আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

হার

ড. কাবেরী গায়েন  

টিটু রায় নামের নেহাতই এক প্রান্তিক মানুষের নামে Md Titu Roy নামের এক ভূঁয়া অ্যাকাউন্ট খুলে নবী হজরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর নামে উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচার করে এলাকায় তাঁর ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষদের ঘরে আগুন দেয়া হলো। আগুন দেবার কয়েকদিন আগেই মানব-বন্ধনের ঘোষণা দিয়ে মিটিং-মিছিল হচ্ছিলো। আইন-শৃংখলা রক্ষাকা্রী বাহিনী সব জেনেও ব্যবস্থা না নেবার কারণে একদিকে নিরীহ মানুষদের ঘরে আগুন দেয়া সম্ভব হলো। অন্যদিকে ঘটনার দিনে এতো হাজার উত্তেজিত মানুষকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মারা গেলো আগুন লাগাতে আসা একজন।

ঘটনা যা ঘটার ঘটে গেলো। বিপন্ন মানুষের ঘরে দেয়া আগুনের ছবি দেখলাম আমরা।  তাদের কান্নার ছবি দেখলাম। এক-আধটু নিন্দাজ্ঞাপন দেখলাম সামাজিক মাধ্যমে। কেউ রুখে দাঁড়ানোর কথা বললেন না। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সরকারের উদাসীনতার ব্যাপারে ফেসবুকীয় ধিক্কারও চোখে পড়লো না তেমন। দেখে দেখে গা-সওয়া হলে যা হয় আর কি!

তদন্তকারী কর্মকর্তারা নিশ্চিত করলেন, টিটু রায় এই স্ট্যাটাস দেননি। কে এই স্ট্যাটাস দিয়েছেন, সেটিও পত্রিকা মারফত আমরা জানলাম। মওলানা হামিদী নামের ব্যক্তি স্বীকার না কি করলেন যে তিনি এই কাজ করেছেন, অন্তত পত্রিকা-মারফত আমরা তাই জেনেছি।

যখন অপেক্ষা করছি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেবার জন্য এই ব্যক্তির গ্রেফতারের, তখন, ফের জানতে পারলাম, টিটু রায়কেই গ্রেফতার করা হয়েছে।কেউ কেউ আমরা মৃদু বিস্মিত হলাম বৈ কি!তবে আমি স্তম্ভিত হলাম টিটু রায়ের ছবি দেখে। এতো লজ্জা লাগলো! এই নিরক্ষর গরীব লোকের নামে ফেসবুকে ধর্ম-অবমাননাকারী বক্তব্য প্রচারের অভিযোগ!

সেই বিস্ময় না কাটতেই আমরা পড়লাম পত্রিকায় তাকে চার দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। আরো জানলাম, তার পক্ষে কোন উকিল দাঁড়ায়নি রংপুর কোর্টে। তার পরিবারের পক্ষ থেকে কোন আবেদন করার মত কেউ নেই। সরকারী উকিল বলে কী এক পদের কথা শুনেছি এতোকাল। কিন্তু টিটু রায়ের ক্ষেত্রে তেমন কোন উকিল পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশে হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান ঐক্য পরিষদ বলে না কি কী একটা সংগঠন আছে। তারাও কি একজন আইনজীবীর ব্যবস্থা করতে পারলেন না?
হতভম্ভ অবস্থায় যখন ভাবছি এটা কি সত্যিই একটা সভ্য দেশ? তখন জানলাম, এই-ই সব নয়। রান্নাঘরে আরো আছে।

কী আছে রান্নাঘরে? সেটা জানতে হলে বাংলাদেশ মাইনরিটি ওয়াচের সরেজমিন তদন্তের (১৬ নভেম্বর, ২০১৭) রিপোর্ট যা এসেছে সামাজিক মাধ্যমে তা যে একটু কষ্ট করে পড়তে হবে!

পড়ার কষ্ট কমানোর জন্য আমি সংক্ষিপ্তসারটা এখানে দিচ্ছি। এই টিটু রায় কোন এক ক্ষুদ্রঋণের কিস্তি দিতে না পেরে স্থানীয় এক অবস্থাপন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা ধার করেছিলেন। তিনি সেই টাকা শোধ করতে না পেরে এলাকা ছাড়েন।তাঁর দুই মেয়ে। সুচিত্রা রায় (১৩) এবং শিউলী রায় (১৭)। সুচিত্রা রায়কে বছর খানেক আগে সেই অবস্থাপন্ন ব্যক্তির ছেলে  অপহরণ এবং জোর করে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করে।  বড় মেয়ে শিউলি রায়কেও একইভাবে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করা হলে সে কীভাবে যেনো সেখান থেকে উদ্ধার পায়। কিন্তু সুচিত্রা রেহাই পায়নি।

টিটু রায়কে ৫৭ ধারায় গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু মূল দোষী ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।

এই ঘটনায় আমি দুঃখ পাওয়ার চেয়ে বেশি পাচ্ছি লজ্জা। হেরে যাচ্ছে আমার দেশ। দেশটা কি লোকদেখানো চোখের লজ্জাটুকুও আর রাখতে পারছে না?ভোট নাকের ডগায় আর হেফাজতের ভোট পকেটস্থ করতে হবে বলে কি এতোটাই নির্লজ্জ হবে অসাম্প্রদায়িক-ধর্মনিরপেক্ষতার শ্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় আসা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ দাবিদার সরকার?

আর বলিহারি আমাদের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত প্রগতিশীল ফেসবুক সমাজ। ৫৭ ধারার বিরুদ্ধে প্রায়ই হৈ চৈ শুনি। শোরগোলটা শোনা যায় যখন আমরা আক্রান্ত হই, মানে শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত শ্রেণী যখন আক্রান্ত হই। কিন্তু এই ধারা যখন উত্তম, রাকেশ, রসরাজ, টিটু রায়ের বিরুদ্ধে প্রযুক্ত হয়, জেনেও যে তারা করেনি এসব কাজ, তখন আমাদের আওয়াজটা আর শোনা যায় না। যাঁরা শ্রেণী সংগ্রামের কথা বলেন, বলেন হিন্দুরা নির্যাতিত না, যা হয় তা শ্রেণীনিপীড়ন, সেইসব বিপ্লবীদেরও দেখিনি মাঠে, ফেসবুকেও না।অন্তত শ্রেণীর প্রশ্নেও তো তাঁরা সোচ্চার হতে পারতেন! মান্যবর বদরুদ্দিন উমরের কাছ থেকে এ’যাবত কোন কলাম পেলাম না যা ব্যাখ্যা করে কীভাবে শ্রেণী পক্ষপাতের কারণে উত্তম-রসরাজ-রাকেশ-টিটুদের বেলায় ৫৭-ধারা বিরোধী বিপ্লবীরা চুপ করে থাকেন।

এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে একসাথে মিছিল-মিটিং করা এক বামপন্থী প্রগতিশীল বন্ধুকে দেখি এম জে আজবরকে উদ্ধৃত করে লিখতে যে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পরেও ভারতের মুসলমান যুবক দেশ ছেড়ে যেতে চায়নি কারণ সে মনে করেছে ভারত তার দেশ, ফাদারল্যান্ড, আর সেই স্ট্যাটাসের নীচে মন্তব্য লেখা হতে থাকে যে হিন্দুরা আর ইহুদীরা যথাক্রমে ভারত এবং ইসরায়েল ছাড়া আর কোন দেশকে আপন মনে করে না, হিন্দুদের ভারত ছাড়া কোন দেশের প্রতি আনুগত্য নেই, কিন্তু মুসলমানরা দেশপ্রেমিক, সংখ্যালঘুত্বের ভয়ে তারা দেশ ছাড়ে না।যে দেশে জন্ম সেই দেশকে ভালোবাসে।

আমার বেড়ে ওঠা, দেশের প্রতি আবেগ, এইসব বন্ধুদের সাথে স্বৈরাচারবিরোধী মিছিল করার দিন, রাগ-অভিমান-ঝগড়া-আপোষের দিনগুলো সব মিলে বড় লজ্জায় পড়ে যাই। লজ্জায় পড়ে যাই এজন্যও যে, শুধু গুটিকয়েক (আসলে হাজার হাজার)ব্যক্তির জন্য এভাবে ঘটনাগুলো ঘটছে না। বরং আমরাও এমনই ভাবছি।

উত্তম-রসরাজ-রাকেশ-টিটুকে এই দেশের কেউ ধারণ করে না। রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম, আমাদের বিপ্লবীয়ানা, ফাঁকাবুলি, প্রতিবাদের ভড়ং সব নিয়েই আমি খুব লজ্জিত। আমার অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক অবস্থানের জন্য আমি লজ্জিত। কিছু করতে না পারার জন্য লজ্জিত। এই সব হারানো মানুষগুলোর কাছে আমাদের সমস্ত দেউলিয়াত্ব এভাবে ক্রমাগত প্রকটভাব প্রকাশ হয়ে পড়ায় খুব বেশি লজ্জিত আজ।আমার যে অদম্য আশাবাদী মন, এই লজ্জা তাকেও হারিয়ে দিয়েছে।

ড. কাবেরী গায়েন, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ