
মায়ানমারে রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রীয় গণহত্যার শিকার। একটি দেশের শাসকগোষ্ঠী যখন সভ্যতার ন্যুনতম দাবী উপেক্ষা করে একটি সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীকে গণহত্যার মাধ্যমে নির্মূলের বর্বর নেশায় মেতে ওঠে; তখন প্রতিবেশী দেশগুলোর কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় গণহত্যা থেকে রক্ষা পেতে যারা উন্মূল শরণার্থী হয়েছে; তাদেরকে আশ্রয় দেয়া।
মায়ানমারের সাবেক সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করেছিলো। তাদের মিয়ানমারের সব নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত করে জীবন্মৃত করে রাখা হয়। এই তীব্র অনিশ্চয়তার মাঝে বেড়ে ওঠা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীটির কাছে সুস্থ মানসিক গড়ন প্রত্যাশা করা জীবন বাস্তবতা সম্পর্কে কোন ধারণা না থাকার সূচক। মায়ানমারের নাগরিক হিসেবে নিবন্ধনের সুযোগ বঞ্চিত হয়ে রোহিঙ্গারা দেশহীন হয়ে পড়ে। মায়ানমার সরকারের মানবতা বর্জিত শাসন-শোষণ-বঞ্চনার শেকলে বাঁধা পড়ে মানবেতর এক জীবনের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া একটি জনগোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা।
এদের মধ্যে যারা প্রথম দফায় মায়ানমারের শাসকের বিতাড়নের মুখে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়; শরণার্থী শিবিরে তাদের জীবন অনিশ্চয়তার দোলাচলে ম্রিয়মাণ। যখনই কোন জনগোষ্ঠী অনির্দিষ্টকালের জন্য শরণার্থী হয়; তাদের মানসিক অনিশ্চয়তার সুযোগ নিয়ে তাদের যে কোন অপরাধমূলক কাজে সম্পৃক্ত করা সহজ হয়। প্রথম দফায় সে সুযোগটি নিয়েছে বাংলাদেশের অপরাধীরা। এই দেশজ অপরাধচক্র তাদের যুক্ত করেছে সন্ত্রাস-মাদক ব্যবসা-বৌদ্ধপাড়ায় হামলাসহ নানা কাজে।
এরকম ঘটনা এই প্রথম নয়; আফগান যুদ্ধের মানবেতর পরিস্থিতিতে যে বিপুল সংখ্যক আফগান শরণার্থী পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে, পাকিস্তানের অপরাধচক্র তাদেরকেও জড়িয়েছে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। এ ছাড়া ইউরোপে যারা শরণার্থী হয়েছে সন্ত্রাসবাদী আই এস গোষ্ঠীর গণহত্যার প্রেক্ষাপটে; তাদেরকেও নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ফেলার চেষ্টা দৃশ্যমান। যে মানুষ তার বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়ে কচুরিপানার মত ভেসে বেড়াচ্ছে; সে এই দিকনির্দেশনাহীন জীবনে পেলব গোলাপ ফোটাবে; এমন চিন্তা শরণার্থীর বাস্তবতা বুঝতে না পারার বুদ্ধিহীনতা অথবা অস্ট্রিচের মতো বালিতে মুখ গুঁজে রাখা।
মায়ানমারের কথিত গণতন্ত্রের মানসকন্যা অন সান সুচি নিজে যখন সামরিকজান্তার কারাগারে বন্দী ছিলেন, তখন গোটাপৃথিবী সুচির প্রতি সমানুভূতি প্রকাশ করে তার মুক্তির দাবী তুলেছিলো। গণতন্ত্রের জন্য জীবন বাজি রেখে সংগ্রামশীলতার জন্য সুচি "শান্তিতে" নোবেল পুরস্কার পান। সেই সুচি সেই কথিত গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এসে মায়ানমারের অবরুদ্ধ রোহিঙ্গাদের ওপর শেষ আঘাত হানলেন। গণহত্যার রক্তে হাত ভেজালেন সুচি। এখন যে কোন বিশেষণ কিংবা পুরস্কার সুচি নামটির সঙ্গে বেমানান শোনায়।
এই যে মায়ানমার বিশ্বমানবতার সামনে ইতিহাসের বর্বর একটি গণহত্যা সংঘটিত করে চলেছে; এ ব্যাপারে মায়ানমারের প্রতিবেশী চীন-ভারত কিংবা বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্রকে নির্লিপ্ত থাকতে দেখা গেছে। এদের প্রত্যেকেরই মায়ানমার সরকারের গণহত্যার ব্যাপারে চোখ বুজে থাকার কারণ তাদের অমানবিক আত্মকেন্দ্রিকতা। রাষ্ট্র মায়ানমার তিনটি দেশকে বাণিজ্য-বাজার, গভীর সমুদ্র উপকূলসহ এর ভূ-রাজনৈতিক সুবিধার সবটুকু উজাড় করে দিতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গারা কিছুই দিতে পারেনা। সুতরাং রোহিঙ্গাদের প্রতি বিন্দুমাত্র মানবতা প্রকাশ করার প্রয়োজন অনুভব করেনি ঐ তিনটি দেশের স্বার্থপর পররাষ্ট্রনীতি।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আয়তনে ক্ষুদ্র-সীমিত সম্পদ-জনসংখ্যা বিস্ফোরণে ধস্ত একটি রাষ্ট্রের নেতা হয়েও আত্মকেন্দ্রিকতার পরিবর্তে মানবতার পথটি বেছে নিয়েছেন। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীদের নির্দেশ দিয়েছেন, "শরণার্থীদের প্রতি মানবিক হতে।" মানুষ মরছে যেখানে পাখির মতো সেখানে একজন বিবেকবান মানুষ আর চোখ বুজে থাকেন কীভাবে!
কিন্তু মানবতার লড়াইয়ে শেখ হাসিনা একা হয়ে গেছেন যেন। অল্পকিছু দেশের মৌখিক আশ্বাস ছাড়া শরণার্থীদের জীবন বাঁচাতে শেখ হাসিনা কোন সাহায্য পাননি কোন রাষ্ট্রের কাছ থেকে। এটা খুবই স্বাভাবিক। চীন যখন মায়ানমারে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য উন্মুখ, তখন চীনের অঙ্গুলি হেলনে কথিত মুসলমান রাষ্ট্র পাকিস্তান রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করতে রাজি নয়। ভারত মায়ানমারে ব্যবসায়িক আধিপত্যের খোঁজে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মৌনব্রতে। আর যুক্তরাষ্ট্র ভূ-কৌশলগত আধিপত্য বিস্তারের নেশায় বুঁদ অবস্থায় নানাসময়ে নানাদেশে মানবাধিকারের ব্যাপারে সবক দিয়ে বেড়ানোর অভ্যাসটা আপাতত রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে পকেটে পুরে রেখেছে। যে মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চলছে; সে মায়ানমারে ব্যবসার বাদামের ডালি নিয়ে ঘুরছে এইসব কথিত মোড়ল রাষ্ট্র।
বিশ্বমানবতার নেত্রী হিসেবে সবরকম ঝুঁকি উপেক্ষা করে জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যারকেল যেমন সিরিয়ার শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিলেন, শেখ হাসিনা একই মানবতার পথে হেঁটেছেন। কারণ মানুষের জীবন না বাঁচাতে পারলে কী হবে এইসব ভূ-রাজনীতি দিয়ে!
কিন্তু এতো বড় চ্যালেঞ্জ নেবার মত অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই। এখানে অন্যান্য দেশের সাহায্য লাগবেই। প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন অর্থসাহায্য। সে সাহায্য তুরস্ক-মালয়েশিয়াসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে সংগ্রহ করতে হবে। জাতিসংঘও নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবে মানবতার এ বিপর্যয়ে। প্রাথমিকভাবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জীবন বাঁচানোর দায়িত্বটি শেখ হাসিনা পালন করলেও রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য কূটনৈতিক তৎপরতার প্রয়োজন রয়েছে।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের বসবাস তাদের জীবনের অনিশ্চয়তার অবসানে মোটেই অনুকূল হবে না। এ হবে ঠেলে গুঁজে বেঁচে থাকা। যে দেশটি এমনিতেই অপরাধীতে ঠাসা সেখানে শরণার্থীর অনিশ্চিত জীবনের সুযোগ নিয়ে তাদের অপরাধের পথে ঠেলে দেবার সব রেসিপিই প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। ঠিক যেমনটা ঘটেছে অপরাধীতে ঠাসা পাকিস্তানে আফগান শরণার্থীদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করে।
তুরস্ক যেহেতু রোহিঙ্গাদের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে; তাদেরকেই যদি বোঝানো যায়, রোহিঙ্গাদের ধীরে ধীরে তুরস্কে নিয়ে গিয়ে পুনর্বাসিত করলে এই ভাগ্যহত মানুষগুলো দ্বিতীয় জন্মের স্বাদ পাবে; অন্যদিকে তুরস্ক রোহিঙ্গাদের শ্রম কাজে লাগিয়ে উপকৃত হবে।
তুরস্কের মানুষ জার্মানিতে গিয়ে শ্রম দিয়ে নিজেদের জীবন গড়েছিলো; সেইসঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভেঙ্গে পড়া জার্মানিকে আবার গড়ে তুলতে শ্রম দিয়েছে উজাড় করে। একটি সুশৃঙ্খল সমাজে শরণার্থীরা সব সময় আশীর্বাদ হয়ে আসে। কিন্তু বিশৃঙ্খল সমাজে ঘটে তার উল্টোটা। এই বাস্তবতা অনুধাবন করলে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গণহত্যার শিকার শরণার্থী রোহিঙ্গাদের সম্ভাবনার মানবজমিনে নতুন জীবন সৃজনের দৃষ্টান্ত তৈরি করা সম্ভব।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য