আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

এটাও সাধারণ ঘটনা বলবেন?

ইমতিয়াজ মাহমুদ  

কিছু মৌলিক শর্ত থাকে যেগুলি আপনার খুনের ভেতর না থাকলে আপনাকে সভ্য মানুষ বলা যায়না। আপনি বাকপটু হতে পারেন, সুদর্শন হতে পারেন- কিন্তু সভ্য মানুষ হবেন না। এইসব শর্তের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি, এটি সম্ভবত সবচেয়ে পুরনোও, যে THOU SHALT NOT KILL. কথাটার মানে কী? আক্ষরিক অর্থটি তো আপনারা জানেনই, এর পুরো অর্থও আপনাদের জানা থাকার কথা। এই কথাটি ওল্ড টেস্টামেন্টে আছে, টেন কমান্ডমেন্টের অন্যতম কমান্ডমেন্ট এটা। বৌদ্ধ ধর্মের যে পঞ্চশিল রয়েছে তার অন্যতম শিল হচ্ছে এইটা। হাজার বছরের পুরনো এই নীতিটি এখন আমরা সকলেই মানি- ঠিক বলে মানি।

এই কথাটার অর্থ কী? যে মানুষ হত্যা করা যাবেনা। এটা সবচেয়ে বড় অপরাধ। আপনার রক্তের মধ্যে যদি ন্যুনতম সভ্যতার লেশ মাত্র থাকে, তাইলে আপনি হত্যা মাত্রই নিন্দা করবেন। বিনা প্রশ্নে বিনা কিন্তু তবে যুক্ত করে, হত্যা মানেই নিন্দার্হ কাজ। বিচার করে যখন মানুষকে শাস্তি দেওয়া হয়, তখনো দেখবেন কিরকম সতর্কতা অবলম্বন করা হয়, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী নিজে থেকে আপিল না করলেও রায়টি উচ্চ আদালতে পাঠানো হয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখার জন্যে। মানুষের প্রাণ বলে কথা। যুদ্ধ আর আদালতের রায়-জাতীয় ব্যাপার আলাদা, কিন্তু এছাড়া হত্যা মানেই ঘৃণিত কাজ।

এইজন্যেই দেখবেন, সভ্য মানুষ মাত্রই হত্যার নিন্দা করার জন্যে নিহতের পরিচয় দেখে না, তার চরিত্র দেখে না, তার রাজনৈতিক মতাদর্শ দেখে না। হত্যা মানেই অন্যায়। হত্যা মানেই নিন্দার্হ কাজ, হত্যা মানেই ঘৃণিত কাজ। আমি নিজেকে সভ্য মানুষ মনে করি। আমার জীবন যাপনে বিশ্বাসে রাজনীতিতে ভুল থাকতে পারে অন্যায় থাকতে পারে- সভ্যতার মৌলিক উপাদানগুলি তো আমার রক্তের মধ্যেই আছে। এজন্যে হত্যা দেখলেই আমি আমি আমার প্রতিবাদ প্রকাশ করি। সবসময় ফেসবুকে লেখা হয় না, সবসময় মিটিং মিছিলে বক্তৃতা দিয়ে বলা হয় না- কিন্তু হত্যা মাত্রই অন্যায় সেকথাটা বলি।


২১ আগস্টের যে মর্মান্তিক ঘটনা এটা যে কতোটা ঘৃণ্য ঘটনা সে নিয়ে কি আপনার মনে সন্দেহ আছে? না। থাকার কথা না। ৭৫-এর পরে এরকম মর্মান্তিক ঘটনা কি আর ঘটেছে? না। ঘটেনি। আওয়ামী লীগের লোকেরা সেদিন নিজেদের প্রাণ দিয়ে ওদের নেত্রীকে বাঁচিয়েছে। আক্ষরিক অর্থেই জেনে বুঝে মৃত্যু নিশ্চিত জেনে এগিয়ে গিয়ে স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে নিজেদের প্রাণ দিয়েছে নেত্রীকে বাঁচাতে। নাইলে সেদিন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা প্রাণে বাঁচতেন না।

এখন আপনি শেখ হাসিনাকে পছন্দ নাও করতে পারেন, অনেকেই করেন না। তাঁকে স্বৈরাচারী বলেন, সেটাও হয়তো জায়েজ আছে। গালি দেন ক্যারিকেচার করেন- সবই ঠিক আছে। কিন্তু তাঁর হত্যা চেষ্টাকে সমর্থন করবেন? না ভাই, দিস ইজ নট ডান। আপনি যদি আভাসে ইঙ্গিতে আচরণে এইরকম একটি হত্যাচেষ্টাকে একটি সাধারণ রাজনৈতিক ঘটনা হিসাবে চালিয়ে দিতে চান তাইলে আমার কী মনে হবে? বলেন কী প্রশ্ন উদয় হবে আমার মনে? তবে কি আপনি রাজনৈতিক কারণে হত্যা করাকে সমর্থন করেন?

আমি তখন কিঞ্চিৎ উৎসুক হয়ে আপনার ফেসবুক প্রোফাইলে পুরনো পোস্ট স্ক্রল করবো। করে যখন দেখবো যে গত এক দশকে কোন পনেরই আগস্টে আপনি একটিবারের জন্যেও সেই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের জন্যে দুঃখ দেখাননি। পোস্ট দিয়েছেন, সেখানে কখনো কখনো বঙ্গবন্ধু আর মওলানা ভাসানিকে সংগ্রামী নেতা ইত্যাদি বলেছেন। কিন্তু শোক? কভি নেহি। বিনা প্রশ্নে প্রতিবাদ, কভি নেহি। পনেরই আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনায় যদি আপনার শোক না আসে, তাইলে আপনাকে কী বলবো?

আরেকটু ভালো করে ঘেঁটে দেখি, না, আপনি তো দেশী বিদেশী অন্যায় হত্যাকাণ্ডের জন্যে বিভিন্ন সময় বেশ ভালোই শোক ও প্রতিবাদী পোস্ট লিখেছেন। খুঁজলে কয়েকটাতে আমার লাইকও পাবেন, বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের বেলায় আপনার শোক উড়ে হাওয়া হয়ে গেল?


স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত দিনগুলি দেখলাম- প্রায় সব দিনেই আপনার পোস্ট রয়েছে। কিন্তু ঠিক সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে না, আমাদের পক্ষে না। আচ্ছা যাক, সে নাহয় ছেড়েই দিলাম আজ, আরেকদিন ধরি।


একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলার রায় হয়ে গেল, এটা নিয়েও আমি আমার সেইসব বন্ধুদের কয়েকজনের স্ট্যাটাস পড়েছি ফেসবুকে। আমি লজ্জিত লজ্জিত এবং এতো লজ্জিত যে দ্বিতীয়বার সেখানে যেতে পারলাম না। ও ভাই, একটা দেশের সরকারের নিরাপত্তা সংস্থার লোক টেররিস্টদেরকে ব্যবহার করে দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দলের মুখ্য নেতাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছে, এটা আপনার কাছে একটা সাধারণ রাজনৈতিক ঘটনা মনে হয়? রিয়ালি? দেশের সরকার প্রধান, মন্ত্রী, সরকার প্রধানের পুত্র এরা সকলে এই স্কিমে কোন না কোনোভাবে কন্ট্রিবিউট করছে এটা আপনার কাছে সাধারণ রাজনৈতিক ঘটনা মনে হয়?

আজকে না হয় আপনার কাছে আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিস্ট মনে হচ্ছে, হোক- তার জন্যে আপনি আমার রাষ্ট্রের এইরকম অবনমন অধঃপতনকে মৌন সমর্থন দিবেন? এদেরকে নিন্দা করতে দ্বিধা করবেন?

কারা এরা? আপনি চিনেন। এরা জাতীয় সনদ আর নতুন সামাজিক চুক্তি নামক তামাশা নিয়ে মাঠে নেমেছে। তামাশা কেন বলছি? কারণ এইগুলি হচ্ছে রোজকার খবরের কাগজে বের হওয়া কিছু বাগাড়ম্বর এক জায়গায় জড়ো করে গালফোলানো নাম দিয়ে ভাব ধরা ছাড়া আর কিছু না। এইগুলিতে আসলে এই ভাইসাহেবদের অন্তঃসারশূন্যতা আর খুপরির ইয়ে ছাড়া আর কিছুই প্রকাশিত হয় না। এরাই হচ্ছে এইসব ভাইয়েরা। যারা এমনিতে বলবে 'জাতীয় ঐক্য' 'জাতীয় ছনদ' জাতীয় আরও কি কি- কিন্তু বঙ্গবন্ধু বা তাঁর কন্যার হত্যা বা হত্যা চেষ্টা যাদের কাছে কেবল একটি রাজনৈতিক ঘটনা।

কী বলবেন? হিপক্রেট? না। ওরা আসলে হিপক্রেট না। আপনি এই দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি- মুখ্য বাগাড়ম্বরবিদ- উনার ফেসবুক পোস্ট খুলে দেখেন। পড়তে থাকেন ধৈর্য ধরে সময় নিয়ে। এরা এইটাই। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতেও এরা আনন্দিত- আনন্দিত না হোক, দুঃখিত যে না সে তো স্পষ্টই। শেখ হাসিনা মরে গেলেও সম্ভবত এরা আনন্দিতই হতো। দেখবেন যে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অর্জন নিয়েও এরা সুযোগ পেলেই প্রশ্ন তুলবে।


আপনি লোককে পছন্দ নাও করতে পারেন। কিন্তু তাঁর খুনে আনন্দিত হবেন? শিরাজ শিকদারের কথাই ধরেন। আমি তাঁকে পছন্দ করি না। নানা কারণে করিনা। সেটা আলাদা কথা। কিন্তু তাঁকে যে বিনাবিচারে হত্যা করা হয়েছে আমি তাঁর নিন্দা করবো না? অবশ্যই করবো। কর্নেল তাহের। এই ভদ্রলোকের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও সমালোচনা দুইই আছে। কিন্তু তাঁকে যে প্রহসনের বিচারে হত্যা করা হয়েছে সেটা আমি ইগনোর করবো? আরে, জিয়াউর রহমান খুন, তাঁর হত্যার অভিযোগে জেনারেল মঞ্জুরের হত্যা- সবই মন্দ।

এইটুকু বোধ যদি না থাকে তাইলে আপনি কিসের মানুষ। আপনি তো তস্কর প্রকৃতির প্রাণি।

এইসব ক্লাউন নাকি বানাবে জাতীয় সনদ। মুখটা খারাপ করলাম না। শুধু এইটুকু বলে রাখি বিভ্রান্ত বাম থেকে উদ্ভ্রান্ত সুশীলে রূপান্তরিত এই সংঘটির ব্যাপারে সাবধান থাকবেন। পচা জিনিস যদি আরও পচে তাইলে ভয়ংকর হয়। আর জানেনই তো, ক্ষতি করার জন্যে বেশি ব্যাকটেরিয়া লাগে না, দুই চারটা হলেই হয়।

ইমতিয়াজ মাহমুদ, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ