আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

‘শান্তিকন্যা’ সু চির হাতে কেন রক্ত ঝরে?

আলমগীর শাহরিয়ার  

১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার ৩২তম প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন ডিলানো রুজভেল্ট ৭৭তম কংগ্রেসের প্রেসিডেন্টের নিয়মিত ভাষণ ‘State of the Union Address’-এ গোটা পৃথিবীর মানুষের জন্য স্বাধীনতার ৪টি অসামান্য উক্তি উচ্চারণ করেন। ইতিহাসে যা ‘Four Freedom Speech’ নামে বিখ্যাত হয়ে আছে।

  • Freedom of Speech (মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা)
  • Freedom of Worship (মানুষের প্রার্থনা বা ধর্মের স্বাধীনতা)
  • Freedom from want (poverty) (অভাব বা দারিদ্র্য থেকে মানুষের মুক্তি)
  • Freedom from fear (ভয় বা জবরদস্তিমূলক ব্যবস্থা থেকে মানুষের মুক্তি)।

আধুনিক সভ্যতায় ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বাধীন সত্ত্বার বিকাশে এগুলোকে অন্যতম মানদণ্ড ধরা হয়। এসব মানদণ্ডের কোন একটির বিচারেও আজকে পার্শ্ববর্তী মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা জাতিসত্তা নিধনে লিপ্ত দেশটিকে একটি সভ্য রাষ্ট্র বলা যায় না। একটি অসভ্য, বর্বর রাষ্ট্র আমাদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি হিটলারের জার্মানিতে ইহুদি নিধনের দুঃসহ স্মৃতির কথা উসকে দেয়। সে পথেই এগোচ্ছে মায়ানমার। শান্তিতে নোবেল জয়ী সু চির বিস্ময়কর নীরবতা থেকে প্রত্যক্ষ ইন্ধন বিশ্বের বিবেকবান মানুষের মত আমাদেরও হতাশ ও ক্ষুব্ধ করেছে। সম্প্রতি সু চি এক প্রতিক্রিয়ায়, "সন্ত্রাসীদের স্বার্থে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর মাধ্যমে উত্তেজনা উসকে দেয়া হচ্ছে"- গণমাধ্যমে প্রচারিত সেখানকার ভয়াবহতাকে উপেক্ষা করে উল্টো আক্রমণ করে এ বক্তব্য দিয়েছেন এমন সময় যখন খোদ জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ‘UNHCR’ তথ্য অনুসারে রাখাইন প্রদেশে সেদেশের সেনা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, নিপীড়নে ঘর-বাড়ি হারিয়ে ১লক্ষ, ৮০ হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে বানের জলের মত সীমান্ত পেরিয়ে ভেসে এসেছে বাংলাদেশে।

বলাবাহুল্য, প্রকৃত সংখ্যা ইতোমধ্যে পরিসংখ্যানের তথ্যকে ছাড়িয়ে গেছে। অনেকেই ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় আশ্রয় নিচ্ছে। নদী, সমুদ্র পার হতে যেয়ে ডুবে মরেছে কয়েক শ’ মানুষ। বিশ্ব বিবেককে নাড়া দেয়া শিশু আয়লান কুর্দির লাশের মত অনেক শিশুর লাশ ভাসছে নাফ নদীতে। এমন প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করে সু চির অসংবেদনশীল মন্তব্য সেখানকার পরিস্থিতির প্রতি তাঁর উদাসীনতা ও একটি জাতিগোষ্ঠী নিধনে তাঁর ইন্ধন পৃথিবীর সকল বিবেকবান মানুষকে সংক্ষুব্ধ করে। সু চি, সামরিক জান্তার বন্দীদশায় থাকা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মহান নেত্রী হিসেবে পৃথিবী আপনাকে অভিনন্দিত করেছিল। এক দশক ব্যবধানে আপনি পৃথিবীর তাবৎ বিবেকবান মানুষের, আপনার প্রতি সহমর্মী মানুষের নিন্দার পাত্রী হয়ে গেলেন! কি বিস্ময় !

মনে পড়ছে। তখন জানুয়ারি মাস, ২০০৯। আমেরিকার স্বাধীনতার ২৩২ বছরের ইতিহাসে প্রথম একজন কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউজে প্রবেশ করবেন। বাড়তি উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় অনেক গণমাধ্যম সেদিনের শপথ অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করছে। লিঙ্কন মেমোরিয়াল প্রাঙ্গণে সাদা কালো লাখো মানুষের ঢল। তখনো ক্যাম্পাসে থাকি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের টিভি রুমে উপচে পড়া ভিড়। সাধারণত কোন বিশ্বকাপ খেলা দেখা ছাড়া টিভি রুমে এমন ভিড় দেখা যায় না। অন্ধকারাছন্ন আফ্রিকা মহাদেশের কেনিয়ার লুও জাতির রক্তের উত্তরাধিকার বারাক হোসেন ওবামা। মার্কিন নির্বাচনে ডেমোক্রেট প্রার্থী হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তৃতীয় বিশ্বের একজন সাধারণ সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের আবেগ, অনুভূতি সহজে অনুমেয়। তখন নীলক্ষেত থেকে ‘ড্রিমস ফ্রম মাই ফাদার’, ‘অডেসিটি অব হোপ’-পড়া শেষ।

কেননা “আমেরিকার জর্জিয়ার লাল পাহাড়ে ক্রীতদাসের সন্তানেরা এবং তাদের মালিকেরা একত্রে ভ্রাতৃত্বের টেবিলে বসবে, মিসিসিপি- যেখানে অন্যায় অত্যাচারের বিভীষিকা মাত্রা ছাড়িয়েছে সেটিও একদিন স্বাধীনতা আর ন্যায় বিচারের নন্দন কাননে পরিণত হবে”–এমন স্বপ্নজাগানিয়া "আই হ্যাভ এ ড্রিম" স্পিচের মার্টিন লুথার কিংয়ের পর যুদ্ধবাজ, নতুন বর্ণবাদ ও অর্থনৈতিক বৈষম্যপূর্ণ মার্কিন সমাজে ওবামাই ‘চেঞ্জ উই নিড’, ‘চেঞ্জ ইউ ক্যান হোপ ইন’ বলে আশা জাগিয়েছিলেন। তিনিও শেষমেশ পারেননি। চেনা রাজনীতিবিদদের মত নীরবে আপস করলেন। স্রোতে গা ভাসালেন। আমাদের স্বপ্ন ও আশার আগুনে জল ঢেলে ব্যর্থ হলেন। যুদ্ধবাজ বুশের যুদ্ধের লিগ্যাসি টেনে নিলেন। আশাজাগানিয়া বারাক ওবামাও নিছক একজন রাজনীতিক হিসেবেই মঞ্চ থেকে বিদেয় নিলেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বদলায় পররাষ্ট্র নীতি বদলায় না–প্রমাণ হল।

আফ্রিকার মহান নেতা নেলসন ম্যাণ্ডেলার সঙ্গে তুলনীয় সু চি আমাদের কৈশোরে, প্রথম তারুণ্যে দেখা মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামে লড়াই করা অবিসংবাদিত এক নেত্রীর নাম, প্রেমের নাম। গোটা বিশ্ব এক সময় তার পক্ষে দাঁড়িয়েছে। সু চি গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে পৃথিবীর মানুষের মন জয় করেছেন। সেই সু চি যখন গণতন্ত্রের সৌন্দর্য বহু ভাষা, সংস্কৃতি, বৈচিত্র্য ও বহুত্ববাদের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজ দেশে রোহিঙ্গাদের জাতিগত অধিকার অস্বীকার করে তাদের নিধনে ইন্ধন দেন, ভূমিকা পালন করেন তখন আমার কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে মনে পড়ে, “বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে/রাজনীতিকের ধমনী শিরায় সুবিধাবাদের পাপ।” আর এ ত পাপের চেয়েও বেশি।

বর্তমান সময়ে মায়ানমার ও সু চির কথা মনে পড়লে ১৯৪৮ সালে গৃহীত জাতিসংঘের মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা পত্রের অঙ্গীকার পরিহাস মনে হয়। বিশ্ববিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ডে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি পড়ুয়া সু চি নিশ্চয়ই পড়েছেন মানবাধিকার সনদটি(Universal Declaration of Human Rights-UDHR)। সার্বজনীন এ ঘোষণা পত্রের আর্টিকেল-৩ বলা আছে, “প্রত্যেকে মানুষের জীবন-ধারণ, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে।” সু চি তাঁর জীবনের সব অর্জন, সব শিক্ষা-দীক্ষা বিস্মৃত হয়ে রাজনৈতিক, উগ্র-জাতীয়তাবাদী বোধে এখন অন্ধ। অন্ধ জাতিসংঘ, মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা ইউরোপ ও আমেরিকা। সমুদ্র উপকূলে অসহায় মানুষের কান্না দেখলে মনে হয়, অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ।

শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সাং সু চি, রাখাইন প্রদেশে, সীমান্তের নাফ নদীতে “কত হাজার মরলে পরে মানবে তুমি শেষে/ বড্ড বেশি মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে।”

আলমগীর শাহরিয়ার, কবি ও প্রাবন্ধিক। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ