আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

তথ্য অধিকারে ‘নেকাব’

মাসকাওয়াথ আহসান  

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ প্রণয়ন দেখে অনুভূত হয়; সরকার ২০১৮ সালের বাস্তবতায় বসে ১৯১৮ সালের তামাদি শাসন কৌশল অনুসরণের চেষ্টা করছে। বৃটিশ শাসনে অফিশিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্ট বা দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইন প্রণীত হয়েছিলো। ঔপনিবেশিক অপশাসন চালিয়ে যাবার জন্যই জনগণের স্বার্থে পরিচালিত সরকারী দপ্তরের তথ্য জানার অধিকার থেকে জনগণকেই বঞ্চিত করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছিলো এই আইনের মাধ্যমে।

আজকের বাস্তবতায় সেই বৃটেনও আর বসে নেই সেই দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইনের বর্বর যুগে। রাইট টু ইমফরমেশান বা তথ্য জানার অধিকারকে যুগের চাহিদা ও বাস্তবতা হিসেবে মেনে নিয়েছে অপেক্ষাকৃত আধুনিক ও সফল গণতন্ত্রের দেশগুলো।

অতীতের একপেশে পলিটিক্যাল কম্যুনিকেশান বা রাজনৈতিক যোগাযোগের
চাপিয়ে দেয়া কৌশলগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে; ইন্টারনেট বিপ্লবের মাধ্যমে স্বচ্ছ যোগাযোগ মাধ্যম প্রতিষ্ঠিত হবার পর। এই স্বচ্ছ যোগাযোগ মাধ্যম আসলে গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আদায়ের মাধ্যম।

আজকের যুগে রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও জনগণের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হওয়াই সফল রাজনৈতিক যোগাযোগ কৌশল।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ নিঃসন্দেহে একটি ভুল রাজনৈতিক যোগাযোগ। এই আইনের ৩২ ধারায় যেভাবে "সরকারের গোপনীয় তথ্য ইলেকট্রনিক ডিভাইসে ধারণকে গুপ্তচরবৃত্তি"র অপরাধ হিসেবে শাস্তিযোগ্য করা হয়েছে; তাতে সরকারের রাজনৈতিক যোগাযোগের গ্রহীতা জনগণ যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণ; তাদের মনে এই ধারণা গভীরভাবে প্রোথিত হয় যে, সরকার স্বচ্ছতা বা জবাবদিহিতায় আগ্রহী নয়। বরং তারা দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা লুকিয়ে রাখতে মরিয়া। এই প্রচেষ্টায় রাষ্ট্রের জনগণ যার স্বার্থে সরকারী দপ্তর চলে, সে স্বচ্ছতা দাবী করলে তাকে "গুপ্তচর" বলে উইচহান্টিং বা চুপ করিয়ে দিতে উদ্যত সরকার।

যে সরকারের সুশাসন দেবার সামর্থ্য থাকে তার ঢাক ঢাক গুড় গুড়ের প্রয়োজন পড়ে না। যে জনপ্রতিনিধির নৈতিক দুর্বলতা নেই; তার লুকোনোর কিছু নেই। বর্ষীয়ান রাজনীতিক তোফায়েল আহমেদ যিনি পাকিস্তানের অগণতান্ত্রিক ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে লড়েছেন; তিনি বাংলাদেশের ক্ষমতা-কাঠামোর অংশ হিসেবে যখন বলেন, "সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট বন্ধ করতে ডিজিটাল আইন"; তখন এটা খুবই স্পষ্ট হয়ে ওঠে গণতান্ত্রিক মুক্তির প্রত্যাশা আজ অন্ধকারে বিলীন।

২০১৮ সালে যদি কেউ মনে করে, সে সাজিয়ে গুছিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জনগণকে যে তথ্য দেবে; জনগণ তাতেই সন্তুষ্ট থাকবে; তাহলে বুঝতে হবে সে বিটিভি যুগের বোকার স্বর্গে বসবাস করছে। অবশ্য তথ্য মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সম্প্রতি তাঁর 'বিশ্বাসে"র কথা বলেছেন, দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ বিটিভি দেখে।

তথ্য যুগে বসে তথ্য ঢেকে রাখার ইচ্ছা ও প্রাণান্ত চেষ্টার চেয়ে ভুল রাজনৈতিক যোগাযোগ কৌশল আর কীই বা হতে পারে!

সমসাময়িক পৃথিবীকে যোগাযোগবিদ মার্শাল ম্যাকলুহান "বিশ্বগ্রাম" বলেছেন; ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন পৃথিবীটি জুড়ে গিয়ে একটি একান্নবর্তী গ্রামে রূপান্তরিত হবার কারণেই। তরুণ প্রজন্ম ইন্টারনেটের গতিময়তায় চিন্তায় ও মননে বিশ্বনাগরিক। ফলে বাংলাদেশের তরুণ ক্যানাডা, জাপান বা জার্মানির রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয় ও গণতান্ত্রিক সুসংস্কৃতির দাবীটিই তুলবে নিজদেশের সরকারের কাছে। এ দাবী অগ্রাহ্য করলে সে দেশজ রাজনীতি ও গণতন্ত্রে আস্থা হারাবে। চিন্তার জগতে নিজদেশ তার কাছে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়াবে ক্রমশ।

যে কোন রাজনৈতিক যোগাযোগ কৌশল প্রস্তুতের সময় তরুণ ভোটারদের বিশেষ বিবেচনায় রাখতে হয়। আওয়ামী লীগ তার ২০০৮ সালের নির্বাচনী যোগাযোগ কৌশলে তরুণদের দুটো দাবীকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছিলো। একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচার ও ডিজিটাল বাংলাদেশ উপহার দেয়া। এতে করে তরুণ ভোটারদের বিপুল সমর্থন পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলো আওয়ামী লীগ।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আজ স্বীকার করে নিলেন, “এই যে ৫৭ ধারা যেটা ছিল, সেটার মধ্যে কোনো কিছু না করলেও আপনাকে আমি যদি পুলিশ হই আমি এটার মধ্যে ভরে দিতে পারব।" অথচ ৫৭ ধারা প্রচলনের সময় বাকস্বাধীনতা হরণের প্রতিবাদ নাকচ করে দিয়েছিলো সরকার পক্ষ। সুতরাং সাম্প্রতিক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি বাক-স্বাধীনতাহরণ করবে, এমন অভিযোগ সরকার এখন অস্বীকার করলেও ভবিষ্যতে সত্যটা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হবে যে, এই আইনের মধ্যে "যদি পুলিশ হই আমি এটার মধ্যে ভরে দিতে পারব" এরকম মানবাধিকার হরণের উপাদান রয়েছে।

২০০৮-এর তরুণের দাবী ছিলো ন্যায়বিচারের সংস্কৃতি আর ইন্টারনেটের বিশ্বসরণিতে গতিময় যাতায়াত, অবাধ তথ্যপ্রবাহ তথা ডিজিটাল স্বচ্ছতার সংস্কৃতি প্রচলন। এতদিন ৫৭ ধারার মানবতা বিরোধী আইনি চাবুক চালিয়ে; এখন আবার ২০১৮ সালে এসে ক্ষমতাসীন সরকার ডিজিটাল স্বচ্ছতার দাবী অগ্রাহ্য করে "তথ্য জানার অধিকার"-কে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নেকাব দিয়ে ঢেকে দিলে; খুবই অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংকেত যায় জনগণের কাছে।

জনগণের কাছে রাতারাতি অগ্রহণযোগ্য ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠার জন্য এরকম একটি ভুল সিদ্ধান্তই যথেষ্ট। যুগের তথ্যচাহিদা বিবেচনা করে জনপ্রত্যাশার সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে সরকার দ্রুত এই ভুল থেকে সরে আসার সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেবে বলে প্রত্যাশা রাখি।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ