প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
আলমগীর শাহরিয়ার | ১৯ আগস্ট, ২০১৮
তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী। দীর্ঘ এক সফরে বিদেশ গেছেন। ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ময়মনসিংহের ধানীখোলা গ্রামের আবুল মনসুর আহমদ। তখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় তার পোর্টফোলিও শিল্প-বাণিজ্যমন্ত্রীর। যা হোক, পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন দেশের প্রধান অস্ত্র কারখানা (অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি) পরিদর্শন করবেন। যথারীতি ফ্যাক্টরির ডিরেক্টর জেনারেল আজম খাঁ তাকে পিণ্ডি হতে রিসিভ করে কারখানায় নিয়ে যান। ঘুরে ফিরে অস্ত্র কারখানা পরিদর্শন করার এক ফাঁকে ডিরেক্টরকে প্রধানমন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, ‘বলুন তো আমাদের অস্ত্রের দৈনিক, মাসিক বা বাৎসরিক উৎপাদনের পরিমাণ কত?’
ডিরেক্টর এমন প্রশ্ন শুনে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, ‘মাফ করবেন স্যার। আমরা বলতে পারব না।’ আরও যোগ করে বললেন, এসব বলতে মানা আছে। টপ সিক্রেট।’ কিছুটা উষ্মা প্রকাশ করে আবুল মনসুর আহমদ বললেন, আমি প্রধানমন্ত্রী ও দেশরক্ষামন্ত্রী হিসাবেও আমাদের অস্ত্র কারখানার উৎপাদন জানতে পারব না! এসব জানতে হলে প্রপার চ্যানেলে আসতে হয় বলে ডিরেক্টর প্রধানমন্ত্রীকে জানান। প্রপার চ্যানেল হল ডিফেন্স সেক্রেটারি, প্রধান সেনাপতি, প্রেসিডেন্ট।
করাচি ফিরে তিনি ডিফেন্স সেক্রেটারি আখতার হোসেন ধরলেন। ডিফেন্স সেক্রেটারি এ ব্যাপারে তার অজ্ঞতা জানিয়ে প্রেসিডেন্টকে এসব রাষ্ট্রীয় সেনসেটিভ তথ্য জিজ্ঞেস করতে অনুরোধ করলেন। তিনি এবার প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মির্জার দ্বারস্থ হলেন। সুপ্রিম কমান্ডার প্রেসিডেন্ট ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রীকে এসব ব্যাপার জেনে কী লাভ বলে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাইলেন। পরে নাছোড়বান্দা প্রধানমন্ত্রীকে এসব ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট নিজ অজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রধান সেনাপতির সঙ্গে যোগাযোগ করার উপদেশ দিলেন। প্রধান সেনাপতি এসময় বিদেশ ভ্রমণে থাকায় ডিফেন্স সেক্রেটারিকে প্রধান সেনাপতি ফেরা মাত্র ‘বিহিত ব্যবস্থা’ নিতে আদেশ দিলেন আবুল মনসুর আহমদ।
তাঁর স্মৃতিকথা ভারতবর্ষের রাজনীতির এক আকর গ্রন্থ ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’- এ লিখেছেন, এ ব্যাপারে “কোনো বিহিত ব্যবস্থা হইল না। অথবা বিহিত ব্যবস্থা বোধ হয় হইল। আমাকে কিচ্ছু জানান হইল না।” তিনি এমন আচরণে নাখোশ হয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরা মাত্র নালিশ করবেন বলে স্থির করে রাখলেন। সোহরাওয়ার্দী দেশে ফিরলে তাকে আর নালিশ করতে হলো না। উল্টো তিনি এসব গোপনীয় তথ্য জানার কৌতূহলে খোদ প্রধানমন্ত্রীর কিছুটা রোষানলে পড়লেন। এবার আবুল মনসুর আহমদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে জানতে চাইলেন, লিডার আপনি এ ব্যাপারে কি জানেন বলুন। তিনিও প্রেসিডেন্টের মত কিছুক্ষণ এদিক সেদিক বলে নিজের অজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। অর্থাৎ এ ব্যাপারে তিনিও কিছু জানেন না বা জানা উচিত নয় – এটা তিনি জানেন। তাই এসব ব্যাপারে কৌতূহল প্রকাশ করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
আবুল মনসুর তাঁর স্মৃতিকথায় লিখছেন, “আমার বাঘা প্রধানমন্ত্রী ও দেশরক্ষামন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর এই অবস্থা! আর আর প্রধানমন্ত্রীদের কি ক্ষমতা ছিল অনুমান করিলাম। বুঝিলাম নামে মাত্র পার্লামেন্টারি সরকার চলিতেছে দেশে। কিন্তু দেশরক্ষা দপ্তরে মন্ত্রীদের বা মন্ত্রিসভার বা আইন পরিষদের কোনো ক্ষমতা নাই। সেখানে সামরিক কর্তৃত্ব চলিতেছে। লিডার যা বলিলেন, তারচেয়েও তিনি বেশি জানেন। আমরা যে কত অক্ষম, অসহায়, তা বোধ হয় তিনি আমার চেয়েও বেশি উপলব্ধি করেন। তিনি যে দু-একবার প্রকাশ্যভাবে এবং অনেকবার আমাদের কাছে বৈঠকে মার্শাল ল’র ডর দেখাইয়াছেন, তার কারণ নিশ্চয়ই আছে।”
- মজার বিষয় হলো পাকিস্তান জামানার এই রাজনীতিবিদের অম্ল মধুর স্মৃতির ছয় দশকের বেশি সময় পর গোটা পৃথিবী পাল্টে গেলেও পাকিস্তান আজও পাল্টায়নি। সামরিক কর্তৃত্বের বাইরে সেদেশে মানুষের কোনো ইচ্ছে-আকাঙ্ক্ষা, রাজনীতি নেই। জনগণের ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষায় এখানে রাষ্ট্র পরিচালিত হয় না। হয় সেনাবাহিনীর পূর্ণ কর্তৃত্ব ও ইচ্ছেয়।
এমনই এক পটভূমিতে তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টির প্রধান ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আনুষ্ঠানিক শপথ নিয়েছেন গতকাল। শোনা যায়, একাত্তরে গণহত্যার কুখ্যাত চরিত্র আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজীর ভাতিজা ইমরান খান। তার প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় যদি কোন বাঙালি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে, অভিনন্দন জানায়--তাকে নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে যথেষ্ট সন্দিহান। তাকে যে শুভেচ্ছা জানায় বুঝতে হবে সে পাকিস্তানের হ্যাপিয়েস্ট জারজ না হলেও, ইডিওলজিক্যাল জারজ মানস ধারণ করে।
এই ইমরান খান প্রকাশ্যে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করেছেন। নাখোশ হয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। ক্রিকেটার ইমরান খান আর রাজনীতিক ইমরান খানের ফারাকটা এখানেই। জন্মের পর থেকেই পাকিস্তানে কোন গণতন্ত্র নেই। সেখানে সেনাবাহিনীই একমাত্র সত্য। আর সব মিথ্যা। বলা হয়, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেরই সেনাবাহিনী আছে, কিন্তু পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর একটি দেশ আছে (A state within state)। তাদের খেয়াল খুশি মত সব চলে।
বলাবাহুল্য, ইমরান খান সেনাবাহিনীর খেলার নয়া পুতুল। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ইতোমধ্যে তার বিজয়কে 'পাতানো ম্যাচ' বলে আখ্যায়িত করেছে। এই পাতানো ম্যাচ তিনি খেলেছেন সেনাবাহিনীর সঙ্গে।
একসময় পশ্চিমা জীবনে অভ্যস্ত ইমরান রাজনীতিতে নাম লেখানোর পর উপমহাদেশের চিরাচরিত ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির খাতায় নাম লেখান। বদলে ফেলেন নিজ মানস আর লেবাসও। এজন্য গণতন্ত্র বিরোধী পাকিস্তানের জঙ্গিরাও তাকে এবার সমর্থন দিয়েছে। অথচ ব্যক্তি জীবনে 'প্লে বয়' খ্যাত এই ইমরান একাধিক বিয়ে, বিভিন্ন নারীসঙ্গের মধ্য দিয়ে অনেক কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়েছেন। তার সঙ্গে বিছানায় না গেলে নাকি নারী কর্মীদের দলে পদ দেন না---এমন গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত এই রাজনীতিবিদ ঘোষণা দিয়েছেন রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়ে রাসূলের 'মদিনা সনদ' বাস্তবায়ন করবেন। ভণ্ডামির এও নিশ্চয়ই এক নতুন উদাহরণ।
মদিনা সনদ বাস্তবায়নের ঘোষণা শুনে ইমরান খানের বিজয়কে ইসলামের বিজয় ভেবে উল্লসিত হবার কিছু দেখছি না। ইসলাম দূরে থাক এ বিজয় পাকিস্তানে রাজনীতি বা গণতন্ত্রের বিজয়ও না। সামরিক দাবা খেলার নয়া চাল। মঞ্চস্থ হবে পাক রাজনীতির মঞ্চে আরেক নতুন নাটক। পর্দা না নামা পর্যন্ত দৃশ্যায়ন দেখতে থাকুন। এ নাটুকে পরিস্থিতিতে আমরা ইমরান খানকে অভিনন্দন জানাই কেমন করে!
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য