প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
শাখাওয়াত লিটন | ১৮ আগস্ট, ২০১৭
শিরোনামটা পড়লে কারো কারো কাছে একটু খটকা লাগতে পারে। তবে বিষয়টা খুব সহজ এবং স্পষ্ট; কোন বিতর্কের অবকাশ নেই।
বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে সংবিধানে আমাদের যতগুলো মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে সে গুলোর মধ্য স্বাধীন বিচার বিভাগ পাওয়াও একটা মৌলিক অধিকার। সংবিধানের ৩৫(৩)অনুচ্ছেদ পরিষ্কার ভাষায় বলছে, ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচারলাভের অধিকারী হইবেন।
তাহলে সংবিধানের এই বিধানের আলোকে আমাদের বিচার বিভাগকে অবশ্যই স্বাধীন হতে হবে। স্বাধীনতার কমতি থাকলে স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে আমাদের বিচারলাভের অধিকারের ভাগ্যে কী ঘটবে?
কোন নাগরিক ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হলে বা ফৌজদারি অপরাধের কেউ শিকার হলে বিচারের কাজ শুরু হয় নিম্ন আদালতে। ওই সব অপরাধের বিচারিক আদালত হল নিম্ন আদালত। কিন্তু নিম্ন আদালতের উপর সরকারের তথা নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ এখনও বহাল থাকায় তার স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ।
২০০৭ সালের নভেম্বরে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ করা হলেও সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া এখনও শেষ হয়নি। সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নিম্ন আদালত হাই কোর্টের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা। ১৯৭২ সালের সংবিধানের এ বিধানটি এখনও বহাল আছে।
এই বিধানের আলোকেই নিম্ন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি, ছুটি এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টকে ক্ষমতা দেয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে সে ক্ষমতা রাষ্ট্রপতিকে দেয়া হয়। কয়েক বছর পর সামরিক সরকার আমলে ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বলে হয়, সুপ্রিম কোর্টের সাথে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি তার ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন। সেই ব্যবস্থা এখনও বহাল। সুপ্রিম কোর্ট একাধিক রায়ে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহালের কথা বলেছে। কিন্তু কোন সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি।
রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমতা থাকলেও তিনি এককভাবে সে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন না। কেননা প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া বাকি সব কাজ রাষ্ট্রপতিকে করতে হয় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, নিম্ন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি, ছুটি এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের রাষ্ট্রপতির যে ক্ষমতা সেটা আসলে প্রয়োগ করছেন প্রধানমন্ত্রী। আর সুপ্রিম কোর্টের সাথে পরামর্শের যে বিধান সেটাও তেমন অর্থপূর্ণ কিছু নয়। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে এই পরামর্শের বিধানকে "অর্থহীন" বলা হয়েছে।
তাহলে বিচারিক আদালত হিসাবে নিম্ন আদালতের স্বাধীনতার কমতি রয়েছে সেটা কি বলা যায় না?
নিম্ন আদালতের রায়ের পর রায়ে সংক্ষুব্ধ যে কোন পক্ষ রায়ের বিপক্ষে উচ্চ আদালত তথা হাই কোর্টে আপিল দায়ের করতে পারেন। হাই কোর্টের রায়ে সন্তুষ্ট হতে না পারলে যে কোন পক্ষ উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করতে পারেন।
হাই কোর্ট বিভাগ এবং আপিল বিভাগ নিয়ে গঠিত সুপ্রিম কোর্ট পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছে সেটাও কিন্তু নিশ্চিত করে বলা যায় না। কেননা, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে এখনও সরকারের ক্ষমতা বহাল আছে। বিচারক নিয়োগের জন্য সংবিধানের ৯৫(২)(গ) অনুসারে একটা আইন করার কথা। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন সরকার আইনটা করেনি। কেন করেনি? কারণ আইন করলে, বিচারক নিয়োগে সরকারের একচ্ছত্র ক্ষমতা খর্ব হতে পারে।
আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়া উন্নত করতে আগ্রহী না হলেও সরকার কিন্তু বিচারক অপসারণে অনেক আগ্রহী। সেই আগ্রহের বহিঃপ্রকাশ ঘটে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীতে। উক্ত সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে অর্পণ করা হয়েছিল। সংসদের কাছে ক্ষমতা থাকা মানেই কিন্তু সে ক্ষমতার উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকা। ষোড়শ সংশোধনীকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরিপন্থী বলে সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল করে দিয়েছে।
তবে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণ রায় প্রকাশের পর থেকে আদালত এবং প্রধান বিচারপতিকে লক্ষ্য করে যে সব আপত্তিকর বক্তব্য দেয়া হচ্ছে তা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার উপর হুমকি বলে অনেকেই মনে করছেন। প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করে এমন সব ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে যা আদালত অবমাননাকর। বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকেই উদ্বিগ্ন।
কারো মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে প্রতিকার চেয়ে উচ্চ আদলতে যাওয়া তার সাংবিধানিক অধিকার। আবার স্বাধীন বিচার বিভাগ আমাদের জনগণের যে মৌলিক অধিকার। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে, আমাদের সেই মৌলিক অধিকার কি সুরক্ষিত?
বিচারক অপসারণে সংসদের কাছে ক্ষমতা থাকা উচিত কি না সেই বিতর্কে আমাদের অনেকেই সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্মভূমি যুক্তরাজ্যর প্রসঙ্গ টেনেছেন। তিনশ বছরের বেশি সময় ধরে সে দেশের সংসদ বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতায় ক্ষমতাবান, যদিও আজ পর্যন্ত একজন বিচারপতিকেও সে অপসারণ করেনি, অপসারণ করার প্রয়োজন পড়েনি। সে দেশের সংসদ এই ক্ষমতা নিয়েছিল রাজা বা রানীর রোষানল থেকে বিচারপতিদের রক্ষা করতে। রাজা-রানীরা তাদের ইচ্ছামাফিক বিচারপতি অপসারণ করতেন। সংসদ সেই ক্ষমতা নিজের কাছে নিয়ে বিচারপতিদেরকে গত তিনশ বছর সুরক্ষা দিয়ে চলেছে। আবার ব্রিটিশ সরকারের বিচারমন্ত্রী শপথ নেন সরকারের ভেতরে বা বাইরের সকল সমালোচনা এবং আক্রমণ থেকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে।
আমাদের দেশে সেই দিন কবে আসবে, যখন আমাদের বিচারমন্ত্রীও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার শপথ নিবেন?
[ফেসবুক থেকে]
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য