প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
ইমতিয়াজ মাহমুদ | ২৫ অক্টোবর, ২০১৯
বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা প্রসঙ্গে আমাদের দেশে একটা জনপ্রিয় ভ্রান্তি আছে। মাঝে মাঝেই আপনি কিছু লোককে বলতে শুনবেন- ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা বা অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা, এই ধরনের একটা কথা বলছে লোকে। এটা বাজে কথা এবং বাক ও চিন্তার স্বাধীনতার ভুল ব্যাখ্যা। বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা বিষয়টা অতি সরল ও সহজ একটা কথা। কথাটা কী? আপনি আপনার যা ইচ্ছা তাই বলতে পারেন, যা ইচ্ছা তাই- কেবল আপনি আরেকজনের লিবার্টি বা স্বাধীনতায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারবেন না বা কারো কোন বাস্তব ক্ষতি করতে পারবেন না। ব্যাস। এর বাইরে কিছু নয়। অপরের ক্ষতি করা বা অপরের লিবার্টি খর্ব করা মানে কী?
আমি যদি কারো মনে কষ্ট দিই, ধরেন রবীন্দ্রনাথকে চৌদ্দগোষ্ঠি তুলে গালি দিলাম বা সেরকম অন্য কোন পূজ্য বাঙালিকে, সেটা কি কারো ক্ষতি করা হলো? না। একটা প্রকৃত এবং বাস্তব ক্ষতি হতে হবে। যেমন আপনি যদি কারো মানহানি করেন, সেটা একটা বাস্তব ক্ষতি। অথবা ধরেন আপনি একটি ধর্মীয় সমাবেশে চীৎকার করে করে মানুষকে উত্তেজিত করতে থাকেন যে চলেন, পাশের ভিনধর্মীদের বাড়িঘরগুলি ভেঙে দিয়ে আসি- আপনি একটা আশু এবং বাস্তব বিপদ ও ক্ষতির সম্ভাবনা তৈরি করছেন। এইরকম প্রকৃত ক্ষতি বা ক্ষতির সম্ভাবনা যদি ন হয়, তাইলেই কেবল কথা বলায় বাধা দেওয়া যাবে। নাইলে যাবে না।
এটাই লিবার্টি বা বাক স্বাধীনতা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। এবং এটা একটা নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা, নিরঙ্কুশ এই অর্থে যে যতক্ষণ অন্যের লিবার্টি খর্ব না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত বাক স্বাধীনতার কোন সীমা পরিসীমা নাই। কারো মনে কষ্ট দিলে সেটা ক্ষতি বা লিবার্টিকে খর্ব করা বুঝায়না।
এখন আসেন 'ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা' কথাটাকে ফালতু বাত কেন বলছি সেই প্রশ্নে।
২
ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা আবার কী? এটা একটা অসম্ভব অবাস্তব ও লিবার্টি বিরোধী কথা। এই পৃথিবীতে অনেক রাজনৈতিক মত আছে যেগুলির প্রতি আপনার বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নাই। একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ সকল মত ও পথকে শ্রদ্ধা করতে পারে না। আপনি নিজেই উদাহরণ ভাবেন, অনেক উদাহরণ পাবেন। অনেক লোককে আমি জানি যারা মনে করে যে কমিউনিস্টদের চিন্তা ও মতবাদ মানব সভ্যতার জন্যে ক্ষতিকর বা মার্ক্স সাহেবের মতবাদ একটি ভয়ংকর অমানবিক মতবাদ। ওদেরকে আপনি কী বলবেন? যে কমিউনিস্টদের মতবাদের প্রতি শ্রদ্ধা রাখুন? এটা কি হয়? যেটাকে আমি মনে করি ভ্রান্ত মতামত তার প্রতি আবার কীসের শ্রদ্ধা? আবার এই মার্ক্সবাদ বিরোধীদের কথা আমার কাছে মনে হয় একটি ভ্রান্ত মত। আমি কি ওদেরকে শ্রদ্ধা করতে থাকবো? মোটেই না।
যেটা আপনার থাকতে হবে সেটা হচ্ছে যে সকলের মতামত ধারণ করা ও সেটা প্রকাশের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা। ঐ যে ভল্টেয়ারের কথাটা, যে আমি আপনার মতামতকে ফালতু মতামত মনে করি, কিন্তু সেই ফালতু মতামতটি প্রকাশ করতে যদি কেউ আপনাকে বাধা দেয়, আমি সেটার প্রতিবাদ করবো। আপনার মতটির প্রতি শ্রদ্ধা রাখার দরকার নাই, আমি লড়বো আপনার অধিকারের জন্য।
এটারই একটা অনুষঙ্গ হচ্ছে যে, আমি যখন একজনের মত প্রকাশের অধিকারের জন্য লড়ি, তার মানে এই না যে সেই মতামত আমি সমর্থন করি বা সেটাকে অতি উত্তম মতামত মনে করি। এমনটা হতেই পারে যে আপনার মতামতকে আমি নিতান্ত ভেড়ার প্রলাপ মনে করি। তারপরেও রাষ্ট্র বা সমাজ যদি আপনার কণ্ঠ রুদ্ধ করতে চায়, আমি আপনার পাশে গিয়ে দাঁড়াবো, দাঁড়িয়ে বলবো যে- না, এর কণ্ঠ রোধ করা যাবে না। ভেড়ার প্রলাপটি বকার অধিকারও আপনার আছে।
বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা হচ্ছে একটি কন্টেন্ট নিউট্রাল বা বিষয় নিরপেক্ষ স্বাধীনতা। মানে, আপনি কী বলবেন সেই বিষয়বস্তুর উপর আপনার স্বাধীনতা নির্ভর করে না।
৩
এই সাথে আরেকটা কথাও চলে আসে। আপনার মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে, কিন্তু সেই কথাটা শুনার কোন দায়িত্ব আমার নেই। আমার ইচ্ছা হলে আপনার কথা শুনব ইচ্ছা না হলে শুনব না। এটা হচ্ছে ঐ যে বাক স্বাধীনতার যে সরল অর্থ বলেছি, সেটারই অংশ। কীভাবে? বলছি।
আপনি কী বলবেন বা না বলবেন সেটা আপনার অধিকার। আর আমি কী শুনতে চাই বা না চাই সেটাও আমার স্বাধীনতা। তাইলে আপনার অধিকারের পরিধি কী? কতোটুকু? আমার কানের যেখানে শুরু সেখানেই আপনার স্বাধীনতার সমাপ্তি। আপনি আপানর মতামত যেভাবে খুশি সেভাবে প্রকাশ করতে পারেন। বই লিখে বলতে পারেন, খবরের কাগজে প্রকাশ করতে পারেন, ছবি এঁকে প্রকাশ করতে পারেন, গান গেয়ে প্রকাশ করতে পারেন, মাইক বাজিয়ে বলতে পারেন, জনসভা করে বলতে পারেন। কিন্তু আমি সেটা শুনব কি শুনব না সেটা আমার স্বাধীনতা।
কেননা স্বাধীনতা বা লিবার্টি সে তো সকলেরই আছে। আমার লিবার্টি আমার, আপনার লিবার্টি আপনার। আপনার লিবার্টি আমি কাটতে পারবো না আর আমার লিবার্টি আমি কাটতে পারবো না। সমাধান কী? সমাধান হচ্ছে- আপনার স্বাধীনতা সেখানেই শেষ যেখানে আমার নাকের শুরু- এখানে হবে কানের শুরু। ব্যাস। তাইলেই সমাধান হয়ে গেল।
এসব কথা কিন্তু আমি আগেও অনেকবার বলেছি নানাভাবে- ইনিয়ে বিনিয়ে গুনগুনিয়ে কতভাবে। এখন আবার বলছি। দেখি, পারলে বই লিখেও বলবো।
৪
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার কি জানেন? আমাদের দেশের আইনও কিন্তু এটাই। আমাদের সংবিধানের বিধান যা আছে, সেটার অর্থও মোটামুটিভাবে এটাই। সেখানেও বলা আছে যে বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হলো, রাষ্ট্র এই অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। শুধু তাই নয়। বাক ও চিন্তার স্বাধীনতাকে খর্ব করতে পারে এরকম কোন আইনও সংসদ পাশ করতে পারবে না- কেবল সীমিত কয়েকটা ক্ষেত্র ছাড়া। সীমাবদ্ধতা বাক ও চিন্তার স্বাধীনতার উপর নয়- সীমাবদ্ধতাগুলি আরোপ করা হয়েছে সংসদের ওপর।
তবে আমাদের দেশের শিক্ষিত লোকজনের মধ্যে কিনা সাধারণ বুদ্ধিবৃত্তিক মান এবং চেতনার মান খুব নিচু। ফলে এরা বেশিরভাগই আপনাকে বলবে যে না, বাক স্বাধীনতা সীমিত ও শর্ত সাপেক্ষ। এইরকম বেওকুফি কথা যারা বলেন ওদের মধ্যে অনেক উকিল সাহেবও আছেন, আরও অনেকেই আছেন। কী করবেন! ন্যাশনাল লেভেল অব ইন্টেলেকচুয়াল ক্যাপাসিটি যদি খারাপ হয়, এরকমই তো হবে।
ফুটনোট দিয়ে দিই একটা: মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানে কিন্তু মিথ্যাচারের স্বাধীনতা নয়। তথ্য আর মতামত দুইটা দুই জিনিস।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য