আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

আইএসের আগুনেই জ্বলবে তুরস্ক

বিজন সরকার  

সিরিয়া ও ইরাকে আইএস সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নির্বাচনের পরপরই আইএসের ভবিষ্যৎ কি হবে তা নির্ধারণ হয়ে যাবে। হোয়াইট হাউজে ডোনাল্ড ট্রাম্প গেলে আইএসকে রাশিয়ার সাথে কৌশলগত সমন্বয় রেখে সিরিয়া ও ইরাক থেকে আইএসকে সরিয়ে দেওয়া হবে।

যদি হিলারি ক্লিনটন ক্ষমতায় যায়, তবে এই ক্ষেত্রে আইএসকে সরাতে সময় লাগবে। আইএস বিষয়ে হিলারির সম্ভাব্য প্রশাসনের স্বতন্ত্র কোন ভূমিকা না থাকার জোর সম্ভাবনা রয়েছে। মার্কিন সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে গালফ নেশন’স গুলি দেওয়া প্রায় পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলার অনুদান ক্লিনটন পরিবার নিয়েছে; সেটি হিলারিকে সিদ্ধান্ত প্রদানকারী নয়, সিদ্ধান্ত পালনকারী করে রাখবে। হিলারি ক্ষমতায় গেলে বাশার আল আসাদকে সরানোর জন্য আইএসকে ব্যবহারের শেষ চেষ্টা চলবে।

আইএসের সামরিক শক্তি এখন ক্ষয়িষ্ণু। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরের ৩০ তারিখ থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত কেবল রাশিয়ার হামলায় আটাশ হাজার আইএস যোদ্ধা খতম, এমনটিই জানিয়েছেন রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার ডেপুটি প্রধান। পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাশিয়া হামলা পরিচালনার আগে সিরিয়া ও ইরাকে আইএস, আল নুসরা সহ সকল জঙ্গি সংগঠনগুলির মোট জঙ্গির সংখ্যা ছিল আশি হাজার।

অপরদিকে পেন্টাগনের দাবী, তারাও আইএসের প্রায় পঁচিশ হাজার যোদ্ধাকে খতম করেছে। তবে খতমের সংখ্যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে তারতম্য থাকলেও আইএসের অর্ধেক যোদ্ধা রাশিয়া, আমেরিকা ও আসাদ সরকারের বাহিনীর দ্বারা খতম হয়েছে, এই ব্যাপারে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাগুলি নিশ্চিত।

এমতাবস্থায় আইএস দ্রুতই দখলকৃত এলাকা হারাচ্ছে। আইএসের উপর গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান আইএইচএস এক রিপোর্ট উল্লেখ করেছে, ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে আইএসের এলাকা পঁয়ত্রিশ হাজার বর্গ মাইল ছিল। বর্তমানে এটি ছাব্বিশ হাজার তিনশত বর্গমাইলে নেমে এসেছে। গত জুন মাসেই ইরাকের সেনাবাহিনী আইএসের হাত থেকে ফালুজাকে মুক্ত করল।    

আইএসের অর্থের কয়েকটি উৎস রয়েছে। গালফ নেশন’সগুলির সরকার ও ব্যক্তি পর্যায় থেকে বিশাল অংকের পেট্রো ডলার অনুদানে গঠিত হয় আইএসের অর্থনীতির প্রাথমিক কাঠামো। পরবর্তীতে আইএস খেলাফত সম্প্রসারণ করে দখলকৃত এলাকা থেকে ব্যাংক লুটের টাকা ও আইএস এলাকাতে বসবাসকারী বিয়াল্লিশ লক্ষ বাসিন্দাদের কাছে থেকে আদায়কৃত কর ও জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করে নিজেদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে। প্রসঙ্গত, আইএস সিরিয়া ও ইরাক থেকে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ব্যাংক থেকে লুট করেছে; এই তথ্য দিয়েছেন  মার্কিনী ট্রেজারের প্রাক্তন জঙ্গি অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ জনাথন সানজার। তুরস্ক সরকার নিয়ন্ত্রিত তেল ব্যবসায়ীদের কাছে আইএস তেল বিক্রি করেও অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছে।

আইএস যতক্ষণ না পর্যন্ত গালফ নেশন’সগুলির জন্য হুমকি ছিল, ততক্ষণ পর্যন্ত সরকারগুলি বিভিন্ন চ্যানেলে আইএসের জন্য অনুদান হিসাবে পেট্রো ডলার দিয়েছে। পরবর্তীতে আইএস যখন গালফ নেশন’স গুলির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ালো এবং সরকারী অনুদানের বিষয়টি পশ্চিমা গোয়েন্দা ও বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমে চলে আসল, তখন থেকেই সরকারি পর্যায়ের অর্থনৈতিক সহযোগিতা বন্ধ করে দেওয়া হল। তবে এখনো গালফ নেশন’সগুলির ব্যক্তি পর্যায় থেকে আইএসের জন্য অনুদান যাচ্ছে।

তুরস্কের কাছে তেল বিক্রি করে আইএস যে প্রতিদিন দেড় মিলিয়ন ডলার আয় করত, সেই আয়ের পথটি রাশিয়ার বিমান হামলায় শেষ হয়ে যায়। আইএসে বসবাসকারী সাধারণ মানুষও আগের মত কর দিতে পারছে না। এমতাবস্থায় আইএস সেনাদের ও অন্যান্য সেবামুলক প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন অর্ধেক করে দিয়েছে বলেও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা নিশ্চিত করেছে। বলা যায়, আইএসের অর্থনীতি আগের মত নেই।

আইএস রাজনৈতিকভাবেও দুর্বল হয়ে পড়েছে। সংগঠনটি বহিরাগত ও অভ্যন্তরীণ, উভয় দিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আইএস নির্মাণের উদ্দেশ্যেই ছিল বাশার আল আসাদকে সরানোর জন্য। তবে আইএস সংগঠনকে হাতে রাখা যায়নি। ফলে গালফ নেশন’স ও পশ্চিমা বিশ্ব সংগঠনটির কার্যক্ষম নানান দিক দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা চালায়। আইএসের রিক্রুটমেন্ট পদ্ধতিগুলিতে গোয়েন্দা নজরদারি ও ডি-রেডিকালাইজেশন পদক্ষেপের ফলে সমাজে, বিশেষ তরুণ প্রজন্মের আইএসের প্রতি বাড়ন্ত প্রবণতা কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত হয়।  

যখনই সিরিয়া ও ইরাকে আইএস নিজেদের কর্তৃত্ব হারাতে থাকল, তখনি সংগঠনটি প্রথা-বহির্ভূত পথে নাশকতা চালাতে শুরু করল। বিশেষ করে ফ্রান্স ও জার্মানিতে যে হামলাগুলি হয়েছে, এটি আই-এসের নাশকতার নতুন রূপ। আই-এসের ‘লোন উলফ অ্যাটাক’ এখন বিশ্বের শক্তিশালী নিরাপত্তা বাহিনীর দুশ্চিন্তার কারণ। বিশ্বব্যাপী আইএসের নেটওয়ার্ক থাকায় নাশকতা যে দেশে ঘটবে সেই দেশ থেকেই আত্মঘাতী জঙ্গিকে রিক্রুট করা হয়। এতে খরচও কম। ব্রাসেলসে হামলা চালাতে আইএসের মোট খরচ হয়েছিল দশ হাজার থেকে পনের হাজার ডলার।

অধিকন্তু, নিষ্পাপ মানুষদেরকে হত্যা করার ফলে আইএসের ভিতরেও অস্থিরতা বিরাজ করছে। আইএসের অনেক যোদ্ধারা, বিশেষ করে বিদেশী সেনাদের অনেকেই এই নতুন নাশকতার রূপের কারণে আইএস ছেড়ে দিচ্ছে। এমতাবস্থায় আইএস রাজনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকের মতে, আইএস আগামী বছর দুয়েকের মধ্যেই দখলকৃত এলাকা হারাবে। আমেরিকার সাধারণ নির্বাচনের পরেই আইএসের উপর পশ্চিমা বিশ্বের গৃহীত পদক্ষেপ গুলি স্পষ্ট হবে। ইতোমধ্যে মার্কিন প্রতিরক্ষা সেক্রেটারি অ্যাশ কার্টার জানিয়েছেন যে আইএসের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য সহযোগী দেশ ও গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আইএস এলাকা হারালেও সারাবিশ্ব ব্যাপী ছড়িয়ে পড়া আইএসকে নির্মূল করা সম্ভব নয়।

জনাথন সানজার নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন,“You can defeat ISIS in ISIS-controlled territories, but you’re not going to defeat ISIS itself. The ideology of jihadism continues to evolve and continues to exist.”

আইএসকে সিরিয়া ও ইরাক থেকে সরিয়ে দিলে আইএসের যোদ্ধারা কোথায় যাবে? আইএসের সকল সেনাকে খতম করা সম্ভব নয়। বিদেশী সেনাদের, বিশেষ করে উন্নত বিশ্ব ও যে সকল দেশের রাজনীতি আইএস বান্ধব নয় সেই দেশ থেকে আগত যোদ্ধাদের দেশে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

আর এখানেই রয়েছে আসল খেলার কার্ড। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া তুরস্কের মিলিটারি ক্যু আসল ক্যু নয়, এই ক্যুর মধ্যে দিয়েই আসল ক্যু শুরু হবে। তুরস্ক দীর্ঘদিন যাবত ন্যাটোর সাথে রাশিয়ার দ্বন্দের প্রেক্ষাপট নির্মাণ করতে চেয়েও ব্যর্থ হয়। উগ্রপন্থী প্রেসিডেন্ট তাইপ এরদোগান যে পরিমাণ চতুর রাজনীতি করতে চেয়েছেন, ঠিক সেই পরিমাণ ধরাও খেয়েছেন। বলা যায়, চারপাশ থেকে তাঁকে আটকানোর নতুন জাল ফেলা হয়েছে।

তিনটি কারণে তাইপ এরদোগানের সাথে পশ্চিমা বিশ্বের আন্ত-বিশ্বাস তলানি রয়েছে।
প্রথমত: তাইপ এরদোগান সালাফিজম মতাদর্শের রাজনীতিবিদ এবং একজন নব্য সুলতান হিসাবেই আবির্ভূত হয়েছেন। এরদোগানের হাত ধরেই তুরস্কে ধর্মীয় উগ্রবাদের প্রসার ঘটছে। আজকের তুরস্কে যে সেকুলারিজম বনাম উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের চিরায়ত দ্বন্দ চলছে, এটির আধুনিক নির্মাতাই এরদোগান। ১৯২০ সাল থেকে তুরস্কের কোন রাষ্ট্র ধর্ম নেই, এরদোগান সেটি আনতে চাচ্ছেন।

এরদোগানের জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির সদস্য ও সংসদের স্পিকার ইসমাইল কারামেহন ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘তুরস্ক একটি মুসলিম দেশ। এখানে সেকুলার সংবিধানের কোন স্থান থাকতে পারে না’। ইসমাইলের ঘোষণার পরের দিনেই তুরস্কের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আহমেদ দাভুতুগলি ইসমাইলের দাবিকে নাকচ করে দেন। ঠিক একমাস পরেই আহমেদ দাভুতুগলিকে প্রধানমন্ত্রীর পথ থেকে ইস্তফা দিতে হয়। আহমেদ দাভুতুগলির পদত্যাগের তিনটি কারণের মধ্যে একটি ছিল জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্টের নেতৃত্বে তুরস্কে ধর্মীয় উগ্রবাদের উত্থান মেনে না নেওয়া। বাকী দুটি হল সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার প্রচেষ্টাকে স্বাগত না জানানো ও আহমেদ দাভুতুগলিকে অতিমাত্রায় পশ্চিমা পন্থী হিসাবে সন্দেহ করা।

আমেরিকা ও ইউরোপের রাজনৈতিক সমাজ এরদোগানকে একজন ইসলামিক উগ্র-বান্ধব রাজনীতিবিদ হিসাবেই গণ্য করে। এরদোগান যে তুরস্কের নতুন সুলতান এবং তাঁর হাত ধরেই যে তুরস্ক এই উগ্র ধর্মরাজ্যে পরিণত হচ্ছে তা বহির্বিশ্ব ভাল করেই ওয়াকিবহাল।

দ্বিতীয়ত: শরণার্থীকে ইস্যুকে ব্যবহার করে তাইপ এরদোগান পশ্চিমা বিশ্বকে অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিকভাবে ব্যাক-মেইল করছেন। সিরিয়া, ইরাক ও লিবিয়া সহ এশিয়ার অন্যান্য এলাকা থেকে শরণার্থীর স্রোত মোকাবেলার জন্য ইউরোপ বহুলাংশে তুরস্কের উপর নির্ভরশীল। শরণার্থীরা তুরস্ক হয়ে গ্রিস দিয়েই ইউরোপে প্রবেশ করে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন চাচ্ছে, শরণার্থীদের তুরস্কতেই আটকিয়ে দিতে। শরণার্থী সমস্যাকে মোকাবেলায় জন্য ইউরোপ আরও ছয় বিলিয়ন ইউরো তুরস্ককে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে তুরস্কের দাবী আরও দীর্ঘ। তুরস্ক  ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য পদ ও সেনজেন ভিসার আওতায় যেতে যাচ্ছে। এরদোগান যে সারা ইউরোপ ব্যাপী উগ্রবাদ রপ্তানি করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন তা কেবল পশ্চিমা গোয়েন্দারা নয়, সাধারণ জনগণও বুঝে গেছে।

তৃতীয়ত: এরদোগান ন্যাটোর সদস্য পদকে কাজে লাগিয়ে রাশিয়ার সাথে পশ্চিমা বিশ্বের যুদ্ধ লাগানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। গত বছরের নভেম্বরের ২৪ তারিখ সিরিয়ার লাতাকিয়ার আকাশে চক্কর দেওয়া রাশিয়ার সু-২৪ বিমানটি ভুল করে তুরস্কের আকাশে প্রবেশ করার জন্য ভূপাতিত করা হয়। সেখানে সেটি ছিল মাত্র ১৭ সেকেন্ড। বিমান ভূপাতিতের পর কাল বিলম্ব না করে ন্যাটোতে চলে যায় তুরস্ক। আমেরিকার বহু সামরিক ও বেসামরিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা তুরস্কের দুরভিসন্ধিমূলক রাজনীতির বিষয়ে ন্যাটোর প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রকে সতর্ক করে দেয়।

রাশিয়ার বিমান ভূপাতিত করার জন্য রাশিয়ার কাছে তুরস্ক ক্ষমা না চাওয়ায় ভ্লাদিমির পুতিন তুরস্কের উপর রাশিয়ার পর্যটকদের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ফল শ্রুতিতে তুরস্কের সমুদ্র তীরবর্তী এলাকার পর্যটন শিল্পে ধস নামে। ব্যবসায়ী সমাজের চাপে প্রেসিডেন্ট এরদোগান রাশিয়ার কাছে গত মাসে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়। তবে, ভূ-রাজনৈতিক কারণে রাশিয়ার সাথে তুরস্কের যে আন্ত-বিশ্বাস নির্ভর সম্পর্ক ছিল, সেটি আগের জায়গায় নেওয়া সম্ভব নয়। যদিও ক্যুর পরে এরদোগান আগামী আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে রাশিয়া ভ্রমণ করতে যাচ্ছেন।

তুরস্ক যে খেলা পশ্চিমা বিশ্বের সাথে বহুমাত্রিক ভাবে খেলতে চাচ্ছিল, তা পশ্চিমাদের লেন্সে ঠিকও ধরা পরে যায়। রাশিয়াও তুরস্কে বিশ্বাস করছে না। সৌদি আরবের পরেই তুরস্ক দ্বিতীয় রাষ্ট্র হিসাবে বাশার আল আসাদদের সরে যাওয়ার বিষয়ে শক্ত অবস্থান নিয়েছিল।

আইএস সিরিয়া ও ইরাক থেকে সরে গেলে তুরস্কে অবস্থান নিবে বলেই বিশেষজ্ঞদের মতামত। বিশেষজ্ঞদের মতামতের পিছনে অনেকগুলি বাস্তব কারণ রয়েছে।

প্রথমত: এরদোগান নিজের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য বিরোধী দল গুলির উপর নির্যাতনের বুলডেজার চালিয়েছেন। গত এক দশকের মধ্যেই এরদোগান তুরস্ককে নানান দলে উপদলে বিভক্ত করেছেন। গত বছর বাংলাদেশের ২১ আগস্টের ন্যায় এরদোগান সরকারের ছত্রছায়ায় কুর্দি ও বাম ঘরানার রাজনৈতিক দলের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ বোমা হামলা করা হয়। এতে পঁচানব্বই জন মারা যায়। আহত হয় কয়েকশত।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক রিপোর্টে বলা হয় কেবল এরদোগানের সমালোচনার কারণে ২০১৪ সালের আগস্ট মাস থেকে এখন পর্যন্ত ১৮২৫ মামলা রজ্জু করা হয়। এই সমালোচনার শান্তি ন্যুনতম চার বছরের জেল। গণমাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করা নিষিদ্ধ।বাশার আল আসাদকে সরানোর জন্য এরদোগান সরকার সিরিয়ান আর্মিকে অস্ত্র দিচ্ছে প্রমাণ সহ প্রতিবেদন প্রকাশ করার পর তিন সাংবাদিকের যাবত জীবন জেল দেওয়া হয়েছে।

সেনাবাহিনীর ভিতরে বড় একটি অংশ এরদোগান উগ্র-বান্ধব রাজনীতি মানতে নারাজ। এই ক্যু টি ব্যর্থ হয়েছে, তবে ক্যুর সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়নি। এখন পর্যন্ত পঞ্চাশ হাজার সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাকে জেলে দেওয়া হয়েছে। সরকারের ভিতরে ও বাইরে বহু গোষ্ঠী অপেক্ষায় আছে এরদোগানের মত নব্য সাদ্দাম হোসেনকে সরানোর। তুরস্কে এই অকার্যকর রাজনীতি আইএসের প্রবেশকে স্বাগতই জানাবে।

দ্বিতীয়ত: কুর্দিরা স্বাধীনতা চাচ্ছে। কুর্দি ফ্রিডম হউক ও কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির সমান্তরালে আইএসও তুরস্কে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এরদোগান যতই কঠোরভাবে কুর্দিদের দমন করতে চাচ্ছেন, ঠিক ততই কুর্দি স্বাধীনতা কামীরা শক্তিশালী হচ্ছেন।

তুরস্ক সিরিয়ায় বহুজাতিক বাহিনীর হামলা শুরুর পর থেকেই অভিযোগ করে আসছে যে আমেরিকা সিরিয়ান কুর্দিদের সামরিক সহযোগিতা দিয়ে আসছে। এরদোগান আমেরিকাকে বলছেন সিরিয়ার কুর্দি সংগঠন কুর্দিস পিপলস’ প্রোটেকশন ইউনিট (YPG) ও সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন পার্টি  (PYD) জঙ্গি সংগঠন। এই দুটি সংগঠনের সাথে তুরস্কের কুর্দি স্বাধীনতাকামী সংগঠনগুলির নীরব যোগাযোগ রয়েছে। এরদোগান স্পষ্ট করে জানিয়েছেন হয় আমেরিকা আমাকে বেছে নিতে হবে, না হয় কুর্দি সন্ত্রাসীদের (তাঁর ভাষায়) বেছে নিতে হবে। সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে জেনেভাতে অনুষ্ঠিত বহুজাতিক আলোচনায় তুরস্কের আপত্তির কারণে PYD কে আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।

তবে আমেরিকা এরদোগানের কথার তেমন গুরুত্ব দেয়নি। আমেরিকার প্রতিনিধি ব্রেট মেক জেনেভাতে সম্মেলন চলাকালীন সময়ই সিরিয়ার কুবে শহরটিকে আইএসের কাছ থেকে দখল মুক্ত করার পরপরই সেখানে যান। তাঁকে কুর্দি একজন জেনারেল গার্ড অব অনার দেন। মেক কুর্দি সেনাদের সাথে আলাপ আলোচনা করেন।  

ফলে আমেরিকা এরদোগানের ইচ্ছা ও রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার সমান্তরালে নেই এটি দৃশ্যত প্রতীয়মান হচ্ছে। বরং আমেরিকা এরদোগানের ভূ-রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছে। কেবল আমেরিকা কেন ইউরোপের প্রতিটি দেশই কুর্দিদের স্বাধীনতার বিষয়ে সরাসরি কিছু না বললেও মৌন সমর্থনটি ভাল করেই বোধগম্য। ফলে তুরস্ক দেশটির স্বাভাবিক স্থিতিশীলতা রাস্তা হারিয়ে সিরিয়ার ন্যায় অস্থিতিশীলতার কাছে চলে যে এসেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।   

তৃতীয়ত: তুরস্কের শরণার্থী শিবিরগুলিতে আইএস জঙ্গিরাও অনুপ্রবেশ করেছে। তুরস্ক আইএসের প্রতিবেশী এবং আইএসে প্রবেশ করতে তুরস্ক দিয়েই যেতে হয়। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার ধারনা, আইএসের বহু উপরের স্তরের সদস্য যারা বিভিন্ন সিদ্ধান্তসহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে করে, তাদের অনেকেই তুরস্কে অবস্থান করছে।হামলা করে সিরিয়া ও ইরাক ভিত্তিক আইএসকে ধ্বংস করে দিলেও তাদের থিঙ্কিং ট্যাংক যেন ঠিক থাকে সেই উদ্দেশ্যেই। তাছাড়া আইএসের সাথে তুরস্কের বহু-গোষ্ঠীর বহুমাত্রিক সম্পর্ক রয়েছে। আদর্শিক, ধর্মীয়, কালচারাল এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিবিড়।

আইএসকে সিরিয়া ও ইরাক থেকে সরিয়ে দিলে আইএস সেনাদের প্রাথমিক নিরাপদ স্থান হবে তুরস্ক। আরব বিশ্বের আইএস সেনারা তুরস্কে অবস্থান করলে তাদের নিরাপত্তার ঝুঁকি কম। আইএসে মোট সেনার চারভাগের একভাগ সৌদির নাগরিক। যদি আইএসের সৌদি যোদ্ধারা তুরস্কের আশ্রয় নেয় এবং নাশকতা করে, তুরস্কের সরকারের তেমন কিছুই করার থাকবে না।

তাছাড়া, তুরস্ক থেকে ইউরোপ ও আমেরিকাতে অপারেশন চালাতেও খুব সুবিধা হবে। দেশটির ভিতরে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও আইএসের অনুকূলে। আইএস যদি কুদিদের উপর নাশকতা চালায়, এরদোগান খুশিই হবেন। তবে এরদোগান যতই জঙ্গি-বান্ধব শাসক হোক, তার সরকার তাগুতি সরকার। আইএস যে কারণে বাসার আল আসাদকে মানতে পারেনি, ঠিক একই কারণে এরদোগানকেও মানবে না।

এরদোগান যেভাবে রাশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকাকে নিয়ে খেলতে চাচ্ছিলেন, তা আর সম্ভব নয়। যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে যায়, রাশিয়ার সাথে আমেরিকার দূরত্ব কমে আসবে বলেই বিশ্লেষকদের ধারনা। যদি তাই হয়, সিরিয়া ও ইরাক থেকে আইএস দ্রুতই সরে যাবে।

এমতাবস্থায় খুব সম্ভবত আইএসের দ্বিতীয় খেলাফতের স্বপ্ন হবে তুরস্ক।

বিজন সরকার, গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ