আজ বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

উৎপলকে ফিরিয়ে দিন

এস এম নাদিম মাহমুদ  

উৎপলের জন্মদিন চলে গেলো। সদা হাসিখুশি ও প্রাণবন্ত যে ছেলেটি এতদিন অন্যদের জন্মদিন পালনের জন্য নিজেই কেক কিনে চমকে দিতো, সেই ছেলেটিই এবার নিজের জন্মদিনে বন্ধুদের কাছে বড় বিস্ময় হয়ে রইলো!

সাংবাদিক উৎপল দাসের কথা বলছি। একটি অনলাইন পোর্টাল পূর্বপশ্চিমবিডিনিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক হিসেবে ঢাকায় কর্মরত ছিলেন। গত ১০ অক্টোবর দুপুরে রাজধানীর মতিঝিলে নিজ অফিস থেকে বের হওয়ার পর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন এই সাংবাদিক। একজন জলজ্যান্ত মানুষ নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়া কষ্টকর।

যে ছেলেটি আমার জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতো, গতকাল ফেইসবুকে তার জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে চোখের কোণে জল জমে গেলো। আমরা এখন তার জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি চোখের জল বিসর্জন দিয়ে। কিন্তু কেন?

সাড়ে ছয় বছর আগে, যখন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে কাজ শুরুই করিনি, তার আগে আমি দৈনিক যায়যায়দিনের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলাম। ২০১১ সালের গোড়ার দিকে যায়যায়দিনে ‘রাবিতে আত্মহত্যার মিছিল থামছে না’ নামে এক বিশেষ প্রতিবেদন পত্রিকাটির শীর্ষ সংবাদ হিসেবে প্রকাশিত হওয়ার পর ফেইসবুকে হঠাৎ যে ব্যক্তিটি শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছিলো, তিনি এই উৎপল দাস।

যায়যায়দিনের বিজনেস বিটে দীর্ঘদিন কাজ করা এই সাংবাদিক আমাদের চেয়ে বয়েসে বড় হলেও গত কয়েক বছর ধরে তিনি ছিলেন বন্ধুর মতো। আমাকে ছোট ভাই হিসেবে সম্বোধন করতো। বিভূঁইয়ে পড়তে এসেও নিয়মিত খোঁজ-খবর নিতো। এই ছয় বছর তার অনেক সাহসী কর্মকাণ্ড ফেইসবুকের কল্যাণে দেখতাম।

সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ে সর্বদা সচল থাকা সাংবাদিক উৎপল দাসের নিখোঁজের খবর যখন প্রথম শুনেছি, তখন তো বিশ্বাসই করতে পারিনি। চঞ্চল এই ছেলেটি কীভাবে নিখোঁজ হতে পারে, তা ভাবতে খুব কষ্ট হচ্ছে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং পেশা হলো- সাংবাদিকতা। প্রতি মুহূর্তের ঝুঁকি সামলে যে পেশাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়, সেই পেশাটির কর্মীদের নিরাপত্তাহীনতা সত্যিই উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের যেকোনো পেশার চেয়ে অনিরাপদ এই পেশায় জাতির চতুর্থ স্তম্ভের ইট-সুরকি জোগান দিলেও বছরের পর বছর তা অরক্ষিত থেকে গেছে।

আমরা নিগৃহীত কিংবা ভুক্তভোগীর অধিকার আদায়ে লিখি, আমরা সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরি, আমরা দেশের মঙ্গলের জন্য আমাদের মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলো সচল করি সর্বদা। কিন্তু আমাদের দীনতা দেখার মতো কেউ থাকে না। যারা অন্যের খবর লেখে, তাদের খবর লেখার মতো কেউ থাকে না। কেউ বলে না তাদের অধিকারহীনতার কথা।

গত কয়েক দশক ধরে দেশে সাংবাদিক নির্যাতন, হত্যা, গুম ইত্যাদি নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সহকর্মীরা নির্যাতিত হলে আমরা কিছুদিন রাস্তায় নামি, সাংবাদিক সংগঠনগুলো কিছুদিন তৎপর হয়, এভাবে কিছুদিন চলার পর আমরাও মুখ ফিরিয়ে নেই। আশার আশ্রয়ে দখল নেয় হতাশা। এভাবে হচ্ছে, হবে বলেই মেনে নেই সবকিছু।

তাই যারা সাংবাদিক পেটায়, সাংবাদিকদের হেনস্তা করে, তাদের বুকের খাঁচা প্রসারিত হয় অনায়াসে। তারা মনে করে, সাংবাদিক নির্যাতন করলে কয়েকদিন পত্রিকার শিরোনাম হওয়া যায়, এরপর তা তেলহীন প্রদীপের মতো টিমটিম করে জ্বলে নিভে যায়। তাই এই দেশে সাংবাদিকরা সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।

উৎপল দাসের মতো একজন তরুণ সাংবাদিক দিনে-দুপুরে রাস্তা থেকে উধাও হয়ে গেলো আর আমরা তা চেয়ে দেখছি? মতিঝিল থানায় যে সাধারণ ডায়েরিটি (জিডি) করেছে পূর্বপশ্চিমবিডিনিউজ কর্তৃপক্ষ, সেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, গত ১০ অক্টোবর দুপুর ১টার দিকে কাজ শেষে অফিস থেকে বের হন উৎপল দাস। এরপর থেকেই তিনি নিখোঁজ। তার ব্যবহার করা দুইটি মোবাইল নম্বরই বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

এরপরও আমাদেরকে গত দুই সপ্তাহ ধরে কোনো আশার কথা শোনাতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আমরা জানি, দেশের প্রযুক্তি ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। অপরাধীদের ধরতে মোবাইল ট্র্যাকিং কাজে দিলেও উৎপল দাসের নিখোঁজের কোনো তথ্য বস্তুত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাংবাদিকদের কিংবা তার পরিবারকে দিতে পারেনি।

গত ২৬ অক্টোবর রাজধানীতে সংবাদ সম্মেলন করেছে উৎপলের পরিবার। উৎপলের বাবা চিত্তরঞ্জন দাস একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। তিনি বলেছেন, “আমি অতি সাধারণ মানুষ, শিক্ষকতা করে জীবন চালিয়েছি। আমাদের কোনো শত্রু নেই। আমরা আমাদের সন্তানকে অক্ষত অবস্থায় ফিরে পেতে চাই।”

তার বাবা-মা আর বোনের চোখের জল আমাদের সবার চোখের জল হতে পারেনি। তাই সাংবাদিক সংগঠনগুলোও তাদের সহকর্মীকে হারিয়ে তেমন ব্যথিত হয়নি। আমরা কেবল কয়েকজন উৎপলের নিখোঁজ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছি ফেইসবুকে। উৎপলের বন্ধুরা প্রতিদিন আশায় দিনাতিপাত করছে।

উৎপল দাসের চিন্তার সাথে হয়তো সবার মননে মিলবে না, তবে তার সাংবাদিকতার নেশার সাথে অনেক সাংবাদিকের মেলবন্ধন দেখতে পাই। অত্যন্ত মিশুক স্বভাবের এই মানুষটি হারিয়ে অন্যান্য সাংবাদিকদের মনে কেবল শঙ্কায় জন্ম দেয় না, দেয় নিরাপত্তাহীনতার বার্তাও।

আমি সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি, যখন গত কুঁড়ি দিন ধরে সাবেক এই সহকর্মীর নিখোঁজের খবর গণমাধ্যমে আসার পরও আমরা অনেকটা নিশ্চুপ রয়েছি। সাংবাদিকদের অধিকারের আদায়ের সংগঠনগুলোও মুখে কুলুপ এঁটেছে।

আজ উৎপল দাস সাংবাদিক না হয়ে একজন মটর শ্রমিক হতেন, তাহলে দেখতেন তার সহকর্মীদের উদারতা। দেখতেন, সহকর্মীকে ফিরিয়ে আনতে তারা কীভাবে দাবি আদায়ের জন্য মাঠে নামে। সবকিছু অচল করে দেওয়ার হুমকিও দিতো মটর শ্রমিকরা।

সাংবাদিক উৎপল দাস যদি সাংবাদিকতা না করে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কর্মী হতেন, তাহলে বুঝতেন রাজনৈতিক ক্ষমতার গাঢ়ত্ব। দেখতেন, সহকর্মীকে স্বজনের কাছে ফিরিয়ে আনতে তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম।

আমরা ব্যর্থ হচ্ছি বারবার। আমাদের মতো পেশার মানুষরা সবসময় নির্যাতিতই থেকে যাচ্ছে। দেশের ডজন ডজন সাংবাদিক সংগঠন থাকলেও তারা মূলত নিজেদের দাবি আদায়ে সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারছে না। নিরাপত্তাহীনতার পরও যারা এই পেশায় আসছে, তারা ধরে নিচ্ছে- সৎ সাংবাদিকতায় হয়তো তার প্রাণ বিসর্জনও দিতে হবে। তার স্বজনরা প্রতিনিয়ত উৎকণ্ঠায় থাকলেও কেবল রক্তে মিশে থাকা সাংবাদিকতার টানে উৎপল দাসেরা সত্যের পক্ষে লিখে যাচ্ছে।

আমরা জানি না, উৎপল দাস কারও বিরাগভাজন হয়েছিলেন কিনা। তবে তার সাংবাদিকতার কারণে তিনি অনেকেরই চক্ষুশূল হতে পারেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। উৎপলের জন্য এখনও কোনো মুক্তিপণ চাওয়া হয়নি। তার মানে ধরে নিতে হচ্ছে, উৎপলকে অপহরণ করা হয়নি। তাকে অত্যন্ত সূক্ষ্ম পরিকল্পনায় তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তার অবস্থান আগে থেকেই হয়তো অপরাধী চক্র অনুসরণ করেছিলো।

আমরা জানি না, উৎপল’দা কোথায়-কীভাবে রয়েছেন। আমরা এটুকু বিশ্বাস করি, তিনি সুস্থ রয়েছেন। আমরা এটাও বিশ্বাস করি, সরকারের ঐকান্তিক ইচ্ছায় সবকিছু করা সম্ভব। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দূরদর্শিতায় অবশ্যই উৎপল দাসকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। উৎপলকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিন।

এস এম নাদিম মাহমুদ, গবেষক, ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ