প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জুয়েল রাজ | ২২ আগস্ট, ২০১৯
জম্মু কাশ্মির! আমাদের কাছে এক স্বপ্নের নাম, প্রিয়তমার লাল গালের উপমায় কাশ্মিরী আপেল, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি, পৃথিবীর স্বর্গ, এশিয়ার সুইজারল্যান্ড কতো উপমা তার। উপমায় কাশ্মির যতোটা রূপসী সেখানের মানুষের জীবনে ততোটাই মলিন। ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক চক্রে আটকে আছে কাশ্মির, সীমান্তের প্রহরী, সুন্দরী রমণীর খোঁজে, বাণিজ্যের লোভে কাশ্মিরকে কেউই ছাড়বে না। সুন্দর নারী ও যেন কাশ্মিরের অভিশাপ। মোদি সরকার কাশ্মির নিয়ে ঘোষণা দেয়ার সাথে সাথে গুগলে ভারতজুড়ে নাকি কাশ্মিরী গার্ল খোঁজার হিড়িক পড়েছিল। পাকিস্তান, চীন, ভারত সবাই কাশ্মির চায়, কাশ্মিরের মানুষের চেয়ে ও কাশ্মিরের মাটি তাদের বেশী জরুরী। কাশ্মির ইস্যুটা ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক। বিজেপির মতো অতি সাম্প্রদায়িক দল, যারা প্রত্যেকবার তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে কাশ্মিরের এই ধারা সমূহ বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। এবারের নিরঙ্কুশ বিজয়ে এই সুবিধাটা নিবে, সেটাই স্বাভাবিক। আর সেই কাজটাই করছে বিজেপি ও মোদি সরকার। এবং সম্পূর্ণ সাংবিধানিকভাবে প্রক্রিয়াটা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে মোদি সরকার।
বাংলাদেশে পার্বত্য অঞ্চলে ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তি, পাহাড়কে শান্ত করেছে। সেই শান্তিতে আমাদের শান্তি হয়েছে, কিন্তু আদি পাহাড়িরা অশান্তিতে আছেন এখন। একটু খোঁজ নিলেই তাঁদের বোবা আর্তনাদ শুনতে পাবেন। তাঁদের কান্না শোনার কেউ নেই। কাশ্মিরে ও যে এরকমটা হবে না সেটার নিশ্চয়তা নেই। ফড়িয়ারা রুপির বস্তা নিয়ে সেখানে যাবে। আর বর্তমান বিশ্বায়ন ও আধুনিকতার বুহ্য কাশ্মিরের মানুষকেও আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নিবে। দুর্বিষহ করে তুলবে মানুষ ও প্রকৃতিকে। অনেকেই বলেন, কাশ্মিরে গণভোট দিলে কাশ্মির পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হবে। হিসাবটা খুব সহজ নয়। দেশ বিভাগের পরে সিলেট যখন পূর্বপাকিস্তানের সাথে সংযুক্ত হয় সেই গণভোটের হিসাব নিকাশ মিলালেই এর উত্তর কিছুটা পাওয়া যাবে। সেই সময় সিলেট অঞ্চলের হিন্দু জনসংখ্যাও একেবারে কম ছিল না। এবং সিলেট অঞ্চলের বেশীরভাগ জমিদার ভূ-স্বামীরাও ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়েরই লোকজন, কিন্তু সমর্থন করেছিলেন পাকিস্তান অন্তর্ভুক্তিকে। হয়তো ধর্মের চেয়ে নিজেদের সহায় সম্পত্তি এবং প্রভাব প্রতিপত্তিকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। কাশ্মিরেও একই অবস্থা।
কাশ্মির নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই কৌতূহল ছিল। নির্মোহ ভাবে চেষ্টা করেছি সমস্যাগুলো বুঝতে। কাশ্মিরের দুর্ভাগ্যের জন্য যতোটা না ভারত দায়ী তার চেয়ে বেশী দায়ী পাকিস্তান। ব্রিটিশদের রাজত্বকালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে টাকা দিয়ে রাজা হরি সিং রাজ্যটি কিনে নিয়েছিলেন। এই রাজ্যগুলোকে বলা হতো প্রিন্সলে স্ট্রেইট। তেমনি আরেকটি স্ট্রেইট ছিল হায়দ্রাবাদ। তাই ভাগাভাগির সময় ব্রিটিশরা কাশ্মির এবং হায়দ্রাবাদে হাত দেয়নি। তাঁদের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিয়েছিল। ভারতবর্ষ ভাগ নিয়ে যখন আলোচনা চলাকালীন সময় পাকিস্তান কাশ্মির আক্রমণ করে। কথিত আছে কাশ্মিরের নারীদের ধর্ষণ করার জন্য পাকবাহিনী তাদের দখলকৃত জায়গায় দু'দিন অবস্থান না করলে অন্তত অর্ধেক কাশ্মির তারা দখলে নিতে পারতো। রাজা হরি সিং ভারতের সাথে নিঃশর্ত ভাবে অন্তর্ভুক্তিতে প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরই কাশ্মিরে সেনা পাঠায় ভারত সরকার।এবং পাকিস্তানকে প্রতিহত করে। এবং পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মির উদ্ধারের পূর্ব মুহূর্তে জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতির কারণে আর হয়ে উঠেনি। এবং সে সময়ের কাশ্মির এবং ভারতের মুসলমান নেতারাও ভারতের অন্তর্ভুক্তির পক্ষে ছিলেন। লাদাখ, জম্মু, কাশ্মিরে এখনো বিপুল সংখ্যক হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষের বসবাস। যারা সবসময়ই একক ভারতের পক্ষে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করেছে। শতভাগ মুসলিম ধর্মাবলম্বীও যে কাশ্মিরের স্বাধীনতার পক্ষে কিংবা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তির পক্ষে থাকবে সেটা ভাবা বোকামি হবে। জম্মু কাশ্মিরের ২০ টি জেলার মধ্যে ৫টি জেলার নির্দিষ্ট অংশে অস্থিরতা চলছে,বাকী ১৫টি জেলা শান্ত। তাই এই আন্দোলনের ভবিষ্যতে সম্পর্কে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ আছে বলে মনে হয়না।
ভারত এবং পাকিস্তান দুই দেশের রাজনীতিতেই ট্রাম কার্ড কাশ্মির। এবং তাদের শত্রু শত্রু খেলা। দেশ ভাগের পর থেকেই দুই দেশ সময়ে সময়ে এই কার্ড নিয়ে খেলছে। তাই কাশ্মিরের মতো সীমান্ত কোনভাবেই কেউ হাতছাড়া করতে চাইবে না। পাকিস্তান এবং চীনের অংশ কোনভাবেই স্বাধীন কাশ্মির কিংবা একক কাশ্মির হতে পারবে না। তিন দেশের সাথে মোকাবেলা করার মতো, রাজনৈতিক ক্ষমতা কোন কাশ্মিরেই নেই। যেমন বেলুচিস্তান দীর্ঘদিন আন্দোলন সংগ্রাম করেও পাকিস্তান থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। সেখানে গুম, হত্যা, নির্যাতন দিনদিন বেড়েই চলছে। বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনে নাকি এখনো প্রেরণার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
কাশ্মিরের চীন এবং পাকিস্তানের অংশ জোর করে দখল করা জম্মু কাশ্মির স্বেচ্ছায় ভারতের অন্তর্ভুক্ত, এবং সাংবিধানিক ভাবেই, আর্টিকেল ৩ দ্বারা ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে উল্লেখ করা। সরকার ৩৭০ এবং ৩৫ এ ধারা সাংবিধানিক ভাবে রদ করেছে। বিরোধী দল কংগ্রেস সেটার বিরোধিতা করছে। আগামীতে কংগ্রেস রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলে এই ধারাগুলো বাতিল করে আবার ও পুর্বাবস্থায় ফিরে যেতে পারে। আর্টিকেল ৩ এর কারণেই চাইলেই কাশ্মির স্বাধীনতার ডাক দিতে পারবে না। হিসাব নিকাশ কিন্তু এখানে ভিন্ন। তাই একটা গ্রুপ কাশ্মিরের স্বাধীনতার চেষ্টা করছে যাদের আতঙ্কবাদী বা উগ্রবাদী হিসাবে বিবেচনা করে দেশের সরকার। এবং ধর্মীয় উগ্রবাদীদের ছাড়া আন্তর্জাতিক ভাবে সমর্থন আদায় করতে পারে নাই কখনো। এক দেশে দুই আইন, দুই সংবিধান, দুই পতাকা না রাখার যে দাবী মোদি সরকারের সেই যুক্তিও উড়িয়ে দেয়ার মতো না। ভারত যখন নিয়ে বৃহৎ শক্তি হিসাবে বিশ্বমানচিত্রে নিজেদের অধিষ্ঠিত করতে এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে বাত্তির নীচে অন্ধকার কাশ্মির রেখে সেই যাত্রা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই ৭০ বছরের সমস্যার সমাধান টানতে চাইছে। আর সেটাই স্বাভাবিক। কাশ্মিরে ১২ লাখ মানুষের নাগরিকত্ব নেই। গত ৭০ বছর ধরে তারা নিজ দেশে পরবাসী। তিন প্রজন্ম ধরে তাদের কেউ সরকারী চাকরী পায়নি কারণ কাশ্মিরের নাগরিকত্ব নেই। ৭ লাখ ৭০ হাজার আছে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ। যাদের মানুষ হিসাবেই গণ্য করা হয়না। ১৯৯০ সালের কাশ্মিরী পণ্ডিতদের সেখান থেকে বিতাড়ণের ইতিহাস ও করুণ মর্মান্তিক। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যে ভাবে নারকীয় তাণ্ডব করেছিল বাংলাদেশে, কাশ্মিরি পণ্ডিতদের পুরুষ নারীদের উপর একইভাবে নির্যাতন চালিয়েছিল ধর্মান্ধ কিছু মানুষ। এবং পণ্ডিতরা বাধ্য হয়েছিল কাশ্মির ছাড়তে। কাশ্মিরের হিসাব তাই খুব সহজ সমীকরণে মিলানো যাবে না। কাশ্মিরের সীমান্ত এলাকা লাদাখ , যেখানে বৌদ্ধ সম্প্রদায় সংখ্যাগুরু। কাশ্মিরের কেন্দ্রীয় সরকার আবার সেখানে, উন্নয়ন ও বরাদ্দের ক্ষেত্রে দু চোখা নীতি অবলম্বন করে। তাই লাদাখ পুরোটাই আবার কেন্দ্রীয় ভারতের অন্তর্ভুক্তির পক্ষে।
কাশ্মিরের সমস্যা কাশ্মিরকেই সমাধান করতে হবে। হয় স্বাধীন কাশ্মিরের জন্য এগিয়ে যেতে হবে এবং সেটা চীনের দখলকৃত আকশার,পাকিস্তান দখলকৃত আজাদ কাশ্মির এবং ভারতে থাকা জম্মু কাশ্মির নিয়ে। একক কাশ্মিরই কাশ্মিরের মুক্তি ঘটাতে পারবে। বাংলাদেশে কাশ্মিরের ছাত্ররা যখন ৩৭০ ধারা এবং ৩৫ এ ধারা বাতিলের বিরুদ্ধে র্যালি করেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তখন কাশ্মিরের আজাদির জন্য মিছিল করছে! লন্ডনে ভারতীয় দূতাবাসের সামনে কাশ্মিরে নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিশাল বিক্ষোভ হয়েছে যেখানে অধিকাংশ বিক্ষোভকারী ছিলেন পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের নাগরিক।
৭০ বছর আগের মতোই, এবার ও পাকিস্তান আগ বাড়িয়েই কাশ্মির সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলেছে। কাশ্মিরের মানুষ যখন ৩৭০ ধারা এবং ৩৫ এ ধারা নিয়ে প্রতিবাদ করছে আন্দোলন করছে সেখানে আগ বাড়িয়ে কাশ্মিরের পক্ষে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত পাকিস্তান! যা কাশ্মিরের মানুষের আন্দোলনের নৈতিক জায়গাটিকে দুর্বল করে দিয়েছে। ভারত সরকার খুব ভালভাবেই কাশ্মিরে পাকিস্তানের হস্তক্ষেপ এবং আভ্যন্তরীণ নাক গলানোর বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলে প্রমাণ করতে পেরেছে। পৃথিবীর কোন দেশকেই পাশে পায়নি ইমরান খান সরকার। দীর্ঘ দিনের পরীক্ষিত বন্ধুরা ও পাকিস্তানের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
পৃথিবীর যে প্রান্তেই মানুষের উপর নির্যাতন নিপীড়ন হউক মানুষ হিসাবে প্রতিবাদ করাই মানুষের কর্তব্য। ধর্মীয় পরিচয়ে নয় কাশ্মিরের আন্দোলনে যারা নির্যাতিত নিপীড়িত হচ্ছেন আমরা তাদের পাশে দাঁড়াব। কিন্তু অন্য দেশের রাজনৈতিক ইস্যুকে নিয়ে ধর্মীয় ইস্যু করে আমরা যেন রাজনীতির শিকার না হই। কাশ্মির যেন আরেকটি আফগানিস্তান না হয়। এক ধর্মযুদ্ধে বিনাশ হয়েছে আফগানিস্তানের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সৌন্দর্য। সব চেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে মানুষের। পৃথিবীর ভূ-স্বর্গ কাশ্মির যেন আরেক আফগানিস্তান না হয়। কাশ্মির যদি কোনদিন স্বাধীনতা দাবী করে আমি সেদিন স্বাধীন কাশ্মিরের পক্ষে দাঁড়াবো। স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। কিন্তু সেই চাওয়াটা হতে হবে কাশ্মিরের মানুষের চাওয়া। অনেকেই হয়তো জানেন না, কাশ্মিরের একটি নিজস্ব সংবিধান আছে, এবং সেটি অসাম্প্রদায়িক ধর্ম নিরপেক্ষ সংবিধান।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য