আজ মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

অকল্যাণ রাষ্ট্রের শনি-বৃত্তে ভারত-পাকিস্তান

মাসকাওয়াথ আহসান  

দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ একেবারেই যুদ্ধ পছন্দ করে না। যোদ্ধার জাতও এরা নয়। এমনকি ইতিহাসে দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে গিয়ে দেশজয় করার কৃতিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। ইতিহাসের বিরল যোদ্ধা অশোকও যুদ্ধ থেকে ফিরে অনুতাপের কারণে অহিংস মতাবলম্বী হয়ে পড়েছিলেন। খানিকটা দার্শনিক চিন্তার বাতাবরণ থাকায়; মানুষ এখানে শান্তিপ্রিয়। এ কারণেই হাজার বছর ধরে বহিঃশক্তির আক্রমণের শিকারও হয়েছে তারা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল না হয়ে পড়লে বৃটিশ রাজ এতো সহজে ভারতীয় উপমহাদেশকে মুক্তি দিতো বলে মনে হয় না।

দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের একটি অংশ সব যুগেই ক্ষমতা-কাঠামোর আদরে থাকতে চেয়েছে। ফলে বহিঃশত্রুকে সুযোগ করে দিতে আত্মঘাতি প্রাসাদ ষড়যন্ত্রও লক্ষ্য করা যায় ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে।

ঘরের শত্রু বিভীষণদের ব্যক্তিগত সাফল্যও চোখে পড়ার মতো। ষড়যন্ত্রের শিকার নবাব সিরাজ উদ দৌলার উত্তর-পুরুষ দারিদ্র্যে বিশীর্ণ জীবন কাটায়; আর ষড়যন্ত্রকারী মীরজাফরের উত্তর পুরুষ আজকের কালেও প্রাসাদোপম গৃহে বসবাস করে। এতে করে সোজা বাংলায় 'দালালি' বিষয়টি দক্ষিণ এশিয়ায় সাফল্যের নিয়ামক হিসেবে খুবই প্রতিষ্ঠিত।

দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ যেহেতু যোদ্ধার জাত নয়; এই এলাকার বাইরে গিয়ে যুদ্ধজয়ের ক্ষমতা যেহেতু তাদের নেই; তাই নিজের এলাকার মধ্যেই কাইজ্জা করা নিয়মিত বিনোদন তাদের। পারিবারিক পর্যায়ে এই কাইজ্জা জমি-জমা নিয়ে হয়ে থাকে। দক্ষিণ এশিয় কাইজ্জার জীনগত বৈশিষ্ট্য দেখেই বৃটিশেরা ভারত সংসারটিকে ভাগ করে দেবার কালে ভারত ও পাকিস্তান আমৃত্যু কাইজ্জা চালিয়ে যাবার উপাদান হিসেবে "কাশ্মীর'-কে রেখে যায়। এ হচ্ছে কাইজ্জার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।

আর অন্য কোন বড় দেশ যেমন, চীন, রাশিয়া বা এমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধ করার সামর্থ্য নেই; তবু বিশাল বাজেটের সেনাবাহিনী আছে; তাই "কাশ্মীর" নিয়ে জাতিসংঘের মধ্যস্থতা ও সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরের মানুষকে সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগ প্রত্যাখ্যান করে ভারত এর বৃহদাংশে তার দখল ধরে রাখে। পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে লাঠালাঠি করে এর ক্ষুদ্র অংশ দখল করে রাখে। সভ্যভাবে সংলাপের মাধ্যমে কোন সমস্যা সমাধানের গুণটি আবার দক্ষিণ এশিয় বংশগতিতে নেই। প্রায় সাতটি দশক "কাশ্মীর" নিয়ে ভারত-পাকিস্তান কাইজ্জা চলতে থাকে; মাঝে মাঝে সেটাকে একটা যুদ্ধ বলে আত্মতৃপ্তি পায় দুটি দেশ। কারণ দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে গিয়ে যুদ্ধের মুরোদ তো তাদের ছিলো না, নেই, হবেও না।

কিন্তু ভারত-পাকিস্তান উভয় দেশের সেনাবাহিনী আছে; তা নিয়ে এলাকাবাসীর গর্বেরও সীমা নেই। কিন্তু সাতটি দশকে এই দুটি সেনাবাহিনী নিজ নিজ দেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দিয়ে দেশের মানুষই হত্যা করে চলেছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা অসম সাহসিকতায় লড়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে। ফলে পাকিস্তান নামের রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি পেয়েছে বাংলাদেশ। এরপর থেকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বালুচিস্তানে তাদের হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত রেখেছে।

ভারতের সেনাবাহিনী নকশাল বাড়ি আন্দোলন, শিখ-খালিস্তান আন্দোলন দমনে গণহত্যা করেছে। তাদের হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত রয়েছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সেভেন সিস্টারস রাজ্যে। আজ দখল করে রাখা কাশ্মীরে হত্যাযজ্ঞ তো তাদের নিয়মিত হত্যার মৃত্যু উপত্যকা। বড় কোন দেশের সঙ্গে যুদ্ধের মুরোদ না থাকায় পাকিস্তান-ভারতের সেনাবাহিনীর মাঝে মাঝেই এই যুদ্ধের আত্মরতি; মাঝে মাঝে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখার দুপাশ থেকে গোলাগুলি করে যুদ্ধের ছদ্ম সুখ নেয় যেন তারা। কিন্তু কাশ্মীর রয়ে যায় ভারতের রাহুগ্রাসে।

যে রাষ্ট্র কল্যাণ রাষ্ট্র- যেখানে রাষ্ট্র নাগরিকের ন্যুনতম মৌলিক চাহিদার জোগান দিতে পারে; সেখানে অপরাধ প্রবণতা, বিচ্ছিন্নতাবাদ, ধর্মীয় কট্টর সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিতে পারে না। এই পাকিস্তান-ভারত সেনাবাহিনীর বাজেটে যেরকম খরচ গত সাতটি দশকে করেছে; তার অর্ধেক বাজেট জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, সামাজিক সুবিচার খাতে করলে; আজ পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদী আজহার মাসুদেরাও প্রান্তিক জনমানুষের মাঝে সন্ত্রাসের মাধ্যমে কাশ্মীরের মানুষের মুক্তির খল-স্বপ্ন বিক্রি করতে পারতো না। ভারতের গুজরাট গণহত্যাকালীন সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, সন্ত্রাসবাদীর শীর্ষ তালিকায় নাম থাকায়, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবার আগে পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিলো যার; সেই তিনি এসে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বড় মুখ করে মন্থরার ভাষণ দেবারও প্রয়োজন হতো না।

কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যটিকে পুরোপুরি অবহেলা করে দক্ষিণ এশিয়া তাই গত সাতটি দশক ধরে অকল্যাণ রাষ্ট্রের শনি-বৃত্তে লাটিমের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ