আজ বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

মৌলবাদী সন্ত্রাসের পরোক্ষ যে উপাদান

খুরশীদ শাম্মী  

প্রতিটি মৃত্যু বিয়োগাত্মক ও বেদনাদায়ক। আর যদি কারো মৃত্যু হয় অস্বাভাবিকভাবে অন্য কোনো মানুষের হাতে, তখন সেই মৃত্যু হয়ে ওঠে খুব বেশি কষ্টকর ও অতি দুঃখজনক। আধুনিক যুগে, যখন কলেরা, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, গুটিবসন্তের মতো বিভিন্ন মহামারী রোগ প্রতিরোধ করে কোটি কোটি মানুষের জীবন বাঁচান সম্ভব হয়, সেই যুগে “মানুষের হাতে মানুষের মৃত্যু” তো মানুষের হৃদয়ের সংকীর্ণতা ও হিংস্রতার নিদর্শন ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। দুঃখজনক হলেও এটা সত্যি যে প্রতিদিনই বিশ্বের কোথাও না কোথাও মানুষের হাতে মানুষ জীবন হারাচ্ছে। তবে ধর্মের নামে মৌলবাদীদের হাতে নিরীহ মানুষদের জীবন হারাবার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। ধর্মের নামে পারস্পরিক কলহ ধর্ম শুরুর প্রথম থেকেই বেশ আগ্রাসী ও রক্তক্ষয়ী। দিনদিন তা’ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।

বর্তমানে সারা বিশ্বের কোথাও মানুষ আর নিরাপদ নয়। এমন কি মানুষ তার নিজের ঘর, কর্মস্থল, কিংবা ধর্মীয় উপাসনালয়েও নয়। আতঙ্কিত থাকে সবাই, সর্বদা। ধর্মের নামে একের পর এক সন্ত্রাসী হামলায় জীবন হারাচ্ছে নিরীহ জনগণ। নিষ্পাপ শিশুরাও বাদ পড়ছে না মানুষ রূপী হায়েনাদের ধ্বংসাত্মক থাবা থেকে। যখন ধর্মের ব্যানারে পথে ঘাটে, জনবহুল এলাকায়, প্রসিদ্ধ স্থানে, এমন কি ধর্মীয় উপাসনালয়েও সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়, তখন ধর্ম আপনা-আপনি প্রশ্নের মুখোমুখি হয়। তা’ সাধারণ মানুষের বুঝার ক্ষমতা থাকলেও ধর্মভীরুরা নিজেদের মনকে একবারও বুঝাতে চেষ্টা করেন না। বরং তারা বারবার বলে যান, "সন্ত্রাসীদের কোনো ধর্ম নেই। যারা মানুষ মারে তারা সন্ত্রাসী। তাদের পরিচয় সন্ত্রাসী ব্যতীত অন্য কিছু নয়"।

বুঝলাম ধর্মভীরুরা যুক্তির জোরে ধর্মের নামে নিরীহ মানুষ হত্যার মতন সন্ত্রাসী কার্যকলাপকেও শুধু সন্ত্রাস বলে চালিয়ে দিতে চাচ্ছেন। কিন্তু, এ কথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে মানুষে মানুষে বিভাজন প্রথম শুরুই হয়েছিল ধর্মের নামে। কেউ মূর্তি পূজা করলে মূর্তি ভেঙে দেয়া, ভিন্ন কোনো ধর্ম প্রচার করলে বাধা দেয়া, এবং বাহুবলে ভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসীদের মারার ইতিহাস যেমন আছে, আবার কেউ ধর্মে অবিশ্বাসী হলে, তাকে নাস্তিক উপাধি দিয়ে মেরে ফেলার ইতিহাসও তেমন আছে। এছাড়াও মন্দির, মসজিদ, গির্জাসহ সকল ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো ভাঙা ও জ্বালাবার ঘটনা তো ইতিহাসের প্রতি পাতায় খচিত রয়েছে। আর ওই অকল্যাণকর কাজগুলো প্রতিবারই কোনো না কোনো মৌলবাদী দ্বারা কিংবা ধার্মিকদের উস্কানিমূলক মন্তব্যের কারণে ধর্মভীরুদের দ্বারা সম্পন্ন হয়েছে। অথচ ধর্ম বিশ্বাসের অপরাধে অবিশ্বাসী অর্থাৎ নাস্তিকদের দ্বারা কোনো মানুষ মারা যায় না।

যারা কথায় কথায় বলে থাকেন, ধর্ম শান্তি আনে। তাদের কাছে অনুরোধ, দয়া করে যোগবিয়োগ করে মিলিয়ে দেখুন, এখনো কিন্তু ধর্ম বিভাজনের প্রধান বিষয় ছাড়া অন্য কিছু হতে পারেনি। উদাহরণ স্বরূপ, আমাদের মধ্যে যারা ধর্ম বিশ্বাস করি, তারা বাৎসরিক দানের অর্থ কিন্তু যার যার নিজের ধর্মের মৌলবিদের, ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় সংস্থা, কিংবা উপাসনালয়কে দিয়ে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে থাকি। অন্য ধর্মের মৌলবিদের কিংবা উপাসনালয়কে দেয়ার কথা কখনো ভাবিও না। আমাদের নিজেদের প্রয়োজন না মিটিয়েও দান করে থাকি মহান প্রভুর নামে, পুণ্য লাভের আশায়, কিন্তু সেই অর্থ কী কাজে ব্যবহৃত হয়, একবারও কি ভেবে দেখি? আমাদের দানের অর্থে কল্যাণকর কিছু হয় কিনা জানার প্রয়োজন বোধ করেছি?

ধর্মভীরুদের স্বতঃস্ফূর্ত দানের অর্থেই কিন্তু ইদানীং রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছত্রাকের মতো ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো গড়ে উঠছে। ব্যাঙের ছাতার মতো ধর্মীয় উপাসনালয় সৃষ্টির নেপথ্যের কারণ কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রমাণিত হয়েছে পরিচালকমণ্ডলী ও ধর্মযাজকদের পারস্পরিক ব্যক্তিগত কলহ। তাছাড়াও তাদের নিজেদের জীবিকার নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠা করা। প্রবাদ আছে, “অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা”। মৌলবাদী ধর্মযাজকেরা যখন কোনো প্রকার শ্রম ছাড়াই আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ থাকে এবং তাদের চিত্তবিনোদনের জন্য কিছু করার থাকে না, তখন তাদের মাথায় নানান প্রকার কীটপতঙ্গ বাসা বাঁধে। ফলে তারা তখন যুক্তিহীন বয়ান দিয়ে অল্পশিক্ষিত, অশিক্ষিত ও দুর্বল মনের মানুষদের বশীভূত করে বিপথে ঠেলে দেয়। এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে ধর্মভীরুরা পরোক্ষভাবে হলেও আর্থিকভাবে সহায়তা করে প্রতিটি মৌলবাদী সন্ত্রাসে। আর প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে ধার্মিক রাষ্ট্রগুলো ও বিশ্বের সকল দেশের মৌলবাদী ধনকুবেরেরা।

ধর্মভীরুদের মতো মৌলবাদী সন্ত্রাসীদেরও উদ্দেশ্য তাদের যার যার ঈশ্বরকে তুষ্ট করা, নিজের ধর্মের বাহুবল প্রদর্শন করা, পরজন্মে বেহেস্তের চাবি হাতে নেয়া, অথবা পূর্বে ঘটিত কোনো হত্যার প্রতিশোধ নেয়া, ইত্যাদি, ইত্যাদি। অথচ, জীব হত্যা হচ্ছে জঘন্যতম একটি অপরাধ। মৌলবাদীরা এই সহজ বিষয়টি বুঝার চেষ্টা করে না, “যে ঈশ্বরের জন্য তারা পরস্পর পরস্পরকে শত্রু মনে করে, অশান্তির তাপদাহে পুড়ে মরে, তাদের সে ঈশ্বর কিন্তু এক ও অভিন্ন।”

একটু একটু করে বিশ্বের সকল কিছুরই পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে আধুনিক বিজ্ঞান সম্মত করা সম্ভব হলেও, দুঃখজনকভাবে কেবলমাত্র ধর্মের নামে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব হচ্ছে না। কেননা, ধর্মভীরুরা সত্যিই কাপুরুষ। তারা নিজেদের মনকে প্রশ্নের সম্মুখীন করতে ভয় পায়। তারা বিবর্তন মেনে নেয়ার প্রশিক্ষণ নিতে অপ্রস্তুত। পাপের ভয়ে তারা মৌলবাদকে ঘৃণা করতে কার্পণ্য করে। তারা বাস্তবতার থেকে অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস করে অধিক। অথচ, মানবতার উপর কোনো ধর্ম হতে পারে না। প্রকৃতির উপর ঈশ্বর হতে পারে না। ঈশ্বর থাকে মানুষের হৃদয়ে, বোধে, ভাবনায়।

ক্লান্ত হয়ে পড়েছি সাম্প্রদায়িকতায়, মৌলবাদী দাঙ্গায়। হৃদয় ভেঙে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পড়েছে প্রতিদিন হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি ও হত্যার লীলাখেলা দেখতে দেখতে। সম্প্রতি শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বোর একাধিক গির্জা ও হোটেলে পাশবিক আক্রমণে নির্মমভাবে জীবন দিয়েছেন তিনশত ঊনষাট জন মানুষ, তাদের মধ্যে আছে নিষ্পাপ শিশুরাও। এর কিছুদিন পূর্বে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে মসজিদ হামলায় ৫০ জন মানুষ জীবন দিয়েছেন। তার কিছুদিন পূর্বে ইংল্যান্ডে, ফ্রান্সে, যুক্তরাষ্ট্রে, বাংলাদেশে... আর কতগুলো আক্রমণের কথা লিখব? ইসরাইল-প্যালেস্টাইন সমস্যা তো দীর্ঘ মেয়াদি সমস্যার এক প্রকল্প। লিখলে এ তালিকা দীর্ঘ হতে হতে এত দীর্ঘ হবে যা একজীবনে পড়ে শেষ করা যাবে না হয়তো।

তবুও স্বপ্ন দেখি, অদূর ভবিষ্যতে আমরা ধর্মভীরুরা নিরপেক্ষ হতে পারব। আমরা নির্ণয় করতে সক্ষম হবে যে, ধর্ম রাজনীতি ব্যতীত অন্য কিছু নয়। জন্মসূত্রে পাওয়া ধর্ম নয়, নিজের বিচার বিবেচনায় মানুষের জন্য কল্যাণকর মানব ধর্ম অনুসরণ করব। ধর্মের নামে মানব জাতির জন্য অকল্যাণকর সকল কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শিখব। আমরা আমাদের ঈশ্বরকেও খুঁজে পেতে সক্ষম হবো নিজেদের হৃদয়ে, বোধে ও ভাবনায় এই প্রকৃতির মাঝে।

খুরশীদ শাম্মী, কানাডা প্রবাসী লেখক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ