আজ বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

Advertise

আমার শৈশব-কৈশোরের দুখু মিয়া!

আব্দুল করিম কিম  

দুখু মিয়া, আজ তোমার জন্মদিন। তোমার জন্মজয়ন্তীতে ফেইসবুকে সবার স্ট্যাটাস বর্ষণ দেখে আমারও কিছু কথা লিখতে মন চাইছে। তোমারে সঙ্গে আমার কবে প্রথম পরিচয় হয়েছিলো সেটা পুরো মনে নাই কিন্তু আমার মনে আছে তোমার বিদায় দিনের কথা, ২৯শে আগস্ট ১৯৭৬ ইংরেজি।



আমার আব্বা, বড় চার বোন সবাই কাঁদছেন। রেডিওতে সারাদিন বেজে চলছে 'মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই' গানটি। আমার মনে কত প্রশ্ন 'তুমি কিভাবে জানলে, তুমি মরে যাবে? এখন কে তোমাকে কবর দিবে? আমার বয়স তখন সাড়ে তিন বছর। আমাদের বাসায় কোন টিভি ছিল না। ছোট চাচার বাসায় ১৪ ইঞ্চি সাদাকালো টেলিভিশনে তোমাকে শেষ দেখা দেখতে যাই। সাদা কাপড়ে জড়ানো তোমার মৃতদেহ। পিজি হাসপাতালে তোমাকে দেখতে মানুষের ঢল। তুমি পিজিতে থাকার সময় আমার এক ফুফুতো বোন (লনী আপা) ইন্টার্র্নি ডাক্তার হিসাবে তোমার সেবা করেছিলেন। তোমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়ার একটি সাদাকালো ছবি প্রিন্ট করে তিনি পাঠিয়েছিলেন আব্বাকে। ছবিটি আমাদের পারিবারিক এ্যালবামে অত্যন্ত মর্যাদা নিয়ে সংরক্ষিত আছে।



এছাড়া 'ইত্তেফাক' পত্রিকায় সে সময় ছাপা হওয়া তোমার প্রায় ছবিই আপামনি কেটে রেখেছিলেন। সেই ছবি দিয়ে বানানো এ্যালবাম দেখে দেখে তোমার চেহারা আমার ভালোই মনে ছিল। তোমার ঝাঁকড়া চুলের যৌবনের ছবির চেয়ে ঘুরেফিরে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়া বড় বড় চোখের আসহায় মুখটি আমার মনে বেশি ভাসে। সেদিন টিভিতে তোমাকে নিয়েই সব অনুষ্ঠান ছিল। ঘনঘন কোরআন তেলাওয়াতের ফাঁকে ফাঁকে তোমার লেখা হামদ ও নাত শুনি। আমার বড় বোন আপামনি'র কণ্ঠে এসব হামদ-নাত আমার অনেক শোনা হয়েছে।



আপামনির (আসমা বেগম) সঙ্গে যখন তোমার হামদ 'আল্লাহ আমার প্রভু আমার নাহি নাহি ভয়, আমার নবী মোহাম্মদ, যাহার তারীফ জগৎময়' প্রথম শুনি ও গাই সেদিন থেকে আমি বিশ্বাস করতাম 'আল্লাহ আমার প্রভু' এই জন্য আমার কোন ভয় নাই। আমি নবী মোহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে প্রথম আগ্রহবোধ করি যখন শুনি 'তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে- মধু-পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ দোলে'। এই নাত শুনে নবীর জন্ম বৃত্তান্ত শোনার আগ্রহ হয়। একদিন রেডিওতে আব্দুল আলীমের কণ্ঠে 'মনে বড় আশা ছিলো যাবো মদিনায়' গানটি বাজতে শুনি আর দেখি আব্বার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে। শৈশবে আমার কাছে তুমি ছিলে হামদ-নাতের রচয়িতা। যদিও তোমার আরও গান শুনেছি সে সময় আপার কণ্ঠে। আপাকে গান শেখাতে আসতেন 'ওস্তাদ ফূল মোহাম্মদ'।



আমি আপামনির শিষ্য হয়ে হারমোনিয়াম বাজানো দেখতাম। আর নানান ভাবে উপদ্রব করতাম। 'ওস্তাদ ফূল মোহাম্মদ'- অনেক বড় মাপের শিল্পি। সিলেটে নজরুলগীতি শেখার জন্য তাঁর শিস্য হওয়া সৌভাগ্যের বিষয়। ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদের শিস্য'র শিস্য হয়ে তোমার গান শিখতে বসতাম। তখনো স্কুলে ভর্তি হইনি। বই-পুস্তক পড়া হয়নি। তাই তোমার কবিতা জানতাম না। দিদিমণি (শাহানা বেগম) ঘুম পাড়াতে গিয়ে একদিন ‘লিচুচোর’ শোনালো। বাবুদের তালপুকুরে হাবুদের ডালকুকুরে সে কি বাস করলে তাড়া বলি থাম একটু করি দাঁড়া ... তালপুকুর, ডালকুকুর, লিচুচুরি-এই সব আমার কাছে নতুন বিষয়। চোখ বন্ধ করে লিচুগাছ দেখতাম আর ভাবতাম আমিও লিচু চুরিতে যাবো। তোমার মত ধরা খাবো না। আমাদের বাসার পিছনে ছিল খোলা প্রান্তর। সেখানে বুনোফুলে প্রজাপতির ওড়াওড়ি দেখতাম। সেই প্রজাপতির পিছনে দৌড়ে দৌড়ে গান গাইতাম 'প্রজাপতি প্রজাপতি কোথায় পেলে ভাই, এমন রঙ্গিন পাখা?'



১৯৮০ সালে স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ক্লাসের সিলেবাসে তোমাকে পেলাম। তোমার দুখু মিয়া নাম জানলাম। তোমার নাম দুখু মিয়া কেন হল- এটাই আমার বোধগম্য ছিল না। তুমি লেটো দলে যোগ দিলে, পড়াশোনা নিয়ে যন্ত্রণা নেই। রুটির দোকানে চাকরি কর- কত মজা। তোমার নাম হবে 'সুখু মিয়া' । আমার তোমার মত বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে কোন গানের দলে যোগ দিতে মন চাইতো। ১৯৮২ সালে পাড়ার মসজিদে ঈদ-ই-মীলাদুন্নবী (সাঃ) উপলক্ষ্যে আয়োজিত হামদ-নাত প্রতিযোগিতায় 'মোহাম্মদের নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে' -তোমার নাত গেয়ে জীবনে প্রথম পুরস্কৃত হই। সেই পুরস্কারও ছিল- তোমার শিশুতোষ জীবনী। এরপরেও জীবনে আরও অনেকবার নাত গেয়ে পুরস্কৃত হয়েছি। তোমার হামদ-নাতের বাইরে যে গানের আরও বিশাল ভাণ্ডার আছে তা খেয়াল করি ভবানী চাচার কাছে গান শিখতে বসে।



গান অবশ্য আমি শিখতে বসতাম না। বসতো দিদিমণি। আব্বার এক নাতির বন্ধু ভবানী সিনহা (বর্তমানে হাই-কোর্টের বিচারপতি) ছিলেন সেই নজরুলগীতি শেখানোর শিক্ষক। তিনি দরদ মাখা কণ্ঠে 'গঙ্গা-সিন্ধু-নর্মদা-কাবেরী-যমুনা ঐ, বহিয়া চলেছে আগের মত কইরে আগের মানুষ কই?' কিংবা 'যবে তুলসী তলায় প্রিয় সন্ধ্যা বেলায়/ তুমি করিবে প্রণাম/ তব দেবতার নাম ভুলিয়া বারেক/ প্রিয় নিও মোর নাম'। গাইতেন আর আমি মুগ্ধ হয়ে তোমার সৃষ্টি উপলব্ধি করতাম।



১৯৮৫ সালে প্রথম শুনি তোমার শ্যামা সংগীত। এতদিন তোমাকে একভাবে চিনতাম, শ্যামা সংগীত শুনে তোমাকে অন্য ভাবে চিনলাম। অনুপ জালোটার কণ্ঠে 'সখী সে হরি কেমন বল/ নাম শুনে এতো প্রেম আসে চোখে আনে এতো জল'- আমি শুনতাম আর চোখে জলের আনাগোনা বুঝতে পারতাম। ১৯৮৭ সালে অগ্নিবীণা মুখস্ত করতে শুরু করলাম। পড়ার টেবিলে বসে পড়ার বই ভালো লাগে না।



'বিদ্রোহী' মুখস্ত করি। ক্লাস এইটে বা নাইনে হাফ-ইয়ার্লি পরিক্ষায় ইংলিশ ২য় পত্র পরিক্ষা। কিছু পারিনা। পরিক্ষা থেকে ওঠে যাওয়া যাচ্ছে না। কিছু না লিখে এমনি এমনি বসে থাকবো কিভাবে? শুরু করলাম 'বিদ্রোহী' কবিতা লিখা। পুরো কবিতা লিখে সময় কাটালাম। ক্লাস টিচার পাঞ্চালী পাল পান্না টিচার। টিচারের কথায় আগুনের তেজ। রেজাল্ট বের হল, এই বিষয়ে যথারীতি অকৃতকার্য হলাম। টিচার সবার সামনে অপমান করলেন না, কিন্তু ডেকে নিয়ে বললেন, এর মানে কি? ইংরেজি পরীক্ষায় বাংলা কবিতা লেখার অর্থ কি? আমি মাথা নিচু, কি বলবো? শুধু বললাম, টিচার আমি ছাত্র খারাপ না-এটা বোঝানোর জন্য লিখেছি। আমার স্মরণশক্তি ভালো। টিচার বললেন, পরীক্ষায় সব বিষয়ে যে ছাত্র পাস করে না সে খারাপই।



দুখু মিয়া, তোমাকে নিয়ে এরপর দীর্ঘদিন কোন ঘাটাঘাটি করিনি। তোমার প্রচুর গান শুনেছি,গল্প-উপন্যাস পড়ে নিয়েছি ইতিমধ্যে। ১৯৯৮-২০০৫ পর্যন্ত সময়ে তোমাকে নিয়ে আবারো ঘাঁটাঘাঁটি করি। তুমি প্রমীলা দেবীকে কি করে বিয়ে করেছিলে তা জানতে চেয়েছি সে সময়ে। তোমার মত আমারো একজন 'প্রমীলা দেবী'কে বিয়ে করতে ইচ্ছে করছিলো। আমার অবশ তোমার নাতনী খিলখিল কাজী'কেও বিয়ে করতে ইচ্ছে করেছিলো। ১৯৯৫-৯৭ সালের মধ্যে কোন এক সময় তোমার কবরের পাশে তাকে দেখেছিলাম। তাঁকে দেখে তাঁর প্রেমে পড়ে যাই। আমি কলকাতার ঠিকানায় ও ঢাকায় 'কবি ভবন'-এর ঠিকানায় প্রেমপত্র পাঠাই। আমার এখনও বিশ্বাস চিঠি তাঁর হাতে পৌঁছেনি। পৌঁছালে নির্ঘাত তুমি আমার দাদা শ্বশুর হতে।



ভালো কথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তোমার কবরের পাশে একাধিকবার বসে তোমার খোঁজখবর আমি নিয়েছি। দুখু মিয়া, তুমি মসজিদের পাশে কবর চেয়েছিলে 'আযান' শুনবে বলে কিন্তু তোমাকে বোনাস আরও অনেক কিছু শুনতে হচ্ছে। দুখু মিয়া, আমি নানান ভাবে তোমাকে অনুসরণ করতে চেয়েছি, কিন্তু মাঝপথে গিয়ে থেমে গেছি। তোমার মত দেশপ্রেমিক, মানবপ্রেমিক, খোদাপ্রেমিক, নবীপ্রেমিক বা নারীপ্রেমীক কিছুই হতে পারলাম না। তোমার মত পালিয়ে যেতে পারলাম না, 'লিচুচোরও হলাম না। তোমার গানও শেষ পর্যন্ত শিখলাম না। কবিতাও ভুলে গেছি দুখু মিয়া। কেবল এখনো তোমার মত দেশপ্রেমিক হওয়ার স্বপ্ন দেখি। এখনও অসাম্প্রদায়িক হওয়ার চেষ্টা করি। তোমার মত বিদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে, সব কিছু ভেঙ্গে দিতে ইচ্ছে করে কিন্তু কিছুই পারি না দুখু মিয়া!


 

আব্দুল করিম কিম, সমন্বয়ক, সিলেটের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ও প্রকৃতি রক্ষা পরিষদ।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ১৯ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৮৯ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ