প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জুয়েল রাজ | ১০ মে, ২০১৬
গত ৫ মে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল লন্ডন মেয়র নির্বাচন। লন্ডনের মেয়র পদটিকে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর পরেই প্রেস্টেজিয়াস মনে করা হয়। লন্ডন মেয়র নির্বাচনে রেকর্ড পরিমাণ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন সাদিক খান। লেবার পার্টির বহু বাঘা বাঘা নেতাকে পিছনে ফেলে দলীয় প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন সাদিক খান। তখন এই মুসলমান মুসলমান রব ছিল না। কিন্তু নির্বাচন যতো কাছে এসেছে মুসলমান মুসলমান মাতম ও যেন ততোই বৃদ্ধি পেয়েছে।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে সাদিক খানের পক্ষে ছিলাম না এর একটাই কারণ জাতিগতভাবে তিনি পাকিস্তানি! আর এই ক্ষেত্রে আমি হুমায়ুন আজাদের বিখ্যাত বানীর সাথে একমত "আমি পাকিস্তানিদের কখনই বিশ্বাস করি না, যখন তারা গোলাপ ফুল হাতে নিয়েও আসে।" আর সেটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত আবেগের বিষয়। যদিও আমার চাওয়াতে কিছুই যায়ও না আসেও না। বাংলাদেশের জাতির জনক, বঙ্গবন্ধু নাতনী টিউলিপ সিদ্দিক যেখানে সাদিক খানের পক্ষে নিজের নবাগত কন্যাকে নিয়ে ক্যাম্পেইন করেছেন, আর সেটা তার দলের নেতা হিসাবেই তাঁকে করতে হয়েছে। আমাদের মতো লোকজন সেখানে হরিদাস পাল !
তবে আমার ব্যক্তিগত আবেগ এর বাইরে, ব্যক্তি সাদিক খান নিজেকে প্রমাণ করেছেন লন্ডনের নেতা হিসাবে, আগামীর ব্রিটেনের নেতা হিসাবে। যাকে ব্রিটেনের আগামী দিনের ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মন্তব্য করছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ।
এথনিক মাইনরিটি কমিউনিটি থেকে উঠে আসা ৪৫ বছর বয়স্ক পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সাদিক খান পেশায় একজন মানবাধিকার সলিসিটর। গত ১১ বছর ধরে লন্ডনের টুটিং নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্বাচিত এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এই লেবার নেতা লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের বর্ণবাদী মামলা এবং ইসলাম ধর্মীয় নেতা লুইস ফারাখানের যুক্তরাজ্যে নিষিদ্ধকরণ মামলায় আইনি লড়াইয়ে প্রতিনিধিত্ব করে অনেক আলোচিত হয়েছিলেন। সাউথ লন্ডনের হাউজিং এস্টেটে বেড়ে ওঠা একজন বাসচালকের সন্তান সাদিক খান তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে শ্যাডো জাস্টিস সেক্রেটারি, যোগাযোগ এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। সাবেক মেয়রের মতো ধনীদের মেয়র নন বরং লন্ডনের সব শ্রেণীর মেয়র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান তিনি।
নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর মাঝরাতে তার বিজয়ী ভাষণে বলেন, ‘ভয় আমাদের নিরাপদ করে না। এটা কেবলই আমাদের দুর্বল করে। ভয়ের রাজনীতিকে লন্ডন কখনো স্বাগত জানায় না।’ ধনী-গরিব, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী, শ্বেতাঙ্গ-অশ্বেতাঙ্গ সব মানুষের মেয়র হওয়ার ঘোষণা দেন তিনি।
তার নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে অন্যান্য বিষয়ে মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে পরবর্তী চার বছর লন্ডনের যোগাযোগ খরচ বৃদ্ধি না করা, আশি হাজার নতুন বাড়ি তৈরি করা যার মধ্যে পঞ্চাশ শতাংশ হবে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। এই নির্বাচনী ইশতেহারের পাশাপাশি তার ব্যক্তি ইমেজ ও রাজনৈতিক ক্যারিশমা ছিল এই নির্বাচনের মূল অস্ত্র। প্রথম সত্য হলো সাদিক খান কোন ইসলামী দল থেকে নমিনেশন নিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন নাই। দ্বিতীয়ত মুসলমান হিসাবে ভোট প্রার্থনা করেছেন বলেও কোন সংবাদ চোখে পড়েনি। বরং তাঁকে বারবার প্রমাণ করতে হয়েছে তিনি যতোটা না ইসলামী তার চেয়ে বেশি সর্বসাধারণের নেতা।
যদিও প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন এবং তাঁর দল কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থী জ্যাক গোল্ডস্মীথ নির্বাচনী প্রচারণায় বার বারই সাদিক খানকে উগ্রবাদের সাথে সংশ্লিষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। বলছেন, সাদিক খানের হাতে লন্ডন কখনো নিরাপদ হতে পারে না। কনজারভেটিভ দলের এমন আচরণ তীব্র সমালোচনার শিকার হয়েছে। কিন্তু নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসছে না টোরি পার্টি। পার্লামেন্টে একজন এমপি সাদিক খানকে নিয়ে করা মন্তব্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জবাবে ক্যামেরন বলেছিলেন, একবার নয় আমি বার বার বলবো যে, সাদিক খান উগ্রবাদীদের সাথে একমঞ্চে বক্তব্য দিয়েছেন। ক্যামেরনের এমন বক্তব্যে ক্ষিপ্ত হয়ে কয়েকজন এমপি তাঁকে বর্ণবাদী বলে চিৎকার করে উঠেন। ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলের প্রতি এমনও অভিযোগ আছে যে, সাদিক খান পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত মুসলিম হওয়ার কারণে জ্যাক গোল্ডস্মিথ শিবির লন্ডনে বসবাসরত ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের কাছে পাকিস্তান ও মুসলিম বিরোধী চেতনা উস্কে দিতে চেয়েছিলেন । একইভাবে জুইশদেরও সাদিক খানের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু কিছুই কাজে আসে নাই । সাদিক খান কয়েক লক্ষ ভোট বেশি পেয়ে নগরপিতার পিতার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
সাদিক খান, তার বোন জামাই মকবুল জাবিদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন ২০১১ সালে। যার বিরুদ্ধে উগ্রবাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছিল। গত ফেব্রুয়ারিতে ইভনিং স্ট্যান্ডার্ডের এক প্রতিবেদনে মকবুল জাবিদের সাক্ষাৎকার ও প্রচার করে এবং সাদিক খানের সাথে কোন ধরণের যোগাযোগ আছে কিনা সেই প্রশ্নও করেছিল। মকবুল জাবিদ অস্বীকার করেছেন যে সাদিক খান বা তার পরিবারের সাথে তার কোন ধরনের যোগাযোগ নাই।
লন্ডন সিটিতে বসবাসরত মোট জনসংখ্যার ১ মিলিয়ন মুসলমান ভোটার। শুধু মুসলমানের ভোটে অবশ্যই তিনি নির্বাচিত হন নাই। কিন্তু কেন জানিনা এশিয়ান গণমাধ্যম থেকে শুরু করে পশ্চিমা গণমাধ্যমও তাঁকে মুসলমান মেয়র হিসাবে পরিচয় করিয়ে দিতে উদগ্রীব।
যেখানে কনজারভেটিভ এর ধর্মীয় নির্বাচনী প্রচারণার বিপরীতে বলেছিলেন সাদিক খান বলেছিলেন লন্ডন, আমেরিকা নয়। এই শহরে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতি মানুষ গ্রহণ করবে না। কনজারভেটিভ দল লন্ডন মেয়র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সমাজে বিভাজন এবং ভীতি তৈরি করছে। নিজের রাজনৈতিক আদর্শকে সার্বজনীন এবং লন্ডনের বাসিন্দাদের জন্য কল্যাণকর বলে উল্লেখ করে সাদিক খান তিনি বলেন, কনজারভেটিভ দল নীতির চাইতে ব্যক্তিগত আক্রমণ আর ধর্মীয় পরিচয়কে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। টোরি দলের এমন নোংরা নীতি লন্ডনের ভোটাররা প্রত্যাখ্যান করবে। তাঁর ধারনাই সত্যি হয়েছে। লন্ডনের ভোটাররা একজন অশ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘুকে তাঁদের মেয়র হিসাবে নির্বাচিত করেছেন।
ব্রিটিশরা যতো বেশী বর্ণবাদী তার থেকে, আমাদের মাঝে বর্ণবাদ আরও প্রকট। বহু বর্ণের সমাজে বসবাস করে যাবতীয় সুযোগ সুবিধা ভোগ করার পরও আমরা বিশেষ করে এশিয়ানরা এই বর্ণচোরা রূপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। প্রথমেই আমরা মূল্যায়ন করি সাদা না কালো না এশিয়ান, এশিয়ান হইলে কোন দেশি বাংলাদেশ না পাকিস্তান নাকি ইন্ডিয়ান, বাংলাদেশ হইলে আবার সিলেটী না নন সিলেটী? সিলেটী হইলে আবার হিন্দু না মুসলমান? এর পরেও আরও আছে বিশ্বানাথী বা বিয়ানীবাজারী, জগন্নাথপুরী না বালাগঞ্জী এইসব পরিচয় বা সম্পর্কে গিয়ে শেষ হয় আমাদের বর্ণবাদ।
সাদিক খান এর মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর, পাকিস্তানে তাঁকে নিয়ে খুররাম জাকি নামী এক ব্লগার তাঁর ফেসবুকে লিখেন, ইসলামের নামে জঙ্গিবাদের এই সময়ে সাদিক খানকে মেয়র নির্বাচিত করে লন্ডন বিশ্বের সামনে উত্তম মানব সভ্যতার উদাহরণ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছে, ‘আমারা কি একজন আহমাদি বা হিন্দু বা খ্রিস্টানকে প্রধানমন্ত্রী করতে পারব? সেটা ভুলে যান, আমরা বরং বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম শহরের (করাচী) গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত মেয়রের হাত থেকে সব ক্ষমতা ও সুবিধা নিয়ে নিয়েছি তার জাতিগত পরিচয়ের কারণে।’ সাদিক খান পাকিস্তানি নন। তিনি একজন ব্রিটিশ। তার উন্নতি ও সাফল্যের কৃতিত্ব তার নিজের কঠোর পরিশ্রম এবং সবাইকে সমান সুযোগ দেয়া ব্রিটিশ ব্যবস্থার ওপর যায়। এখানে পাকিস্তান বা ইসলামের কোনো কৃতিত্ব নেই। ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হলেন পাকিস্তানের মানবাধিকার কর্মী এবং অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট খুররাম জাকি।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের থেকে খুব একটা ভালো অবস্থানে নাই। বাংলাদেশে এই প্রথম কোন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ প্রধান বিচারপতি হয়েছেন। এর বিপক্ষে রাজপথে রীতিমত মিছিল হয়েছে। সংবাদ সম্মেলন করে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছে। যদিও তা সংখ্যায় খুবই কম। কিন্তু তাঁদের প্রতিহত করতে কিংবা এদের বিরুদ্ধে কেউ রুখে দাঁড়ায়নি। পৃথিবীর অন্য কোথাও এমন উদাহরণ আছে বলে জানা নেই।
ব্রিটেন ফার্স্ট কিংবা বিএনপি ও ইডিএল এর মতো উগ্রবাদীদের বিপক্ষে, বারবার সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়িয়েছে ব্রিটেনের মানুষ। সাদিক খানের বিজয়ে মূলত বর্ণবাদের পরাজয় ঘটেছে লন্ডনে। সেখানে বারবার মুসলিম মেয়র বলে বলে ধর্মীয় বর্ণবাদকেই যেন উসকে দেয়া হচ্ছে।
সাদিক খানের বিজয় কোন ধর্মীয় বিজয় নয়, সংখ্যালঘু অভিবাসীদের বিজয়। উদার গণতন্ত্রের বিজয়। ধনী-গরিব, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী, শ্বেতাঙ্গ-অশ্বেতাঙ্গ এমনকি সমকামীদের অধিকারকে সমর্থন করা একজন। ধর্ম নিরপেক্ষ মানুষকে ধর্মীয় বৃত্তে বেঁধে ফেলার উদগ্রীবতাই যেন পরিলক্ষিত হচ্ছে।
লন্ডন মেয়র সাদিক খানের বিজয়গাঁথাটি অন্য রকম গল্প হতে পারে, অনুপ্রেরণার গল্প হতে পারে। অভিবাসী সংখ্যালঘুদের জন্য কিংবদন্তীর গল্প হতে পারে। কিন্তু ভয় হয় , বর্ণবাদী উন্মত্ততায় একসময় সেটি উগ্রবাদী রূপ ধারণ করে কিনা। এই বিজয়গাঁথা দ্বিতীয় টাওয়ার হ্যামলেট কাহিনীর পুনরাবৃত্তি হয় কিনা ।অনেকেই বলেন অতি মুসলমানির কারণেই বাঙালি বংশোদ্ভূত নির্বাচিত মেয়র লুতফুর রহমান বিদায় নিতে হয়েছিল বড় অসন্মানজনকভাবে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য