আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

সিলেটিরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন করেছিলেন কেন?

জফির সেতু  

অকটোবর মাসের মাঝামাঝিতে ‘সিলেটমনীষা : জীবনীসিরিজ গ্রন্থপ্রণয়নে কর্মশালা ও লেখক-আড্ডা’ অনুষ্ঠানে আমাকে ‘ভবিষ্যৎ সিলেটের শিক্ষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতি’-শীর্ষক ধারণাপত্র উপস্থাপনের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন প্রকল্প-পরিচালক। হলভরতি লেখক-গবেষক-শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিকের সামনে কথা বলতে গিয়ে আমি সিলেটের পেছনের দিকে ফিরে তাকাই, কিন্তু বিষন্নতা  ছেয়ে বসে আমাকে। এ-লেখাটি সে-অর্থে অতীতের প্রতি দৃকপাতমূলক এবং হিসাব-নিকাশের। যদিও এর লক্ষ্যবিন্দু দূর ভবিষ্যতের দিকেই।

ভূ-রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ও ঔপনিবেশিক বাস্তবতার কারণেই সিলেটে ইংরেজি শিক্ষার সূচনা হয়েছিল একটু দেরিতেই। উনিশশতকের মাঝামাঝি থেকে। কিন্তু দ্রুতই সিলেটে ইংরেজি শিক্ষার পত্তন সাধিত হয়েছিল এবং অঞ্চলটি উচ্চশিক্ষার দিকে ধাবিত হয়েছিল। রাজা গিরিশচন্দ্র রায়ের বদান্যতায় ১৮৯২ সালে মুরারিচাঁদ কলেজও প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ছিল আসামের প্রথম ও বাংলার দ্বিতীয় কলেজ। আসামের দ্বিতীয় কলেজ ছিল গৌহাটিতে অবস্থিত কটন কলেজ (১৯০১) এবং বাংলার প্রথম কলেজ ছিল প্রেসিডেন্সি কলেজ। ১৯১২ সালে মুরারিচাঁদ কলেজ রাষ্ট্রায়ত্ত হয় এবং প্রথম শ্রেণির কলেজেও উন্নীত হয়। ১৯১২ ও ১৯২০ পৃথক দুই ‘দরবারে’ তদাননিন্তন আসামের দুই চিফ কমিশনারের বক্তব্য সিলেটের উচ্চশিক্ষার নতুনভাবে উন্মোচিত হয়। এই দুই চিফ কমিশনার হচ্ছেন যথাক্রমে স্যার আর্চডেল আর্ল ও স্যার এনডি বিটসন বেল। এরা দুজনই মুরারিচাঁদ কলেজকে কেন্দ্র করে সিলেট-আসামে উচ্চতর একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বপ্ন দেখেছিলেন। চিফ কমিশনারের একজন বলেছিলেন, এখানে শুধু একটা কলেজ স্থাপনের সূচনা করছেন না, বরং অক্সফোর্ড ও কেম্ব্রিজ জাতীয়ও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা অনুষ্ঠান সম্পন্ন করছেন। এই কথার প্রতিধ্বনি ছিল পরবর্তীজনের বক্তব্যেও। সেই-বক্তব্য অনুষ্ঠান থেকেই বলা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন সিলেটিদের মাথায় ঢুকেছিল। শুরু হয়েছিল সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আন্দোলন-সংগ্রাম। সেটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সময়কালেই, সে হিসাব ধরলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সিলেটিদের আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয়েছে কমপক্ষে ৭০ বছর।

অসমীয়াদের সঙ্গে যুদ্ধংদেহী সংগ্রাম, সরকারের সঙ্গে দেনদরবার, তিরিশের দশকে বিশ্ববিদ্যালয় কনভেনশান, চল্লিশের দশকের আসাম বিধানসভায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবি, ষাটের দশকজুড়ে আন্দোলনের জোয়ার, আশির দশকের মাঝামাঝিতে আন্দোলনের নতুনমাত্রা এইসব বিচিত্র-কঠিন অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে জেনারেল এরশাদ সিলেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোষণা দেন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এর মধ্যে সিলেটিদের বিভিন্ন সময়ে হতে হয়েছে প্রতারণার শিকার। যেমন, সিলেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেও দেখা গেল সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে গৌহাটিতে, আবার বিভাগোত্তর অর্থাৎ পাকিস্থান আমলে সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন হওয়ার পর তা স্থাপিত হয় চট্টগ্রামে। আর সিলেটে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিবর্তে শেষমেষ স্থাপিত হলো একটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়, স্রেফ আমলাতান্ত্রিক কারণে। আশির দশকের সূচনালগ্ন থেকে আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে ১৯৮৫ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন এবং পরের বছর ৩০ এপ্রিল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এর আগে একজন সচিব রাষ্ট্রপতি এরশাদকে বুঝিয়েছিলেন, সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় হলে, এখানে কেউ পড়তে আসবে না। তাই বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় করাই যুক্তিযুক্ত। ফলে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় এই অঞ্চলের মানুষের জন্য দুরাশাই রয়ে গেল আজ অবধি। তাও হতো না, যদি না মন্ত্রীসভায় থাকতেন সিলেটের কৃতীসন্তান হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। লোকমুখে প্রচলিত আছে যে, তাও, তিনি এরশাদকে রাজি করিয়েছিলেন খোদ মক্কাশরিফে, হজে গিয়ে ওয়াদা করিয়ে নিয়েছিলেন। এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য, সিলেটের বিশ্ববিদ্যালয়-বঞ্চনার পেছনে আসাম থাকাকালে অসমীয়াদের বাঙালিবিদ্বেষ এবং পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশে অসিলেটিদের সিলেটি-বিদ্বেষ কাজ করেছিল। এধরনের বিদ্বেষ যে আজও তিরোহিত হয়েছে এমনটা ভাবার কোনো কারণ নাই।

ঔপনিবেশিক আমলে সিলেটে ইংরেজিশিক্ষার পত্তনলগ্নে অর্থাৎ ১৮৫৪ সালে পূর্ণাঙ্গ জেলা স্কুল সিলেটে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ৩ বছরের মাথায় সরকার তা বন্ধ ঘোষণা করে দেয়। একইভাবে মুরারিচাঁদ কলেজ প্রথমশ্রেণির কলেজে রূপান্তরিত হওয়ার ৬ বছরের মাথায় আসামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নাম করে ডিগ্রি অংশ বাদ দিয়ে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে নামিয়ে আনারও সুপারিশ আসে, একইভাবে বঙ্গদেশের দ্বিতীয় মহিলা কলেজ হিসেবে সিলেট মহিলা কলেজ ১৯৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ১৯৪৫ সালে সরকারিকরণ হয় কিন্তু দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে আবার তা বেসরকারি স্তরে নামিয়ে আনা হয়। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সিলেটের জনমনে আতঙ্ক ছিল সিলেটে আদৌ কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবে কিনা? সে-জন্যই বারবার অব্যাহত আন্দোলন চলছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকল্পে।


যাই হোক, আন্দোলন-সংগ্রামের ভিতর দিয়ে সিলেটিরা ‘পোকায় খাওয়া’ একটি বিশ্ববিদ্যালয় পেল! কিন্তু যে-বিশ্ববিদ্যালয়টি পেল প্রতিষ্ঠার তিরিশ বছর পর তা কতটা ‘বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠল’ তা দেখার বিষয়। কিংবা দেখার বিষয়, এই বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েই কি সিলেটের মানুষ সন্তুষ্ট? নাকি তারা একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন হারিয়ে ফেলেছেন চিরতরে? আরও দেখার বিষয়, সিলেটিরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য শতবছরব্যাপী আন্দোলন-সংগ্রামই-বা করেছিলেন কেন?
অতীতের দিকে তাকালে দেখতে পাই সিলেট শিক্ষাসংস্কৃতিতে উত্তরপূর্ব ভারতের একটি কেন্দ্র-স্থল ছিল। এখানে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য, আরবী-ফারসি-উর্দু ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় গোটা ভারতের মধ্যে খ্যাত ছিল। মধ্যযুগের ন্যায়শাস্ত্রবিদ, যাকে বাংলার সক্রেটিস হিসেবে মূল্যায়ন করা হয় সেই রঘুনাথ শিরোমণি সিলেটের পঞ্চখণ্ডের সন্তান ছিলেন, নবদ্বীপে যে-জ্ঞানসাধনার মশাল জ্বলে উঠেছিল সেখানকার অনেক পণ্ডিত ছিলেন সিলেটি বিদ্বান। এদের মধ্যে অদ্বৈতাচার্য, মুরারি গুপ্ত, চন্দ্রশেখর আচার্য, শ্রীরাম পণ্ডিত ও বৃন্দাবন দাস প্রমুখ ছিলেন শ্রীচৈতন্যের প্রধান পারিষদ। আধুনিক যুগের পদ্মনাথ ভট্টাচার্য, বিপিনচন্দ্র পাল, যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য, কমলাকান্ত গুপ্ত, মৌলভী আবদুল করিম, গুরুসদয় দত্ত প্রমুখ পণ্ডিত সিলেটের সূর্যসন্তান। এরা দেশ-বিদেশে পড়াশোনা করেছেন, পড়িয়েছেন; সমাজসংস্কারমূল কাজ করেছেন। ফলে রাজনীতিবিদ, জমিদারসহ উচ্চশ্রেণির হিন্দু-মুসলমানরা উপলব্ধি করেছিলেন সকল দিক থেকে অগ্রগামী হওয়া সত্ত্বেও সিলেটে ওই অর্থে কোনো উচ্চতর শিক্ষা-গবেষণাকেন্দ্র নেই। মুরারিচাঁদ কলেজ ও সিলেট আলিয়া মাদরাসাকে কেন্দ্র করে যখন সিলেটে একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম হলো তাদের ভেতরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অভাববোধটা ছিল তীব্র। শুধু শৈক্ষিক নয়, ঐশ্বর্য-সম্পদ, প্রকৃতিক ধনভাণ্ডার, ভাষা-সংস্কৃতি-সাহিত্য, ধর্মসম্প্রদায় ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের ক্ষেত্রেও সিলেট অনন্য ছিল সুপ্রাচীন কাল থেকেই। বিদ্বানরা ভেবেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে শুধু যে এ-অঞ্চলের মানুষ আলোকিত হবে, তা নয়। এ-অঞ্চল শিক্ষা-গবেষণার ক্ষেত্র হিসেবেও বিবেচিত হবে। জ্ঞানতাত্ত্বিক দিক থেকে পাবে বৈশ্বিকতা।


তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে মুরারিচাঁদ কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায় কলেজের সুবর্ণজয়ন্তী সংখ্যার (১৯৪২) তৃতীয় খণ্ডে লিখিত `What Murarichand College  Can do for Sylhet` প্রবন্ধে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-উপস্থাপিত আসাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ টেনে সিলেটে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানচিত্র অঙ্কন করেছিলেন। যদিও প্রবন্ধে একটা রূপকল্প দিয়েছিলেন মুরারিচাঁদ কলেজকে ঘিরেই, যেটা কলেজের পক্ষে আদৌ সম্ভব ছিল না, নিতান্তই যা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপার। আসলে তার বক্তব্যে বৌদ্ধিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবেই সিলেট অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভাব যেমন অনুভূত হয়, তেমনি অন্তরালে একটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি।

স্বাপ্নিক ও পণ্ডিত নীহাররঞ্জন রায়ের দৃষ্টিতে শ্রীহট্ট পৃথিবীর অনন্য স্থান। ভূতাত্ত্বিক, প্রকৃতিক, ভূ-রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, প্রত্ন-পুরাতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, ভাষাতাত্ত্বিক, ধর্মতাত্ত্বিক, দার্শনিক, জ্ঞানতাত্ত্বিক, সাহিত্যক প্রভৃতি দিক থেকেই। সুতরাং সিলেট অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত উচ্চতর শিক্ষা-গবেষণা কেন্দ্রই সিলেটের এই অযুতনিযুত সম্ভাবনাকে শিক্ষা-গবেষণার মাধ্যমে তুলে ধরতে পারে বিশ্বদরবারে। কাজে লাগতে পারে প্রাকৃতিক, সামাজিক ঐশ্বর্যভাণ্ডারকে। তিনি মনে করেছেন এইজন্য দরকার ধীমান শিক্ষক, গবেষক ও নিরলস শিক্ষার্থীর। আর সিলেট অঞ্চলের মানুষের বিবেচনায় এ-জন্য প্রয়োজন পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের, যা কলেজ বা বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান দ্বারা সম্ভব নয়।


তবু আন্দোলন সংগ্রামে যে-বিশ্ববিদ্যালয়টি জুটল তা নিয়ে একটা মহাপরিকল্পনা প্রণয়নও করা হলো। কোর্সপদ্ধতি ও আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোষণা দিয়ে চালু-হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকনমিক্স, পলিটেক্যাল সায়েন্স, বিজনেস সায়েন্স, ফিজিক্স, ক্যামিস্ট্রি, গণিত, বায়োলজি, মেডিসিন, জিওলজি, মডার্ন ল্যাংগুয়েজ, এগ্রিকালচার সায়েন্স, ফিসারিজ, মিনারেল সায়েন্স, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউরেনিয়াম ও চা সহ বিভিন্ন বিষয় পড়ানো হবে বলে নির্ধারিত হয়। সবশেষে ১৯৯১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও অর্থনীতি-এ ৩টি বিভাগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শুরু করে। ৩০ বছরের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন স্কুল ও ইনস্টিটিউটর অধীনে ৩৭টি বিভাগ থাকার কথা, কিন্তু সময়ের শেষ প্রান্তের দিকে এসে দেখা যায় বিভাগ খোলা হয়েছে মাত্র ২৭টি আর আবাসিক সুবিধা পাচ্ছে এক-তৃতীয়াংশেরও কম ছাত্রছাত্রী। কিন্তু সিলেটের অধিবাসীদের দীর্ঘদিনের সংগ্রামের ফসল পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়টির মহাপরিকল্পনার কাল পেরিয়ে আসলেও বাস্তবায়ন করা গেছে এর ৩০ শতাংশ মাত্র। এমনকি যে-স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন করা হয়েছিল, আর নীহাররঞ্জন রায়ের যে-রূপকল্প ছিল কিংবা দূরদর্শী রাজনীতিবিদদের কিংবা ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ-আমলা ও শিক্ষাবিদদের; দেখা গেল বিশ্ববিদ্যালয় এখন পর্যন্ত সে-পথে না-এগিয়ে স্ব-কল্প পথে শম্ভূক গতিতে চলছে, অনেকটা লক্ষ্যহীনভাবে, নিয়তি নির্ভর হয়ে।

আমার জিজ্ঞাসা হচ্ছে, কেন এম হলো, হচ্ছে বা হবে? নিশ্চয়ই এর পেছনে কারণ রয়েছে। উপযোগিতার দিক বিবেচনা করে নীহাররঞ্জন রায় তার প্রবন্ধে ১) কালচারাল স্টডিজ; ২) থিওলজি; ৩) ফোকলোর; ৪)নৃতত্ত্ব; ৫) হিস্টরি; ৬) জিয়োগ্রাফি; ৭) লিঙ্গুইস্টিকস; ৮) পলিটিক্যাল স্টাডিজ; ৯) ব্যবসায় স্টাডিজ; ১০) পেট্রলিয়ামস; ১১) মিনারাল সায়েন্স; ১২: এগ্রিকালচার; ১৩) আরকিওলজি; ১৪) ফিসারিজ; ১৫)জিওলজি; ১৬) ইকনোমিকস; ১৭) স্ট্যাটিসটিকস; ১৮) এথনোসিটিজ; ১৯) কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ; ২০) ভার্নিশ ইন্ডাস্ট্রিজ; ২১) ফিলজফি; ২২) ল্যান্ড ম্যানেজম্যান্ট; ২৩) ক্যালিগ্রাফি ও ম্যানস্ক্রিপ্ট; ২৪) ডাইলেকটিকস; ২৫) ম্যানুস্ক্রিপ্ট রিডিং অ্যান্ড টেক্চুয়াল ক্রিটিসিজম; ও ২৬) মার্শ স্টাডিজ/সায়েন্স। প্রভৃতি ক্ষেত্রের ইঙ্গিত করেছেন। এমনকি কেন ও কীভাবে এসব বিদ্যা সিলেটের ক্ষেত্রে উপজীব্য তারও একটা প্রতিবেদন-চিত্র দিয়েছিলেন। কেননা, এসব বিদ্যার সঙ্গে সিলেটের কোনো না-কোনো যোগসূত্র রয়েছে। নীহাররঞ্জনের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল নতুন, বৈজ্ঞানিক। অক্সফোর্ড কিংবা ক্যামব্রিজ সম্পর্কে ধারণা তার ছিল। ইউরোপ-আমেরিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ক্যাম্পাস থাকে, বিশ্ববিদ্যালয়কে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, অঞ্চলবিশেষের বিশেষত্ব ও জ্ঞানতাত্ত্বিক সংশ্লেষের ওপর ভিত্তি করেই। তিনি মনে করতেন, এমসি কলেজ বা সিলেট বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা আসাম বিশ্ববিদ্যালয় যার যার প্ররিবেশ-প্রতিবেশে সংশ্লিষ্ট ডিসিপ্লিন দ্বারা চালিত হলে দেশ ও দশের মঙ্গল সাধিত হবে। সিলেটের মানুষের সঙ্গে সে-চিন্তার একটা ঐক্য ছিল কিংবা আছে। বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় যা থেকে অনেকটাই দূরবর্তী। এবং একটা গৎবাঁধা আমলাতন্ত্রের ওপওর ভিত্তি করেই যেন বিশ্ববিদ্যালয় চলছে। গণমানুষের ৭০ বছরের আন্দোলনের স্বপ্ন দ্বারা চালিত নয়, যেমন একজন আমলা বুঝিয়েছিল রাষ্ট্রপতিকে যে, এখানে বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় না-করলে কেউ পড়তে আসবে না!


এখন মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন কেন করা গেল না? সে-বিষয়ে যদি আসি, প্রথমেই অর্থের প্রসঙ্গ আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ রাষ্ট্র বরাদ্দ দিয়ে থাকে। জাতীয় বাজেটের ভিত্তিতে। কিন্তু সে-বরাদ্দ কিছু ক্ষেত্রে শুধু নির্ধারিত নয়। রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে অনেককিছু। বিশেষ করে উন্নয়নের ক্ষেত্রে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী কর্মকর্তা হচ্ছেন উপাচার্য মহোদয়, তিনি একজন ব্যবস্থাপকও। আসলে তার ওপরেই অনেক কিছু নির্ভর করে। প্রথম উপচার্য অধ্যাপক সদরুদ্দিন চৌধুরী, পরবর্তীকালে অধ্যাপক হাবিবুর রহমান ও অধ্যাপক মো. সালেহ উদ্দিন প্রমুখ উপাচার্যরা অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও অ্যাকাডেমিক সম্প্রসারণে যথেষ্ট অবদান রেখেছিলেন। কিন্তু বেশিরভাগ উপচার্য ‘চাকরি’ করেছেন, কেউ-বা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন। কিন্তু সিলেটবাসীর স্বপ্নকে অনেকেই স্পর্শ করতে পারেন নি। মহাপরিকল্পনার ৭০ ভাগ অসমাপ্ত থাকাটাই এর বড়ো সাক্ষ্য। এটা যে-কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সত্য যে, যিনি তদবির করে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হয়ে আসেন, আর যাকে উপাচার্য করে পাঠনো হয়, এ-দুয়ের মধ্যে পার্থক্য থাকে। দ্বিতীয় ব্যক্তি ব্যবস্থাপনায় যেখানে পারঙ্গমতা দেখাতে পারেন বেশি, প্রথম ব্যক্তি থাকেন শুধু সামাল দিতে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্য হচ্ছেন তেমন ব্যক্তি, জীবনে যার নিজের চাওয়া বলে কিছু থাকতে পারে না। এমনই সম্পন্ন, সুষম ব্যক্তি তিনি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নেতা, রাষ্ট্রের সবচেয়ে বিদ্বান, পণ্ডিত ও বিচক্ষণ ব্যক্তি। তিনি যখন কোনো কিছু চাইবেন, দাবি করবেন রাষ্ট্র বা সরকার তাকে ‘না’ করতে পারবে না। এমনি যুক্তিনিষ্ঠ ও প্রাজ্ঞ তিনি। পণ্ডিত ও বিচক্ষণ ব্যক্তি হিসেবে রাষ্ট্রপতি তাকে চিনবেন, সম্মান করবেন তার জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও ন্যায়নিষ্ঠতার জন্য। তিনি চাকরি করতে বাধ্য নন। একটা উদাহরণ দিই। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। তিনি যখন বুঝতে পারলেন প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি তার কথা শুনছেন না, তিনি উপাচার্য পদ ছেড়ে দিলেন। একজন উপাচার্যকে সেই ব্যক্তিটি হতে হয়।

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে, মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে, সিলেটের মানুষের ৭০ বছরের সংগ্রাম-আন্দোলন ও স্বপ্নকে স্পর্শ করার জন্য অনেক বিকল্প উপায় বিদ্যমান ছিল বা আছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারের শাসনামলে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরা ছিলেন বা আছেন, যারা সিলেটি। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ভালো করে জানতেন বা জানেন। পৌঢ় রাজনীতিবিদ আবদুস সামাদ আজাদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, আবুল মাল আবদুল মুহিত, সাইফুর রহমান, ইনাম আহমদ চৌধুরী প্রমুখ বাংলাদেশের প্রাতস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। উপাচার্য মহোদয়রা এসব গুরুত্বপূর্ণ মানুষের কাছে গেলে সিলেটের বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতিকল্পে সাহায্য করবেন না, এটা সিলেট কেন, বাংলাদেশের কেউই মেনে নেবে না। কিন্তু তেমনটা ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই। আর ঘটলে, মহাপরিকল্পনার ৩০ ভাগ সম্পন্ন হতো না। যাদের কথা উল্লেখ করলাম তারাও কোনো-কোনোভাবে সিলেট বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনের রূপকার ছিলেন।


সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এই অঞ্চলের মানুষ এই জন্য করেনি যে, তাদের এখানে পুনর্বাসিত করা হবে? তাদের ‘অযোগ্য’ সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ দিতে হবে কিংবা কোটা পদ্ধতি দিতে হবে। এটা আমি নিজে যেমন মানি না, তেমনি বিশ্বাসও করি না। আসলে এখানে আন্দোলন সংগ্রাম করে বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়েছে একটা শৈক্ষিক সুযোগের পরিমণ্ডল সৃষ্টির জন্য। যে-সুযোগ চাকরি বা অধ্যয়নের ক্ষেত্রে ‘যোগ্যতার ভিত্তিতে’ অন্যঅঞ্চলের মানুষের মতো সমানভাবে নেবে সিলেটের মানুষ। এটা হবে একটা বিশ্ববিদ্যালয়, জ্ঞানবিতরণ ও জ্ঞানসৃষ্টির কেন্দ্র। নিশ্চয়ই ‘আঞ্চলিকতার কূপ’-সৃষ্টি এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল না। ভূ-তাত্ত্বিকভাবে সিলেটের যে-অবস্থিতি, যে-পরিমাণ অপার ঐশ্বর্য এবং বিশেষত্ব সেটাকে জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে উদঘাটন, অনুসন্ধান, সম্পদে পরিণত করে দেশ ও বিদেশের কাজে লাগিয়ে মানবতার পরিষেবা, এটাই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ও অন্তিম চাওয়া। যে-সুযোগ ও সম্ভাবনার দিকে তাকিয়ে আছে বর্তমান ও ভাবিকালের মানুষ। আর সময়ই একদিন বলে দেবে, বিশ্ববিদ্যালয়টি কতটা ‘ক্যামব্রিজ’ বা ‘অক্সফোর্ড’ হতে পারল কিংবা এদের দুটিকেই ছাড়িয়ে যেতে পারল।

জফির সেতু, কবি, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক। সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ