আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

রেল-ব্যবস্থার এপিটাফ

মাসকাওয়াথ আহসান  

রেলগাড়ি সেই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস 'পথের পাঁচালী'র অপু আর দুর্গার মতোই আমাদের কিশোর মনে রোমাঞ্চ তৈরি করতো। অন্য যে কোন যানবাহনের চেয়ে ট্রেন আমাদের অনেক প্রিয় হয়ে ওঠে। আমার বেড়ে ওঠা প্রাচীন রেলশহর ঈশ্বরদীতে। সেখানে ১৯ টি রেললাইন পাশাপাশি পাতা ছিলো। পরে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট রেলজংশনে গিয়ে তুলনামূলক হিসাব করে দেখি ঈশ্বরদী রেলজংশন ফ্রাঙ্কফুর্টের মতোই বিশাল একটি অবকাঠামো। প্রতিদিন বিশাল কর্মযজ্ঞ এখানে রেলগাড়িকে ঘিরে।

সে যুগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে অনেক মনীষী ঈশ্বরদী রেলজংশনে যাত্রাবিরতি করেছেন। তাদের স্মৃতিকথায় লেখা আছে এ জংশনের গল্প।

সত্যজিৎ রায় তার প্রিয় চরিত্র 'অপু'র জীবনে রেলগাড়িকে যেভাবে চিত্রিত করেছেন; রেলগাড়ি আমার জীবনে সেরকম প্রতীকী একবার ব্যাপার। রাতে ট্রেনের হুইসেল কিংবা ঝমঝম শব্দ শুনলে তা যেন বৃষ্টির মতো ঘুম নিয়ে আসে।

বাংলাদেশের সমান বয়স হওয়ায় বাংলাদেশের রেল-ব্যবস্থার ইতিহাস আমাদের চোখের সামনে বেড়ে উঠেছে। এ ইতিহাস জানতে আমাদের কারো দ্বারস্থ হতে হচ্ছে না; এটা স্বস্তির ব্যাপার। মুক্তিযুদ্ধের সময় রেল-ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়লে স্বাধীনতার পর অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে তা মেরামত করা হয়। এসময় ট্রেন দেরিতে ছাড়তো; বা রেল-সংস্কারের কারণে একটু ধীরলয়ে যেতো। কিন্তু ব্যবস্থাটা সটান ছিলো। রোমান্টিক স্টেশন মাস্টারেরা ছিলেন; যারা রাতের ট্রেনকে বাতি দুলিয়ে বিদায় জানাতেন। সকালের ট্রেনকে সবুজ পতাকা দুলিয়ে সুপ্রভাত বলতেন। সুতরাং বঙ্গবন্ধু (১৯৭২-৭৫) এই প্রাচীন রেল-ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছিলেন; তার প্রমাণ মেলে।

জিয়াউর রহমানের (১৯৭৫-৮১) আমলে রেল-ব্যবস্থায় তেমন কোন পরিবর্তন চোখে পড়েনি। ট্রেন লেট হতো; কোথাও থেমে গেলে কখন ছাড়বে বোঝা যেতো না। রেল-ব্যবস্থাটা চলছে চলুক এমন একটা দায়সারা ভাব দেখা যেতো। তবু ব্যবস্থাটা টিকে ছিলো।

হোসাইন মুহম্মদ এরশাদ (১৯৮২-৯০) এসে আন্তঃনগর রেল-সার্ভিস চালু করেন। বাংলাদেশ রেলের নবায়নে তার প্রচেষ্টা ছিলো প্রশংসনীয়।

এরপর খালেদা জিয়ার (১৯৯১-৯৬) আমলে রেল-ব্যবস্থা চলছে চলুক এমন একটি স্টাইলে ফিরে যায়। মোটামুটি রেল-লাইনগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা তখনো টিকে ছিলো।

এরপর শেখ হাসিনার (১৯৯৬-০১) আমলে রেল-ব্যবস্থাটা একইভাবে টিকে থাকে। যে কোন ব্যবস্থার টিকে থাকার ধারাবাহিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

২০০১-০৬ পর্বের খালেদার শাসনামলে রেল-বাজেটের কলেবর বৃদ্ধি পায়। কিছু উপরিকাঠামোর উন্নয়ন ঘটে। কিন্তু রেল-ব্যবস্থার সামগ্রিক কোন উন্নতি চোখে পড়ে না। তবে রেল-লাইনগুলো শত বছরের একটি চলমান ব্যবস্থার ধারাবাহিকতায় রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো।

২০০৯ সাল থেকে চলমান শেখ হাসিনার শাসনকালে শুরুতে রেল-ব্যবস্থাটা মোটামুটি তার ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখে। রেল-বাজেট অস্বাভাবিক স্ফীত হয়। রেল-স্টেশনগুলোর আধুনিকায়ন ঘটে। কিন্তু রেল-লাইন রক্ষণাবেক্ষণে বাঁশের ব্যবহার শুরু হয়। মানে বাংলাদেশের শতবর্ষের রেল-ব্যবস্থাটি ভেঙ্গে পড়ে। লুটপাট হয়ে গেছে রেল সেক্টর; ক্ষমতাসীন দলীয় ঠগিরা কথিত উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা লুণ্ঠন করে বিদেশে পাচার করেছে; গড়েছে সেকেন্ড হোম । রেল-ব্যবস্থা বলতে যা দাঁড়িয়ে আছে; তা একটা ব্যবস্থার ফসিল মাত্র।

আমার আব্বা-আম্মা রেলগাড়িকে আরামদায়ক ও নিরাপদ যানবাহন বলে মনে করতেন। গাড়ি-বাস-কোচের ওপর তাদের আস্থা কম। আর এতো পরিবেশ দূষণ সড়কপথে যে বয়েসি মানুষের জন্য তা খুবই কষ্টকর এক অভিজ্ঞতা।

তবে রেলগাড়ি ও রেলস্টেশনের ওয়াশরুম (টয়লেট) অব্যবস্থাপনায় অসন্তুষ্ট হয়ে আমার আম্মা একবার পরিচ্ছন্ন কর্মীদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, রেলে কী ফিনাইল-ব্লিচিং পাউডার এসব পরিচ্ছন্নতা সামগ্রীর বরাদ্দ নেই। পরিচ্ছন্ন কর্মী দুঃখের সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলেন, সবই আসে; কিন্তু রেল-কর্তারা সেগুলো নিয়ে গিয়ে নিজ নিজ বাসায় টয়লেট পরিষ্কার করার কাজে ব্যবহার করে। এই হচ্ছে সরকারি সেবকদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও অসততার একটি টুকরো কেসস্টাডি। অবশ্য ত্যাগী ও রাতজাগা; পরিবার ছেড়ে দিনের পর দিন দূরে থাকা রেলের-কর্মীদের দৃষ্টান্তও রয়েছে; যাদের আন্তরিকতায় এতদিন ব্যবস্থাটা অন্তত: টিকে ছিলো।

আমার আশৈশব ভালো লাগার রেল-ব্যবস্থার এপিটাফ লিখতে অত্যন্ত বেদনাবোধ করছি। মৃত রেলব্যবস্থায় নিয়মিত মৃত্যুর সওদা চলছে। রেল-দুর্ঘটনায় অনাথ আহত শিশুর মুখমণ্ডলে এই অশনি সংকেত স্পষ্ট। ২০০৯ সাল থেকে আজ-অবধি যেসব মন্ত্রী-আমলা রেল-মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন; তাদের যে অপরাধ তা মানবতাবিরোধী অপরাধ। তাদের অক্ষমতা ও অবহেলায় বাংলাদেশের অসংখ্য রেলযাত্রীর জীবন আজ বিপন্ন।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ