প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯
বিতর্ক চর্চাকে সবসময়েই আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের ইচ্ছাধীন শখের বিষয় করে রেখেছি। অথচ বিতর্ককে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা জাতিগঠনের স্বার্থে অত্যন্ত জরুরি।
সংলাপই সভ্যতার ভিত্তি। আর সংলাপহীনতা থেকে নানাবিধ অসভ্যতার আমদানি। বিতর্ক যে কোন অভিমতের পক্ষে-বিপক্ষে মুক্তমনে আলোচনা করতে শেখায়। ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতা তৈরি করে। শিশুর মননে অহিংসতার ভিত্তি পাকাপোক্ত করতে যুক্তিবোধ অপরিহার্য।
একজন মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে বিতর্কের উপযোগ সবচেয়ে বেশি। বিতর্ক-চর্চার মাঝ দিয়ে সে যে কোন বক্তব্য গুছিয়ে প্রকাশ করতে শেখে। এতে ব্যক্তিগত জীবনে কথা বুঝতে ও বোঝাতে না পারার কারণে বিপত্তি হাজির হয় না। স্পষ্ট করে কথা বুঝিয়ে বলতে পারা যে কোন মানুষের জীবনকে অপেক্ষাকৃত সহজ করে তুলতে পারে।
শিশুদের প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষায় বিতর্ককে সংযোজন করা গেলে; অন্ধ আবেগের পরিবর্তে যুক্তিনির্ভর মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে তারা। জনসংখ্যার আধিক্য ও দুর্বল শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে যে বিশৃঙ্খল ও নৈরাজ্যমূলক চিন্তার ধরণ দৃশ্যমান; তা থেকে জাতিকে একটি অপেক্ষাকৃত সুশৃঙ্খল চিন্তা কাঠামোতে ফিরিয়ে আনতে বিতর্ককে অনতিবিলম্বে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে; সরকারের সঙ্গে জনগণের স্পষ্ট যোগাযোগ স্থাপনের মাঝ দিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগটি চর্চা করতে গেলে; নতুন প্রজন্মকে বিতর্ক চর্চার মাধ্যমে সুযোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম করে তুলতে হবে।
এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমাজ ও রাজনৈতিক উত্তরণের স্বার্থে যে কোন ইস্যু নিয়ে সমাধান লক্ষ্য করে এগিয়ে যাওয়া সংলাপের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে বিতর্ক শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। সংকট ঘনীভূত না করে বা একে ধামাচাপা না দিয়ে; সংকট সমাধানের ইতিবাচক সংস্কৃতি প্রচলনে সক্ষম এই বিতর্ক চর্চা।
জাতিগতভাবে গোছানো ও সুশৃঙ্খল চিন্তায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে শিক্ষা-ব্যবস্থায় বিতর্ক প্রচলন এক নিশ্চিত ফলদায়ী একটি পদক্ষেপ।
স্কুলে শিশুরা যখন গ্রাম বনাম শহরের মতো সহজ বিষয় নিয়ে বিতর্ক করে; তখন তাদের আলোচনায় গ্রাম ও শহরের সুবিধা ও অসুবিধার নানাদিক উঠে আসে। বিতার্কিকের মাঝে যে কোন বিষয়ের চারদিক সম্পর্কে একটা সমগ্র ধারণা তৈরি হয়। আর শিশুরা বিতর্ক চর্চা না করলে গড়ে ওঠে আংশিক দৃষ্টিভঙ্গি; একপেশে মনোভাব। হয় তার কাছে গ্রাম ভালো বা শহর ভালো। বিজ্ঞান তার কাছে হয় আশীর্বাদ; নয়তো অভিশাপ। অথচ বিজ্ঞানের ভালো-মন্দ দুটো দিক সম্পর্কে প্রশস্ত ধারণা নিয়ে গড়ে উঠতে পারে ক্ষুদে বিতার্কিকরা।
শিক্ষা-ব্যবস্থায় বিতর্ক বা যুক্তিচর্চা বিষয় হিসেবে থাকলে ছাত্রছাত্রীরা রাজনীতি-ধর্ম এরকম নানা বিষয়ে অন্ধ অনুভূতি আক্রান্ত না হয়ে যুক্তির নিরিখে অন্যের অভিমত শোনার ও নিজস্ব যুক্তি উপস্থাপনের সক্ষমতা অর্জন করবে। পরমতসহিষ্ণুতা তৈরির অনন্য মাধ্যম এই বিতর্ক। প্রাচীন ইউরোপে গ্রিসের বিতর্ক-চর্চার ঐতিহ্য কালক্রমে গোটা ইউরোপকেই উপকৃত করেছে। সুষম গণতন্ত্র নির্ভর কল্যাণরাষ্ট্র গঠনে ইউরোপের দেশগুলোর সামষ্টিক সাফল্যের পেছনে রয়েছে এর যুক্তিনির্ভর সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামো।
শিশু-কিশোর-তরুণরা বিতর্ক চর্চার প্রয়োজনে বিভিন্ন বিষয়ে পড়ালেখার সুযোগ পায়। ফলে তার জ্ঞানার্জনের পরিসর বিস্তৃত হয়। এ কারণে শিক্ষাব্যবস্থায় বিতর্কের প্রচলন জ্ঞান নির্ভর সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম নাগরিকদের প্রস্তুত করতে পারবে। বিতর্ক সমাজ-বিজ্ঞান পাঠের সুযোগ উন্মুক্ত করে। ফলে মানুষের প্রতি সমানুভূতি বা এমপ্যাথিসম্পন্ন মানুষ গড়ে তুলতে খুবই সহযোগী হয় এই চর্চা। বিতর্ক শিষ্টাচার শেখায়, মানুষকে বিনয়ী করে তোলে, ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তৈরি করে।
বিতর্ক চর্চা শিশু-কিশোরের মাঝে খুব অল্প বয়েসেই বিতর্কে জয়-পরাজয়-প্রশংসা-সমালোচনা সহজভাবে নিতে শিক্ষা দেয়। জীবনে পথচলার ক্ষেত্রে তাই 'দেখিয়ে দেয়া', 'কাঁপিয়ে দেয়া', 'স্যার হওয়া', 'মাননীয় হওয়া' টাইপের আউটডেটেড লোভগুলো থাকে না। মানুষ মাত্রই আত্ম-প্রেম বা নার্সিসিজমের যে আকাঙ্ক্ষা লালন করে তা বিতর্ক-চর্চার মাঝ দিয়ে অল্পবয়েসেই পূরণ ও নিষ্পন্ন হওয়ায়; কোন একটি ক্ষমতা পেয়ে যুবা-প্রৌঢ় বা বৃদ্ধ বয়সে এসে আত্মপ্রেমের বিলম্বিত যৌবন বা নার্সিসিজমের লেট ইয়ুথ হাজির হয়ে বিপত্তি ঘটায় না। অর্থাৎ বিতার্কিক বয়সোচিত ভাবে বেড়ে ওঠে। জীবনের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি থাকে নৈর্ব্যক্তিক। কেবল নিজের সাফল্য বা বিলাসী জীবনে বুঁদ না হয়ে সে সামষ্টিকভাবে ভালো থাকার ও সুখে থাকার সংকল্প বয়ে চলে।
শিশুরা 'অর্থ অনর্থের মূল' এমন বিষয়ে বিতর্কে অংশ নিলে; জীবনে কতটুকু টাকা-পয়সা হলে চলে সে সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা লাভ করে। ফলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ব্যক্তিজীবন আর সামাজিক সুষমাকে বিনষ্ট করে না।
সম্পদের সুষম বণ্টন যে উন্নয়নের পূর্বশর্ত তা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের বিতর্কের মাঝ দিয়ে বিতার্কিকদের কাছে স্পষ্ট হয়। ফলে পেশাগত জীবনে উদ্যোক্তা, শিক্ষক, নীতি-নির্ধারক, উন্নয়ন কর্মী, প্রজাতন্ত্রের সেবক, সাংবাদিক, আইনজীবী; যাই হোক না কেন; একজন বিতার্কিক ক্রমাগত কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করতে পারে। একটি রাষ্ট্র কল্যাণরাষ্ট্র না হতে পারলে যে তা ব্যর্থ রাষ্ট্র; এই সহজ সত্য উপলব্ধির সামষ্টিক সক্ষমতা সৃষ্টিতে শিক্ষা-ব্যবস্থায় বিতর্কের প্রচলন সময়ের দাবি।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য