প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭
প্রত্যেকটি মানুষের জীবনের নিজস্ব বাস্তবতা থাকে। ফলে তার যে কোন প্রতিক্রিয়ার একটা মর্মন্তুদ ইতিহাস থাকে। অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেন, আহত হন মানুষের আত্মকেন্দ্রিক বা সংকীর্ণ আচরণে। এই আত্মকেন্দ্রিক বা সংকীর্ণ আচরণের খুবই যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে।
মানুষের মধ্যে মানবতার বিপর্যয় একেবারেই কোন বিচলন তৈরি না করার মতো আত্মকেন্দ্রিকতা, বা চয়িত মানবতাবাদী হয়ে অপছন্দের ক্ষেত্রে দানবীয় হয়ে ওঠার পেছনে মানুষটির ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়।
যে বৌদ্ধপাড়ায় স্থানীয় সর্বদলীয় অপরাধীরা রোহিঙ্গাদের শরণার্থী জীবনের সুযোগ নিয়ে তাদের দিয়ে আগুন দিয়েছিলো; সে বৌদ্ধপাড়ার মানুষের জন্য আরও রোহিঙ্গার আগমন ভীতিপ্রদ সংবাদ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের যে পাহাড়িরা দীর্ঘ বঞ্চনার মাঝে বসবাস করছেন; মুসলমান সেটেলাররা যাদের সঙ্গে সাপে-নেউলে সম্পর্কে উপনীত; সেখানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের আগমন পাহাড়িদের জন্য কোন সুখকর সংবাদ নয়।
যে সনাতন ধর্মীরা মুসলমানদের আগ্রাসনে উচ্ছেদ হয়ে গেছেন প্রায়, এই সেদিনও নাসিরনগরে তাদের ঘর-বসতিতে আগুন দিলো স্থানীয় রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী মুসলমানরা; তারা রোহিঙ্গা মুসলমানদের আগমনে স্বস্তি পাওয়ার কথা নয়।
এই প্রত্যেকের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা তাদেরকে আত্মকেন্দ্রিক হতে বাধ্য করেছে। নিরাপত্তাহীনতায় নিয়ত বসবাসকারী সংখ্যালঘু মানুষদের যে জীবন বাস্তবতা তা উপলব্ধি করার ক্ষমতা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের নেই।
আবার মুসলমানদের মধ্যেই যারা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার বিপক্ষে তাদের জীবনের বাস্তবতা সুখপ্রদ নয়। বানভাসি; নদীভাঙনের যে মানুষ বার বার ঘর ভেঙে ভেঙে অনিশ্চয়তায় জীবন কাটিয়েছে; ফসল ডুবে যাওয়ায় বা পুড়ে যাওয়ায় যে মানুষকে অনাহারী থাকতে হয়েছে; মঙ্গায় উন্মূল হয়ে শহরে আসা মানুষকে ছোট ঘরে অনেক মানুষ গাদাগাদি করে ঘুমাতে হয়েছে; আর্থিক বিপর্যয়ে যাদের অনাহারে জীবন বাঁচাতে হয়েছে; অনেক লড়াই করে জীবনে আজকের সচ্ছল অবস্থায় আসতে হয়েছে; তাদের মনোজগতে নিরাপত্তাহীনতা এবং অতীতের ট্রমা সবসময় ক্রিয়া করে।
ক্ষুধার কষ্ট ক্ষুধায় না কাটানো মানুষের পক্ষে বোঝা অসম্ভব। সুতরাং ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের আত্মকেন্দ্রিক প্রতিক্রিয়া খুবই স্বাভাবিক। অন্যের সঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়ার জন্য দীর্ঘ মানসিক প্রস্তুতি লাগে। এমনিতেই একজন মানুষ সংকীর্ণ বা উদার হয়না। এর পেছনে মনোজাগতিক কারণ থাকে; যে কারণের যৌক্তিকতা থাকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও এরপরের অনাহার ও অনিশ্চয়তার ট্রমা জার্মান জাতির মাঝে আজও জীনগতভাবে ক্রিয়াশীল। সপ্তাহান্তের বাজারের সময় জার্মানরা মাত্রাতিরিক্ত খাদ্য সামগ্রী কেনে। দীর্ঘ ছুটি হলে শপিংমলে মানুষকে উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়াতে দেখলে মনে হয় তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অদৃশ্য সাইরেন শুনছে। দোকান বন্ধ হয়ে যাবে; তাই তাড়াহুড়া করে অনেক খাদ্যসামগ্রী কেনে।
বাংলাদেশের মানুষের মাঝেও রয়ে গেছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অনাহারী- অনিশ্চিত সময় ও শরণার্থী জীবনের ট্রমা। ফলে শরণার্থীদের প্রতি তাদের অনেকের মাঝেই সমানুভূতি না-ও থাকতে পারে। এটা খুব স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।
রাষ্ট্র-সমাজ-রাজনীতি যখন প্রতিটি মানুষকে বিকাশের অনুকূল পরিবেশ দেবে; ন্যুনতম সামাজিক সুরক্ষাকবচ দেবে; তখন নানারকম অনিশ্চয়তার ট্রমার ক্রমশ উপশম ঘটবে। তখন আর ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের বিভাজন রেখার নানাদিকে দাঁড়িয়ে নানা মানুষ কেবল সিলেক্টিভ বা চয়িত মানবতা বা দানবতা দেখাবে না। বুঝতে শিখবে মানবতার কোন ধর্ম-রাজনীতি থাকেনা। এর কোন আংশিক সত্য থাকেনা। মানবতা হচ্ছে সামষ্টিক ও সামগ্রিক সত্য।
যে কোন মানুষের বিপদে মানুষের এগিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক মানবিক প্রতিক্রিয়া। যে কোন পরিস্থিতিতে আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর পক্ষে অবস্থানই মানুষের অবস্থান। সেটাই একমাত্র পলিটিক্যালি কারেক্ট অবস্থান।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য