আজ বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

Advertise

‘বাংলা পড়িয়া কী হইবে?’

জফির সেতু  

আকাশে-বাতাসে এই কথাটি সর্বদাই ভাসে! আমিও বিশ্ববিদ্যালয়ে এ-কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পাই।  অবাক হই লোকে এমন কথা কেন বলে? আর কারাই-বা এইসব কথা বলে? বিষয়টি প্রায়ই ভাবি। এটাও ভাবি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা বাংলা পড়ে, এরা কারা? এরা কি ভালোবেসে বাংলায় ভর্তি হয়, নাকি অন্য কোনো বিষয়ে চান্স না-পেয়ে বাংলায় ভর্তি হতে হয়? আর সমাজ-রাষ্ট্রে এই বাংলারই-বা অবস্থান কী? আর এসব বুলি যে মানুষের মুখে মুখে থাকে এজন্য দায়ী কে-বা কারা? বিষয় বাংলাই, না অন্য কেউ?

বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা সদ্য বাংলা বিষয়ে ভর্তি হয় পুরো একবছর সময় লাগে তাদের স্বাভাবিক হতে, যারা আগে থেকেই বাংলা পড়বে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে, এখানে তাদের কথা আসছে না। দেখা যায় তাদের স্বপ্ন ছিল অন্য যেকোনো বিষয় নিয়ে পড়বে, বাংলা অন্তত নয়। কিন্তু ভর্তির সময় দেখা গেল মেধাতালিকায় নিচের দিকে থাকার ধরুন, আগেই তার পছন্দের বিষয় হাতছাড়া হয়ে গেছে। এখন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু পড়তেই হবে, বাংলা ছাড়া গতি নেই। আপাতত বাংলায় ভর্তি না-হয় হওয়া গেল, আগামীবার দেখা যাবে অন্যবিষয় নিয়ে পড়া যায় কিনা। দেখা গেল, পরের বারও হলো না কোথাও, বা আবারও বাংলা! অথবা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভালো লেগে গেল, কিংবা বন্ধুবান্ধব জুটে গেল, তাই কোথাও পরীক্ষাই দেওয়া হলো না; কিংবা অলসতাবশত ভালো প্রস্তুতিও হলো না।

আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই সেটা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, এখানে বাংলার বাস্তবতা অন্য সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে ভিন্ন। এখানকার অধিকাংশ ছাত্র ও শিক্ষক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ের। বাংলা এখানে অর্বাচীন, অনেকটা সংখ্যালঘুর মতো। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বিষয়ের পড়াশোনার সঙ্গে সাহিত্যের পড়াশোনা ও ধ্যানধারণা মেলার কথা নয়। ফলে ক্যাম্পাসে ‘সংখ্যালঘু’ হওয়ার যন্ত্রণার সঙ্গে মিলিত হয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার সঙ্গে মানবিকবিদ্যা বিষয়ের সমান্তরাল চলার মতো বিপরীত রীতিনীতি। ‘সংখ্যাগুরু’রা সামাজিক বা বৈশ্বিক কারণেই একধরনের উচ্চন্মন্যে ভোগে, আর স্বাভাবিকভাবেই ‘সংখ্যালঘু’রা হীনন্মন্যতায়। অপর বিষয়ের শিক্ষার্থীরা ধরেই নেয়, ওরা বাংলা বিষয়ের শিক্ষার্থীর চেয়ে বেশি মেধাবী; আবার বাংলা বিষয়ের শিক্ষার্থরাও নিজেদের কম মেধাবী বলে ভাবতে শুরু করে। ফলে সকল সময় একটা মনস্তাত্ত্বিক সংকট ভেতরে কাজ করে। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বা সমাজকর্মের পাশাপাশি যদি ইতিহাস, দর্শন, ফোকলোর, সংগীত বা চারুকলা প্রভৃতি বিষয় থাকত তাহলে সেব বিষয়ের শিক্ষার্থীরা মিলত ভালোই। কেননা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক পড়াশোনার ধরন-ধারনের সঙ্গে মানবিক বিদ্যার পড়াশোনার ধরন-ধারনই আলাদা। ফলে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় অনেকে বাংলা নিয়ে পড়ে, এ-পরিচয় দিতেও কুণ্ঠা বোধ করে। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, চট্টগ্রামে, তখনও দেখেছি অনেকে ক্যাম্পাসে, শহরে বা শাটল ট্রেনে নিজের বিষয়ের পরিচয় না-দিয়ে, অন্য বিষয় বলত। যদিও সেটা ছিল সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়।

শুধু তাই নয়, একজন শিক্ষার্থী পছন্দ করে বিষয়টি নিলেও, অর্থাৎ অন্য কোনো ‘ভালো’ বিষয়ে চান্স পাওয়ার পরও বাংলা যখন বেছে নেয়; ভর্তি হয়, তখন, ক্যাম্পাসে, হলে, ট্রেনে বা বাড়িতে বেড়াতে গেলে কোনো আত্মীয় বা দোকানদার বা মাছবিক্রেতা প্রশ্ন করে বলল, ‘ও বাংলা!’ ‘অন্য বিষয় পাওয়া গেল না?’ ‘বাংলা পড়ে কী করবে?’ তখন শিক্ষার্থীর তরুণ মন হীনন্মন্যতায় ভরে যায়! অথবা কেউ যখন বলে বসল, বিশ্ববিদ্যালয়ে এতটাকা খরচ করে বাংলা পড়া দরকার কী? এর সমর্থন আবার দিয়ে বসল আরো তিনজন! তখন তো আর কথা নেই। ফলে দেখা যায়, বাংলায় ভর্তি হয়েও বিষয় পরিবর্তনের নোটিশ আসলে বেশিরভাগই বিষয় পরিবর্তনে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে।

আমি নিজে দেখেছি, অনার্স প্রথম সেমিস্টারের ক্লাসে আনন্দের পরিবর্তে ছাত্রছাত্রীদের মুখে বিষাদের ছবি। হতাশা তাদের গ্রাস করে। অনেকেই বিষন্ন হয়ে পড়ে। আমি জিজ্ঞেসও করি; কারা পছন্দ করে ভর্তি হয়েছে, কারা বাধ্য হয়ে? দ্বিতীয় দল সংখ্যায় বেশি থাকে সব সময়। অনেকে আবার আমাকে বলে, পছন্দ করে ভর্তি হয়েছে ঠিকই, তবে অন্যের মন্তব্যে সে হতাশ হয়ে পড়ছে। হয়ত কন্টিনিউ করবে না! হতাশার ধরন কিন্তু বিভিন্ন কারণেই আসে। অ্যাকাডেমি দিক থেকে বলতে গেলে বলতে হয়, যারা বিজ্ঞান বা ব্যবসায় শিক্ষা থেকে আসে, তাদের অনেকে ভেতরে অনিচ্ছা ছাড়াও সাহিত্যবোধ হয়ত কম; ফলে পাঠ্যক্রম দেখে, একটু নাড়াচাড়া করে ধরে নিল, ‘এসব মাথায় ঢুকছে না’ বা ‘আমার ধারা হবে না’। ফলে হতাশ হয়। দ্বিতীয়ত, বাংলায় একটা বড়ো দল আসে মাদরাসা থেকে। এরা মনে করে ‘বাংলা মনে হয় খুব সহজ বিষয়, তাই নিয়ে নিই’। কিন্তু সাহিত্য বোঝার জন্য তো আর শুধু মেধার দরকার না, আরও কিছুর প্রয়োজন পড়ে; সেটা হচ্ছে বোধশক্তি। অনেকের সেটা এতই কম থাকে যে সাহিত্যের সঙ্গে সমানতালে হাঁটতে পারে না। আবার মাদরাসায় দীর্ঘদিন যেসব পড়ে অভ্যস্ত বা যেধরনের চিন্তা করে অভ্যস্ত বা যেধরনের ধ্যানধারণা; সাহিত্যের সঙ্গে তা যায়ও না। তাছাড়া বাংলা সাহিত্যের আদি ও মধ্যযুগের সাহিত্যকর্মের বেশিরভাগই বৌদ্ধ ও হিন্দুধর্মকেন্দ্রিক। এইধরনের সাহিত্য পড়তে গিয়ে অনেকেই হোঁচট খায়, পড়ে যায় হতাশার খাঁদে। মোটকথা বাংলায় যারা পড়তে আসে বাধ্য হয়ে কিংবা সহজ মনে করে, এবং যাদের সংখ্যা বেশিরভাগই; আসলে সমস্ত শিক্ষাজীবনে সে বাংলার সঙ্গে একাত্মই হতে পারে না। আর জ্ঞানের জগতে আনন্দের সঙ্গে ভ্রমণ না-করলে যা হয়, তা সকলেই জানেন। দিন শেষে সনদ হয়ত লাভ হয়, ভালো গ্রেডও হয়ত পাওয়া গেল; কিন্তু জীবনের প্রতিযোগিতায় পিছনেই পড়ে থাকতে হয়; তারা অন্যদের সঙ্গে দৌড়ে পেরে ওঠে না। যদিও এতে বিষয়ের কোনো দোষ নেই।


বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পছন্দের বিষয় নিয়ে পড়তে আসে, আসলেই কি ওগুলো তাদের পছন্দের বিষয়? অন্তত বাংলাদেশে? মোটেই নয়। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার পরিস্থিতি হচ্ছে, স্কুলে পড়ার সময়, কলেজে পড়ার সময় কখনো নিজে, কখনো-বা পরিবার ও সমাজ নির্ধারণ করে দেয় কোন বিষয়ে পড়তে হবে! কেউ যদি শখ করে ইংরেজিতে পড়তে আসে, তাকে জিজ্ঞেস করুন কেন সে ইংরেজি পড়তে এসেছে? এর আগে হয়ত আপন ইচ্ছায় একটাও ইংরেজি নভেল, কাব্য বা নাটক পড়েনি; কোনো ভালোবাসারই জন্ম হয়নি বিষয়টির ওপর কিন্তু নির্ধারণ করে ফেলেছে ইংরেজি পড়বে! নৃতত্ত্ব, অর্থনীতি বা অন্য যেকোনো বিষয়ে ওই একই কথা খাটে। হয়ত সমাজ-রাষ্ট্রে ইংরেজি, অর্থনীতি, ব্যবসায় প্রশাসন বা কম্পিউটার সায়েন্সের একটা নামডাক আছে বা উপযোগ আছে। এর সঙ্গে শিক্ষার্থীর পছন্দ-অপছন্দের কিছু নাই। আছে শুধু ফেসিনেশন বা ওপরে ওঠার ধান্দা। অন্যকে টপকে! আমাদের দেশে বাবা ডাক্তারি পড়তে পারেনি বলে ছেলের জন্মকালে স্বপ্ন্ দেখে ছেলেকে ডাক্তার বানাবে; মা ইঞ্জিনিয়ার হতে পারেনি বলে মেয়েকে ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চায়? বাবা জজব্যারিস্টার হতে পারেনি বলে ছেলে বা মেয়েকে জজব্যারিস্টার বানাতে চায়। আবার সমাজ-রাষ্ট্রও ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-জজ-ব্যরিস্টার-আমলা-অধ্যাপক ইত্যাদিকে ‘মানুষের মাপকাঠি’ বলে নির্ধারণ করে ফেলেছে। ফলে ‘পদ’ই হয়ে উঠেছে সবচেয়ে বড়ো নিয়ামক। আর পদের জন্য চাই ভালো ফলাফল বা গ্রেড বা ‘ভালো’ সাবজেক্ট। সুতরাং পরীক্ষা আসলে বাবা-মায়ের চোখের ঘুম হারাম হয়ে যায় ফলাফলের চিন্তায়। এখন আর বাবা-মা-রা একটুও চিন্তা করেন না, আমার সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়ার আগে তাকে কতটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যোগ্য করে তুলতে পেরেছি? তাদের লক্ষও সেটা না। তারা মনে করেন, এ-প্লাসই সকল ভালোত্বের মাপকাঠি। সন্তান রবীন্দ্রনাথ-আইন্টাইন-টলস্টয়-গোর্কি-শেকসপিয়ার-লরেন্স পড়ল কিনা সেটায় কিছু যায় আনে না। এতে তাদের কিছু যায় আসেও না।

যারা শিক্ষার্থী তাদের বেশিরভাগই মনে করে না। ফলে ধরে নেয় যেবিষয় নিয়ে সমাজের তথাকথিত উচ্চ আসনে বসা যাবে, সে বিষয়ই ভালো বিষয়। বা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি বা উপনিবেশ যেভাবে ‘মগজধোলাই’ করেছে সেভাবেই বিষয়ের গুরুত্ব নির্ধারিত হয়। রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি ওই একই ক্ষুরের মাথা কামান মাত্র। ফলে বাংলা বা ফিলেসিফি আজকের দুনিয়ায় নিশ্চয়ই ভালো বিষয় নয়। কিন্তু ইউরোপ বা উন্নত দেশগুলোর বাস্তবতা এমন নয়; ফ্রান্সে, জার্মানিতে বা রাশিয়ায় কোনো শিক্ষার্থী ফরাসি-জর্মান বা রাশিয়ান সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করলে তার কদরই আলাদা। বা খোদ আমেরিকাতে দর্শনের গুরুত্ব অন্যরকম। বাংলাদেশে উপাচার্যরা দর্শন বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে খুলতেই চান না। ‘মাল’ চলবে না বলে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ‘মাল চালানো’র জায়গা নয়, তা জ্ঞানবিতরণ ও জ্ঞানসৃষ্টিরও জায়গা। যদিও আমাদের দেশের অধ্যাপকগণ ইউরোপ-আমেরিকা থেকে জ্ঞানার্জন করে ফেরেন; তাদের অধিকাংশই শিখে আসেন আসলে কম। নইলে নিশ্চয়ই একদল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আরেকদল শিক্ষককে মাস্তানদের মতো ধাওয়াপালটা ধাওয়া করতেন না!


জাতিহিসেবে বাঙালি আত্মপ্রতারক। এটা আমার কথা নয়; অনেকেই বলে থাকেন। এটা বুঝা যায় বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি দেখেই। অনেকে পছন্দ করে, অনেকে ভালো ফলাফল করেও বাংলা পড়তে আসে। ফলাফলও করে ভালো বা মাঝারি। কিন্তু চাকরির বাজারে দেখা গেল নির্বাচকমণ্ডলী প্রথমেই ধারণা করে বসে বাংলার চাকরিপ্রার্থী অপেক্ষাকৃত দুর্বল। তাদের শুধু মাস্টারিই করা দরকার। এটাই ওরা পারবে, আর কিছু না। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। বা আগেবাগেই নির্ধারণ করা হলো বাংলা বিষয়ের স্নাতকরা এ-চাকরির যোগ্য নয়। আমি একটা জিনিশ খুঁজে পাই না, কোনো চাকরিতে ইতিহাসে বা ইংরেজিতে বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে কোনো স্নাতক যোগ্য হলে বাংলা স্নাতকরা অযোগ্য হবে কেন? রাষ্ট্রেও এই পার্টিশন আছে। বাংলাদেশে শুধু চাকরি ক্ষেত্র কেন, বাংলাভাষা পরিস্থিতি দেখুন। বাহাত্তর সালের সংবিধানে বাংলাভাষার ওপরে এত জোর দেওয়ার পরও সর্বত্র তা চালু হয়নি আজও। বিভিন্ন অফিসে এখনও বাংলাকে নাক ছিটকানো হয়। মর্যাদার দিক থেকে বাংলা সমাজ-রাষ্ট্রে এখনো ততটা মর্যাদাবান হয়ে ওঠেনি। ইংরেজির ‘ভূত’ আমাদের মগজ থেকে বের হয়নি। ইংরেজিতে আমরা আজো স্বপ্ন দেখতে পছন্দ করি। কিন্তু আমি এটাও মনে করি ইংরেজি জানাটা আমাদের খুব দরকার। প্রশ্ন বাঁধে তখন, আমরা যখন বাংলা বাদ দিয়ে ইংরেজির গোলামি করতে পছন্দ করি। আমরা মুখে বাংলার কথা বলি, অন্তরে ইংরেজিকে লালন করি; ফ্রেব্রুয়ারি এলে কেঁদে বুক ভাসিয়ে দেই। এগুলোই আত্মপ্রতারণা। আমরা এখনো আমাদের আত্মপরিচয়ের স্বরূপ বুঝে উঠতে পারিনি। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য।

আত্মপ্রতারণার আরও দুটো ঘটনার উল্লেখ করি। আমার জানা ইংরেজির এক অধ্যাপক, যিনি আবার লেখকও; বাংলাভাষায় সাহিত্য চর্চা করেন। নিজেকে খুব উঁচুদরের সাহিত্যিক ভাবেন, আমার আপত্তি নাই। কিন্তু তিনি যেবিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান সেখানে কর্তৃপক্ষ বাংলা খুলতে চাইলে বাধ সাধেন, তিনি আবার ওই প্রতিষ্ঠানের ডিনও। বলেন ‘বাংলা-টাংলা’ খুললে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান পড়ে যাবে! আকেবার ছাত্ররা চাইল শেকসপিয়ারের একটি নাটক বাংলায় অনুবাদ করে অভিনয় করবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে; তিনি বললেন, করতে চাইলে ইংরেজিতে করো বাংলা কিছুতেই নয়। বুঝুন অবস্থা। অন্যটি হচ্ছে, আমি একবার বিসিএস ভাইভা দিতে গেছি; আমার ফার্স্ট চয়েস ছিল পুলিশ ক্যাডার। আমাকে বোর্ড পাক্কা সাতাশ মিনিট রাখল। সবই ঠিক আছে। কিস্তু বেরিয়ে আমার সময় একজন সদস্য খুব নিগেটিভভাবে বললেন, বাংলা পড়ে তুমি সহকারি পুলিশ সুপার হওয়ার জন্য যোগ্য বিবেচনা করেছ কেন? আমি তার মুখের ওপরে সাফ জানিয়ে দিলাম, ইংরেজির একজন ছাত্র বা ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস-এর ছাত্র যেকারণে যোগ্য মনে করে, একই কারণে, স্যার! এই হচ্ছে বাংলা বিষয়ে বাঙালির ধারণা। আসল ঘটনা অন্যখানে। অনেকে অজ্ঞতাহেতু মনে করে, বাংলা মানে সমাস-সন্ধি, বাংলা মানে আগডুম-বাগডুম, বাংলা মানে কিছু কবিতা কিছু গান। হায়রে হায়, এটা যে একটা ডিসিপ্লিন, এবং অনেকগুলো ক্ষেত্র নিয়ে একজন স্নাতক বা স্নাতকোত্তর হয়, অনেকে জানেই না! বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকেরও ওই একই ধারণা। ওরা মাথা নিচু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ডুকেন; বেরও হন মাথা নিচু করে। ফলে চোখে কেবল দেখেন কাদামাটি আর গর্ত; আকাশটা দেখেন না!

শুধু তাই নয়, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়ান, তারাও কম যান না। যখন নতুন ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হয়, বিভাগে আসে, তখন যে স্বপ্ন মাথায় করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল; দেখা গেল বিভাগের অনেক শিক্ষককে দেখেই তার স্বপ্ন ‘পানি’ হয়ে গেল। বা যখন ক্লাসে গেল, মাস্টারের কথা শুনে আক্কেল গুড়–ম, এই তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়? ততক্ষণে আর বের হওয়ার সুযোগ মেলে না। দেখা গেল ওয়ারিয়েন্টেশন ক্লাসে বিভাগের পণ্ডিত লোকটি সবক দিচ্ছেন, তোমরা বাংলাতে ভর্তি হয়েছ বলে হতাশ হয়ো না। বাংলা পাশ করলে তোমরা একজনও বেকার থাকবে না! দেখো. দেশে কত প্রাইমারি, মাধ্যমিক, হাইয়ার সেকেন্ডারি বা কলেজ আছে; সবগুলোর জন্য বাংলার মানুষের দরকার। সো, নো টেনশন! কেউ আবারপ্রমাণ করতে চাইল, বাংলাই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাবজেক্ট। কিন্তু শিক্ষর্থী তো আর হতাশ করে আকাশ থেকে পড়েনি, সে এই সমাজেরই একটা প্রোডাক্ট। তখন সে হাসবে, না কাঁদবে ভেবে পায় না। সে হয়ত জীবনে শিক্ষকই হতে চায়নি, চেয়েছে অন্য কিছু। কিন্তু মাস্টার বলছে, মাস্টারি ভিন্ন গতি নাই। শিক্ষার্থী দেখে সামনে হতাশার অন্ধকার।


তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কেন? সার্টিফিকেট বিতরণের জন্য? বাংলাদেশের বাস্তবতায় তাই। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই মনে করে চাকরি লাভের জন্য একটা সার্টিফিকেট চাই, আর সার্টিফিকেটের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ভিন্ন ভালো পথ নাই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান উদ্দেশ্য এটা নয়। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। ভালো মানুষ তৈরির জায়গা। একটা মানুষ কতটা মানুষ হয়ে উঠতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় সেপথ বাতলে দেয়। এই পথই বিশ্ববিদ্যালয়ের পথ। আমাদের দেশে তা উলটো। ফলে জ্ঞানের মধুর ফলের পরিবর্তে তেতো ফল ধরছে সর্বত্র।

জ্ঞানের নানা শাখা আছে। যেকোনো শিক্ষার্থী তার পছন্দের বিষয় নিয়ে পড়বে, সেটাই স্বাভাবিক। জ্ঞানার্জন করবে আনন্দের সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানসৃষ্টিতে সহায়তা করবে। ভালো বিষয় বলে কোনো বিষয় নেই জ্ঞানের জগতে। গুরুত্বপূর্ণ বলে আলাদা কোনো বিষয় নেই। সব বিষয়ই ভালো বিষয়, সব বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ। একটি সমাজ বা রাষ্ট্র তার জাতীয় ইতিহাসের আলোকে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার আলোকে ভালো বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারণ করে নেয়। কিন্তু বিষয়টা আগাপাশতলাই ভুল। লক্ষ্য যদি হয় জ্ঞানার্জন করা, কিংবা মানুষ হয়ে ওঠা তাহলে যেকোনো ডিসিপ্লিনে পড়াশোনা করেই তা সম্ভব। ওই ডিসিপ্লিনের কতটা গভীরে ঢোকা গেল, এটাই হচ্ছে বিচার্য বিষয়। যে-জ্ঞান মানুষকে দানবে পরিণত করে, আর যাই হোক সেটা জ্ঞান নয়। জ্ঞানের যেকোনো শাখায় অধ্যয়ন করে যোগ্য হয়ে ওঠা সম্ভব। নিজেকে মান্য করে তোলাই জ্ঞানীর কাজ। কথায় যেমন চিড়ে ভিজে না, ‘বিষয়’ তেমন মানুষকে জ্ঞানী করে না। বহু কষ্টে নিজেকে জ্ঞানী করে তুলতে হয়, আলোকিত হতে হয়। সেটা কঠিন কাজও। আমাদের বিশ্বদ্যিালয়গুলো যেমন এই কাজের বোঝা নিতে নারাজ, তেমনি আমাদের জ্ঞানার্থী ও তাদের মাতাপিতারা চায় সস্তা একটা ডিগ্রি। ডিগ্রি পেল তো কল্লা ফতে! এইবার একটা ‘পদ’ চাই! আর কে না জানে ‘পদ’ শব্দের শাব্দিক অর্থই ‘পা’, ‘মাথা’ কিন্তু নয়!


যেহেতু কথা হচ্ছিল বাংলা নিয়ে, সেটা দিয়েই উপসংহারে যেতে চাই। যদি চাকরিই চাই তাহলে বাংলা পড়ে টেকনিক্যাল বিষয় ছাড়া চাকরি হবে না; এটা কে বলেছে? যারা বলেন বিসিএস বা অন্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বাংলা থেকে পারা যায় না, আসলে তারা মূল্যায়ন করেন নিজেদের জ্ঞান/অজ্ঞান দিয়েই। মানুষ নিজেকে দিয়ে সবকিছু বিচার করতে অভ্যস্ত বলে এমন বলে থাকবেন। যদি কারও না-হবার থাকে, তাহলে ইংরেজি পড়েও হয় না; আবার ইসলামের ইতিহাস পড়েও ক্যাডারের শীর্ষে যাওয়া সম্ভব। বিশ্বাস না-হয়, খবর নিয়ে দেখুন। এখানে বিষয় টেনে আসা হয় উচ্চন্মন্য/হীনন্ম্যতার জন্য। এখন বিসিএস বা অন্যসব পরীক্ষা উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। মেধা দিয়ে আসতে হবে, যোগ্যতার মাধ্যমে, বিষয় দিয়ে নয়। এখন বাংলায় পড়ে সমস্ত অ্যাকাডেমিক বছরগুলো ঝিঁমুতে ঝিঁমুতে তথাকথিত ‘পাশ’ দিয়ে প্রতিযোতিতামূলক পরীক্ষায় বসলে তো আর হবে না। আর বসে যদি মহা ফেল করে কেউ, নিশ্চয়ই এতে বিষয়ের দোষ দেওয়াও যাবে না। আর অতি পণ্ডিত ও জ্ঞানওয়ালারা, যারা উচ্চাসনে বসে বাংলার প্রার্থীকে অবমূল্যায়ন করেন, সে দায়ও নিশ্চয় বাংলা বিষয়টিও নেবে না! নেওয়া সঙ্গতও নয়। তাহলে কথা আর কী থাকে?

বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাসচিব বাংলা বিষয়ের কিংবা পাবলিক সার্ভস কমিশনের চেয়ারম্যান মহোদয়ও বাংলা বিষয়ের। এইসব পদে যেতে তাদের কেউ আটকেছে? প্রধানমন্ত্রীর কথা বাদই দিলাম। কিংবা আমাদের দেশে যারা প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব আছেন বা ছিলেন যেমন আনিসুজ্জামান, শহীদুল্লাহ, আহমদ শরীফ, মুনীর চৌধুরী, হুমায়ুন আজাদ প্রমুখ; এরা সবাই বাংলা পড়েই তো বিশ্বখ্যাত হয়েছেন, সমাজরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠেছেন/উঠেছিলেন। আমাদের আশেপাশে ‘বাংলা’ নামে হয়ত অবজ্ঞা আছে; তাচ্ছিল্য, অবহেলা আছে; এতে তো আর বাংলা বিষয়ের কোনো দোষ থাকতে পারে না। দোষ হচ্ছে আমাদের ভুল ধারনার অথবা অজ্ঞতার। তাই সাফ কথা হচ্ছে, বাংলা নিয়ে পড়ায় যেমন হীনন্মন্যতার কিছু নেই, তেমনি তথাকথিত ‘ভালো’ বিষয়ে পড়ায় আত্মগৌরবেরও কিছু নাই। জ্ঞান, জ্ঞানই। যে-শাখারই হোক। ফলে একজন শবজিবিক্রেতা (অসম্মান করছি না) বলছেন, ‘বাংলা পড়ে হইবেনটা কী?’ আর আরেকটা ‘আকাট পদস্থ ব্যক্তি’ বলছেন, ‘ও বাংলা!’ আসলে তাদের কথার কোনো ভিত্তি নাই। আমার কাছে দুজনের মধ্যে ইতরবিশেষও কিছু নাই!

জফির সেতু, কবি, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক। সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ১৯ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৮৯ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ