প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জফির সেতু | ২৪ অক্টোবর, ২০১৭
এক দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনতিপরিসর কেন্টিনে বসে ভাত খাচ্ছি আর গল্প করছি সুহৃদ এক সহকর্মীর সঙ্গে। তিনি সম্প্রতি ডিগ্রি শেষ করে বিদেশ থেকে ফিরেছেন এবং পদোন্নতি-সংক্রান্ত এক জটিলতায় পড়েছেন। সেটা ২০১২ সাল, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করার ঠিক পরের বছর। ততক্ষণে গল্পচ্ছলে একটা মহামূল্যবান কথা বলে ফেলেছেন তিনি। এ-রকম একটা উপলব্ধি আমার ভেতরেও ঘুরপাক খাচ্ছিল অনেকদিন ধরে। তিনি বলেছিলেন, এই যে বিশ্ববিদ্যালয়, আমরা এমনটা করে রেখেছি যে, অমর্ত্য সেনও যদি এখানে শিক্ষকতা করতে আসেন তাহলে তাকেও মাথা নুইয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে হবে! আরও যোগ করলেন, দেখেন, এটা এমন একটা দেশ বানিয়েছি আমরা, বিশ্ববিদ্যালয়ে একেকটা আইনই যেন তৈরি হয় একেক জনকে মাথায় রেখে। কাকে কী দিতে হবে, আর কাকে কীসে বঞ্চিত করতে হবে। কাজ হয়ে গেলেই আইনও বাতিল হয়ে যায়, বা নতুন আইন তৈরি হয়।
আমি আমার সহকর্মীর দিকে মুখ তুলে তাকালাম। জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কি এমনটি হওয়া উচিত? তিনি বললেন, খোঁজ নিয়ে দেখুন বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ই হয়ত এমনভাবেই চলছে। আমি বললাম, আমার অভিজ্ঞতা কম কিন্তু তা অন্যরকম। আমি সম্প্রতি তিনজন বরেণ্য মানুষের আত্মজীবনীমূলক রচনা পড়েছি, সেখানে দেখেছি ভারতের অবস্থা এর চেয়েও কম না। যাদের লেখা পড়েছি এঁরা হলেন, আশুতোষ ভট্টাচার্য, নিমাইসাধন বসু ও তপনরায় চৌধুরী। প্রথমোক্ত দুজন তো যথাক্রমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্বভারতীর উপাচার্যই ছিলেন, আর হার্ভার্ড-পেনসিলভেলিয়া-কালিফের্নিয়াখ্যাত ইতিহাসবিদ তপনরায়ের কথা কে না জানে? বিশ্ববিদ্যালয়-সংক্রান্ত তিক্ত-অভিজ্ঞতা যেমন, তৈলমর্দন, রাজনীতিকরণ, দলীয় লেজুড়বৃত্তি, দলবাজি, পরশ্রীকাতরতা, স্বজনপ্রীতি, শিক্ষকদের জ্ঞানবিমুখতা, রেজাল্ট কেলেঙ্কারি ও অসততা ইত্যাদি ছিল তাদের মনোকষ্টের কারণ।
পরে আমরা এই তিনজনের অভিজ্ঞতার সূত্র ধরে আমাদের আলোচনাকে বিশেষ থেকে নির্বিশেষের দিকে যাই। এক পর্যায়ে প্রসঙ্গান্তরে। কিন্তু এ-ব্যাপারে আমার নিজের একটা পর্যবেক্ষণও আছে।
২
প্রথম কথা, ভারতে বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও দুইটি বিশ্ববিদ্যালয় কখন, কারা এবং কেন প্রতিষ্ঠিত করেছিল? বলাবাহুল্য, আমরা সকলেই জানি, মেকলের ঘোষণামতে, ভারতে একটা বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে একটা ভারতীয় কলাবরেটর শ্রেণি তারা তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যারা হবে ঔপনিবেশিক শক্তির পূর্ণ দোসর। এরা হবে শারীরিক দিক থেকে ভারতীয় এবং মানসিক দিক থেকে ইংরেজ। শাসকরা সফলকামও হয়েছিল। সুতরাং ভারতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্দেশ্যই ছিল উপনিবেশবাদীদের একটা অসৎ-উদ্যোগ। যদিও একটা সৎ-উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি করেছিল ভারতীয়রা। আর ঔপনিবেশিক শক্তি তা বারবার উপেক্ষাই করে যাচ্ছিল, সময় নিচ্ছিল ভেবেচিন্তে।
যখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলো দেখা গেল, লাভের গুড় পিঁপড়াই খাচ্ছে। পরবর্তীকালে যখন একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হচ্ছিল, আর তা ছিল মূলত কলিকাতা বা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্দেশ্যের একধরনের বিস্তার মাত্র। এর মূল উদ্দেশ্য কখনোই জ্ঞানতাত্ত্বিক ছিল না।
দ্বিতীয়ত, ইংরেজরা যে-‘ডিভাইড অ্যান্ড রোল’ পলিসি নিয়েছিল, শিক্ষাব্যবস্থা ছিল তার একটা কাঠামোগত পদ্ধতি। খেয়াল করা যাবে, ইংরেজরা মুসলমানদের জন্য প্রথমে কলকাতায় একটা মাদরাসা (১৭৮১) এবং হিন্দুদের জন্য বেনারসে একটা সংস্কৃত কলেজ স্থাপন (১৭৯২) করেছিল। এটা ছিল বিভেদের স্পষ্ট একটা উদ্যোগ। অন্যদিকে, মুসলমানরা শুরুর দিকে ইংরেজি শিক্ষার দিকে গেল না, কিংবা যেতে দেওয়া হলো না। তাদের জন্য মাদরাসা স্থাপন করে চূড়ান্ত বিষবৃক্ষ রোপণ করেই ছিল, পরে তার ডালপালা বিস্তারেও উদ্যোগ গ্রহণ করা হলো। এতে মুসলমানরা আরও যে স্থবির হলো তা নয়, তারা হয়ে পড়ল পশ্চাৎপদ এবং হীনমন্য। পূর্ববর্তী শাসনক্ষমতার অধিকারী মুসলমানকে এভাবেই কব্জা করেছিল ইংরেজরা। অর্থাৎ মাদরাসাগুলো স্থাপনেরও উদ্দেশ্য ছিল আরেক অসৎ-উদ্যোগ। বলা হলো, আলিয়া মাদরাসায় মুসলমানরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হবে। কিন্তু সেই আধুনিক শিক্ষার কোনো সংজ্ঞার্থ স্পষ্ট ছিল না; না-ধূর্ত ইংরেজদের কাছে, না-অভিমানী মুসলমানদের কাছে। দেখা গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মাদরাসাগুলোতে শুরু থেকে ঢুকে পড়ল নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি। ভারত বা বাংলাদেশের মাদরাসা থেকে উপযোগবাদী শিক্ষা নিয়ে বেরিয়ে আসছেন শিক্ষার্থীরা, এমনটা আজ অবিশ্বাস্য। মাদরাসায় প্রযুক্তি জ্ঞান কিংবা চিকিৎসাবিজ্ঞান কিংবা তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব কিংবা দর্শনচর্চা এখন এক পরাবাস্তব চিন্তামাত্র।
তৃতীয়ত, উপনিবেশবাদীদের মূল উদ্দেশ্য যেহেতু ছিল সহযোগী শাসকশ্রেণি তৈরি করা, ভারতের অনুষঙ্গ বাদ দিলেও আজকাল বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বলতে গেলে পেশাজীবী শ্রেণিই তৈরি করছে মাত্র। ফলে জ্ঞানচর্চা কিংবা ‘মানুষ হয়ে ওঠা’র বদলে পরীক্ষায় প্রথম হওয়া, উচ্চতর সিজিপিএ পাওয়া, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য সার্টিফিকেট অর্জন হয়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। জ্ঞানচর্চা একান্তই গৌণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর যে-উদ্দেশ্য নিয়ে এদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা, ভারত-স্বাধীনের ৭০ বছর এবং বাংলাদেশ স্বাধীনের ৪৬ বছর পরও উভয়দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি হচ্ছে একধরনের নব্য ইংরেজদের, নব্য এক শাসকশ্রেণির সহযোগী শক্তির। যে-চরিত্রহীন বুর্জেয়া সমাজ থেকে রাজনৈতিক শক্তির উত্থান হচ্ছে, রাজনৈতিক দল গঠিত হচ্ছে তাদেরই ‘শাসন-সহযোগী শক্তি’ উৎপাদন করছে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ। দেখা যাবে, চাকরিতে যোগদানের পর এই সহযোগীরা সাধারণ মানুষ থেকে একেবারেই আলগা হয়ে যায়। পেশায় এরা শিক্ষক, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার, আমলা, পুলিশ, করপোরেট যা-ই হোক না কেন? এরা শুধু নিজের মুনাফাই সন্ধান করে আর রাষ্ট্রকে মনে করে তাদের পৈতৃক তালুক। অথচ, এদের অনেকেই ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’! শিক্ষাপ্রশাসনের আমলাদের মাথায় রেখেও আমি কথাগুলো বলছি। এমনকি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের ক্ষেত্রেও। বেশিরভাগ ‘সার্ভেন্ট’ স্বীকারই করতে চায় না, তারা এদেশের সাধারণ মানুষের টাকায় পড়াশোনা করেছে কিংবা তারা মাসান্তে যে-বেতন পায় তাও দেয় এদেশের গরিব-মেহনতি মানুষ। কৃতজ্ঞতাবোধ তো দূর অস্ত।
এখন, আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এরূপ মানবিক বোধ জাগ্রত না-হওয়ার পেছনে কারণটা কী? অথবা, কথার উলটো পিঠে উত্তরটাও হয়ত নিহিত রয়েছে! অবশ্য এ-কথার অর্থ এই নয় যে, সকলের ক্ষেত্রেই এটা সমানভাবে প্রযোজ্য। অনেকে নিশ্চয়ই এর ব্যতিক্রম আছেন, না-হলে দেশ এমন সামনের দিকে এগুতো না।
৩
বলতে গেলে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যখন যৌবন কাল, অন্তত জ্ঞানচর্চার জায়গা থেকে কিংবা ‘বিশেষ ধরনের মানুষ বানানোর এজেন্ডা’র ক্ষেত্রে, রবীন্দ্রনাথ তখন আসীন। তিনি ইতোমধ্যে যা বুঝার বুঝেছিলেন এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিক্রিয়া হিসেবে নিজেই বিশেষ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হলেন, যেটা শান্তিনিকেতন বা আজকের বিশ্বভারতী নামে পরিচিত। রবীন্দ্রনাথ নিজে আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংজ্ঞার্থ নির্ধারণ করেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যও ভেবেছিলেন। কেননা, তিনি ইতিমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনও করে ফেলেছেন, ইউরোপ থেকে আমেরিকায়, স্পেন থেকে চীন-জাপানে। তিনি বুঝেছিলেন এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বারো আনাই ফাঁকি’। সুতরাং এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়কে হতে হবে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-জ্ঞান, এমনকি ভূমিব্যবস্থাপনা সহ সবকিছু বিবেচনা করেই। ‘নিজ’ ও ‘অপর’-এর জ্ঞান ও শিক্ষাকে যুগপৎ কাজে লাগিয়েই তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য প্রতিবিধান করতে হবে।
রবীন্দ্রনাথের কাছে তথাকথিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রধান ও একদেশদর্শী! রবীন্দ্রনাথ চেয়েছেন প্রজন্মকে এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে, যা পরিপূর্ণভাবে বাঁচার শিক্ষা দেবে, মানুষকে বিচ্ছিন্ন নয়, শিক্ষার মাধ্যমে মানুষে মানুষে হবে সম্মিলন। রবীন্দ্রনাথ সেইসব শিক্ষার্থীকে কখনোই স্বীকৃতি দেন নি, যারা, রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘মরা মন নিয়ে পড়া মুখস্থ করে পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীর ঊর্ধ্ব শিখরে’ ওঠে। রবীন্দ্রনাথের পর্যবেক্ষণ ছিল, এইসব ‘ভালো ছেলে’ রেজাল্টের জোরে ‘পদবী অধিকার করে, জগৎ অধিকার করে না।’ অন্যদিকে যারা শিক্ষার্থীদের পরিপূর্ণভাবে বাঁচার শিক্ষা দেবেন তাদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা ছিল আরেকটু উচ্চ, তিনি চেয়েছেন এমন ধরনের শিক্ষক, যারা শিক্ষকতাকে একটা পেশা মনে করবে না, মনে করবে এটা একটা ব্রত।
রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘যাদের দৃষ্টি বইয়ের সীমানা পেরিয়ে গেছে, যারা চক্ষুষ্মান, যারা সন্ধানী, যারা বিশ্বকৌতূহলী, যাদের আনন্দ প্রত্যক্ষজ্ঞানের বিষয়ান্তরে, যাদের প্রেরণাশক্তি সহযোগিমণ্ডল তৈরি করতে পারে।’ রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালেই, শান্তিনিকেতন প্রশ্নে তাঁর আশাভঙ্গ হয়েছিল। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয় ক্ষেত্রেই। শুধু তাই নয়, বিশ্বভারতী পরে সরকারিকরণ হলে, আস্তে আস্তে তা রবীন্দ্র আদর্শ থেকেও অনেক দূরে চলে যায়। এবং সেখানেও শুরু হয় রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি, পরচর্চা, পরশ্রীকাতরতা, পদোন্নয়নের দৌড়ঝাঁপ, ডিগ্রি ডিগ্রি খেলা, চাটিুকারিতাবৃত্তি ও আখের-গোছানোর মতো হীনকর্ম। যেমনটা আজকের বাংলাদেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাধারণ চারিত্র্য হয়ে দাঁড়িয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না।
৪
শুরু করেছিলাম সুহৃদ সহকর্মীর গল্পের প্রসঙ্গ দিয়ে এবং সেখানে আবার ফিরে যেতে চাই আমি। তার ভেতরে যে-খেদ লুকিয়ে আছে কিংবা তার মন্তব্যের প্রতি যে আমার সহমত, তা কেন? এটা কি এই জন্যে যে, আমরা দুজন কোনো বিষয়ে বঞ্চিত হয়েছি বলে তা একদেশদর্শী চিন্তা, নাকি এখানে কোনো ‘কঠিন বাস্তব’ লুকিয়ে আছে? এখানে ব্যক্তিগত স্বার্থ থেকে উপলব্ধ হচ্ছে, বিষয়টা এমন নয়। বিশ্ববিদ্যালয় একটি সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান এবং সেখানকার আইনকানুন নিজেদের মতো। কিন্তু এইসব আইনকানুন তৈরি বা রদবদলের নানা প্রক্রিয়া-পদ্ধতিও আছে। যদি থেকে থাকে তাহলে ‘বিশেষ উদ্দেশ্যে’ আইন কারা তৈরি করেন কিংবা বিভিন্ন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তা পাশই-বা হয় কিভাবে? এখানেই ‘হেতু’ লুকিয়ে আছে। সব বিশ্ববিদ্যালয়েই সিন্ডিকেট রয়েছে, এবং এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর এবং সকল অর্থেই তা ইতিবাচক শব্দ। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়-প্রশাসনের পরিভাষার বাইরে ‘সিন্ডিকেট’ শব্দটি নেতিবাচক অর্থেও ব্যবহৃত হয়। যেমন ‘বাস-মালিক সিন্ডিকেট’ বা ‘চাল-ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট’ ইত্যাদি। সে-হিসেবে প্রশাসনে বাইরে সব বিশ্ববিদ্যালয়েই বিভিন্ন ‘সিন্ডিকেট’ আছে অনেক শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর ভেতরে, গোপনে গোপনে অথবা প্রকাশ্যেই। আসলে তারাই বিভিন্নভাবে প্রশাসনিক ‘সিন্ডিকেট’কে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন, হয়ত সফলও হন কোনো কোনো ক্ষেত্রে। তারা ভিসিদের ভয় দেখান, শাসান আর কোথাও কোথাও ভিসিরাও শেষতক প্রভাবিতও হন। নিজেদের অমতের বাইরে অনেককিছু করে বসেন। কেউ কেউ সে-সব ‘সিন্ডিকেট’কে প্ররোচনাও দেন কাজতে করতে বাধ্য হওয়ার জন্য, আইওয়াশ হিসেবে। এটা হচ্ছে নির্মম সত্য একটা কথা। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে আছেন, তাদের অনেকে ভালোভাবেই বিষয়টা জানেন। এসব ‘সিন্ডিকেট’ কাউকে পুরস্কৃত করে, কাউকে বঞ্চিত করে। কারো-বা ন্যায্যতা কেড়ে নেয়, কাউকে অন্যায্যভাবে উপঢৌকন দেয়। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে, অথবা ভিসি বদলের সঙ্গে সঙ্গে এ-সব ‘সিন্ডিকেট’ কাঠামোগত রূপ ধারণ করে নানাভাবে। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্ভাগ্য এই পথ দিয়েই ঢুকে। অবশ্য এর সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতি, দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি, স্বার্থপরতা এবং স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি।
এর ফলে যেটা হয়, বিশেষ করে যোগ্যতার ক্ষেত্রে; ফলাফল তৈরিতে, নিয়োগে কিংবা পদোন্নতিতে। অনেক যোগ্য লোক এতে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হন, তেমনি লাভবান হন তুলনামূলকভাবে অনেক অযোগ্য লোকগুলো। কেননা, অযোগ্য লোকগুলো অযোগ্য বলেই ‘লম্ফঝম্প’ করে বেশি। কিন্তু যারা যোগ্যকে মাড়িয়ে তুলনামূলক কম অযোগ্যকে নিয়োগ বা পদোন্নতি বা অন্য কোনো সুবিধা দেন তারা নিজেও জানে না, বিশ্ববিদ্যালয় তো বটে, দেশটারও কতো বড়ো ক্ষতি করলেন। অথবা জেনেশুনেই হয়ত কাজটা করেছেন। আমার আরেক সহকর্মী বন্ধু এদের সবসময় ‘জ্ঞানপাপী’ বলে অভিহিত করেন। অবশ্য এ-ব্যাপারে আমার অভিমত হচ্ছে, অযোগ্য লোক একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটা অভিশাপ। তার যদি চাকরির এতই দরকার হয়, বা চাকরি প্রদান বাধ্যতামূলক হয়, তাহলে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ বা পদোন্নতি না-দিয়ে রাষ্ট্রীয়/বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে বরং ৪০ বছরের এককালীন বেতন দিয়ে দেওয়া অনেক ভালো। এতে দেশের অর্থের অপচয় হয়ত হবে, কিন্তু লোকটি অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়ের বা দেশের বা প্রজন্মের ক্ষতি করতে পারবে না। একটি অযোগ্য লোক একটা গোটা বিভাগের সর্বনাশ করে দিতে পারে, এমনকি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারসাম্যও নষ্ট করে দিতে পারে।
একবার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন এক ভিসি মহোদয়ের অফিসকক্ষের পাশের ওয়েটিং রুমের বসে আছি সাক্ষাতের জন্য, হঠাৎ দেখি দেয়ালে বোর্ডে পিন দিয়ে আটকানো শাদা কাগজে একটা মন্তব্য জ্বলজ্বল করছে, ‘অযোগ্য লোকই অযোগ্য লোককে হাতছানি দিয়ে ডাকে।’ বা ওইরকম কিছু। রসিক ও নির্দয় (!) এই ভিসি মহোদয়ের নাম হলো অধ্যাপক মো. সালেহ উদ্দিন। হালকা-পাতলা লোক, কিন্তু তেজ ছিল অলোকসামান্য। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে তার অনেক অবদান আছে। যাই হোক, শাহজালালের দুই-টার্মের ভিসি মহোদয় বৃথা এই কথাগুলো বোর্ডে সেঁটে রাখেননি, এটা তার নিছক রসিকতাও নয়। এ-প্রসঙ্গে স্থান বিশেষে আরেক নির্মম (!) ভিসি মহোদয়ের কথাও বলা যাবে, তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সখ্য ছিল, তবে তার সময়কালীন আমি অন্যত্র চাকরি করতাম।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য