আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

‘কি জমানা আইলো রে বাপ/মৌখিক পরীক্ষারও প্রশ্নফাঁস!’

জফির সেতু  

একদিন দুপুরে জাফর ইকবাল স্যারের সঙ্গে একটা জরুরি মিটিঙে বসেছি; যথারীতি মিটিংও শেষ হয়েছে; পরে গল্প করছি দুজনে বসে বসে। হঠাৎ স্যার বললেন, জফির, আজ সকালে এইচএসসি পরীক্ষার্থী এক ছাত্রী আমাকে  ইমেইল করে আগামীকালের পরীক্ষার ফাঁস-হয়ে-যাওয়া প্রশ্ন পাঠিয়েছে। লিখেছে, সে নিশ্চিত এ-প্রশ্নেই পরীক্ষা হবে কাল; আর অতীতের দুএকটি পরীক্ষায়ও তা-ই হয়েছে। এইটুকু বলে স্যার আমার দিকে তাকালেন। তাকে খুব বিষন্ন মনে হলো।

আমি বললাম, স্যার, এটা তো আরেক সমস্যা শুরু হলো দেশে! স্যার বললেন, কিন্তু এটা থেকে তো বেরিয়ে আসতে হবে। প্রাসঙ্গিক আলোচনার এক ফাঁকে বললেন, আমি একটি কাজ করেছি; মেয়েটির মেইলটি আমি সবকটি সংবাদপত্রের সম্পাদকের বরাবরে ফরওয়ার্ড করেও দিয়েছি সাক্ষ্য হিসেবে। যদি কালকের পরীক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে এই প্রশ্ন মিলে যায় তাহলে দেখব বিষয়টা। পরবর্তী ঘটনা সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে সকলেরই জানা আছে।

এদিকে প্রায় সকল পর্যায়ে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে আর শিক্ষামন্ত্রী মিডিয়াকে বলছেন, এসব সঠিক খবর নয়। জাফর স্যার পত্রিকায় প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি প্রকাশ করলেন; একা শহীদ মিনারে বসে প্রশ্নফাঁসের প্রতিবাদ করলেন । এবং এ-নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী মনক্ষুন্নও হলেন বলে জানি।

তা যেটাই হোক, নিকট অতীতে বাংলাদেশে প্রশ্নফাঁসের যে-হিড়িক পড়েছিল এবং গতসপ্তাহেও স্কুলপর্যায়ের পাবলিক পরীক্ষারও একটি খবর আমার নজরে এসেছে। তা আমাদের সকলের জন্য দুর্ভাগ্য ও আশঙ্কাজনক ঘটনা। আমি জানি না এসবের শেষ হবে কবে; আর কে-ই-বা এর হাল ধরবে। তবে আমিও জাফর স্যারের মতো এর বিহিত হওয়া দরকার বলে মনে করি। যদিও বছরের পর বছর ধরে এই সংস্কৃতি বাংলাদেশে চালু হয়েছে; আর তার বিচার বা প্রতিকার আমরা দেখছি বলে মনে করতে পারি না; কিংবা আমাদের চোখে পড়েও না। এটা সবচেয়ে বিস্ময় ও দুঃখের ঘটনা।


লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি নতুন নয়; কিন্তু তার বাইরেও অনেক ব্যাপার আছে, যা অনেকে জানেন বা জানেন না। গত সপ্তাহে মৌখিক পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের মতো একটা অক্ষেপ বা হতাশা সামাজিক মিডিয়ার মাধ্যমে আমার মতো অনেকেরই গোচরে এসেছে নিশ্চয়ই। বিষয়টা সত্যি বা মিথ্যে যা-ই হোক, এতে আমি অবাক হইনি মোটেও। বিষয়গুলো কমবেশি আমি জানি এবং আমার মতো অনেকেই জানেন। আমরা শুধু মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকি, কথা বলি না; যদি কেউ কিছু মনে করে কোনো বিড়ম্বনার কারণ হয়ে বসে। যদিও আমি এটা বিলকুল ভাবি না।

প্রসঙ্গেক্রমে আমি আমার দুটি অভিজ্ঞতার কথা বলব; তারও আগে আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই। কবছর আগে একদিন স্কুল থেকে ফিরে আমার সপ্তম শ্রেণি পড়–য়া ভাগ্নে তার মাকে এসে বলল, আগামী পরীক্ষার পর সে স্কুল বদলে ফেলতে চায়। মা তো অবাক; কারণ এ-স্কুলটি খুব ভালো, শিক্ষকরাও। কারণ জানতে চাইলে বলল, প্রাইভেট পড়ে না, এমন শিক্ষকরা তাকে কম নম্বর দেন। শুধু তাই না, যারা ওই শিক্ষকের কাছে পড়ে তারা পরীক্ষার আগে প্রশ্নও বলে দেন। তাই ভালো ছাত্র না-হয়েও ওরা ভালো নম্বর পায়, আর গাধার মতো পড়েও সে পায় কম নম্বর। এই বিষয়টি আমার বোন আমাকে বললে আমি হতবাক হই। এবং আমার ভাগ্নের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ভেতরে কষ্টও অনুভব করি। এটা হচ্ছে সাধারণ একটা বাস্তবতা।

বাংলাদেশে মহামারী আকারে যেভাবে প্রইভেট টিউশনি বা কোচিং ছড়িয়ে পড়ছে বা ছাত্ররা বাধ্য হচ্ছে তার প্রধান কারণও কিছু অসাধু শিক্ষকের ‘মুখে প্রশ্ন বলে দেওয়া’। ছাত্ররা জানে ‘ওই’ স্যারের কাছে পড়লে সে-বিষয়ে তার আর চিন্তা নেই। এই ‘রোগ’ স্কুল কেন, কলেজ পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়েছে;  আর তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গোটা প্রজন্ম ও জাতি। পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস অবশ্য ভিন্ন কারণে হয়, করে থাকে বিভিন্ন অসাধু সিন্ডিকেট। আমরা তো অতীতে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায়ও প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে দেখেছি।  বিশ্ববিদ্যালয়েও এই ‘রোগ’র  প্রদুর্ভাব নেই এমনটা শক্ত গলায় বলা যাবে না।  এখানে একটা কথা আছে; বিশ্ববিদ্যালয়ে তো কোচিং বা প্রাইভেট পড়ানো হয় না, তাহলে কেন এমন হয়? বিষয়টা ভাবার মতো। আমার মনে হয়, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে এবং পড়ান তাদের অনেকেরই জানা আছে, পছন্দ করেন এমন ছাত্র/ছাত্রীকে অনেক শিক্ষক (?) প্রশ্ন বলে দেন পরীক্ষার আগে আগে। আবার দলীয় আদর্শবাদীর ‘একটা গোষ্ঠী’ও এমনটা করেন, নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শের কাউকে ভালো নম্বর পাইয়ে দেওয়ার জন্য কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির যোগ্য করে তোলার জন্য। বিষয়টা অবিশ্বাস্য হলেও বাস্তব। কেউ কেউ পরীক্ষার খাতায়ও বাসায় এনে লিখিয়ে নেয় ছাত্রটিকে দিয়ে; এমন অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে চাকরি হারানো শিক্ষকের কথাও কারো অজানা নয়। কিন্তু আজকের প্রসঙ্গ একেবারে ভিন্ন। মৌখিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস বিষয়ে।


একবার প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য আমি বিশেষজ্ঞ হিসেবে একটা কলেজে গিয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিনিধি হয়ে। আমার সঙ্গে কাজ করতে এসেছেন সরকারি কলেজের একজন অধ্যাপক। তিনি ডিজিইর প্রতিনিধি। বেশ কজন চাকরিপ্রার্থী অংশগ্রহণ করবে পরীক্ষায় আমাদের জানানো হলো। স্বাভাবিকভাবেই আমরা চাইলাম প্রথমে লিখিত পরীক্ষা নেব, পরে মৌখিক পরীক্ষা। আমার সিদ্ধান্ত জানানোর পরে ডিজিইর প্রতিনিধি বললেন, স্যার, আপনি কষ্ট করে প্রশ্ন করবেন, এটা চিন্তা করে কাল রাতেই আমি একটা প্রশ্ন করেছি; নিয়েও এসেছি। কষ্ট করে কী লাভ? এই প্রশ্নেই পরীক্ষা নিয়ে নেন। অধ্রাপক মহোদয়ের কথা শুনে আমি মহা বিপদে পড়লাম; এখন আমি কী করি? একটু হেসে বললাম, সিওর, দেখি প্রশ্ন! তিনি প্রশ্ন মেলে ধরলেন। আমি বললাম, সুন্দর প্রশ্ন! উনি তখন বললেন, স্যার তাহলে ফটোকপি করতে দিই? আমি বললাম, দেন; তবে প্রশ্নগুলো একটু মডিফাই করে দেন। এই বলে দুজন একসঙ্গে বসলাম, এবং তার প্রশ্নে ওপরেই এমনভাবে কিছু যুক্ত করলাম, যা আসলে ঠিক আগের প্রশ্ন নয়; এর বিপরীত। বললাম, এবার একটু ফ্রেশ করে, ফটোকপি করতে দেন। প্রতিনিধির চোখ গোল হয়ে গেল।

নতুন প্রশ্নেপত্রে পরীক্ষা হলো; খাতা দেখাও হলো। আমি বুঝলাম প্রতিনিধির একজন প্রার্থী আছেন। বা কলেজ অধ্যক্ষ সে-প্রার্থীর জন্যই এমন প্রশ্ন করিয়েছিলেন। শুরু হলো মৌখিক পরীক্ষা। একে একে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। দেখা গেল একজন ‘বিশেষ প্রার্থী’র চোখ পিট পিট করছে; আর প্রতিনিধি ও অধ্যক্ষ মহোদয় তিরের মতো প্রশ্ন ছুঁড়ছেন; প্রার্থীও দেদার উত্তর দিয়ে চলেছেন। আমি লিখিত পরীক্ষার নম্বর দেখতে গিয়ে দেখলাম, সর্বনিম্ন নম্বর পেয়ে লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেছেন মৌখিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ এই  প্রার্থী। একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ডও ভালো নয়। তো আমি বললাম, বাহ আপনি তো খুব ভালো করছেন; কিন্তু লিখিত পরীক্ষা তো তেমন ভালো হয়নি! আচ্ছা, আমি আপনাকে দুটি প্রশ্ন করব; খুব সাধারণ প্রশ্ন। প্রথমেই জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, ধ্বনি ও বর্ণের মধ্যে পার্থক্য কী? তিনি কোনো জবাব দিতে পারলেন না; বা যা দিলেন তা নেওয়াও গেল না। আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, বাংলা স্বরধ্বনি আসলে কয়টি? তিনি হা করে অধ্যক্ষের দিকে তাকালেন। আমি আশা করি পাঠক যা বুঝার বুঝেছেন; আমার আর বুঝানোর দরকার নেই। তবে চাকরিটা তার হয়নি। হয়েছিল এমন একজনের, যিনি স্বপ্নেও ভাবেননি এখানে চাকরিটা হবে তার। কেননা এপ্লিকেশন ড্রপ করতে এসে প্রার্থী জেনেছিলেন, এখানে একজনে চাকরি ঠিক করাই আছে। তবে সেই নিয়োগবোর্ডে পরীক্ষা নিতে গিয়ে যা লাভ আমার হলো; ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাছাইবোর্ড থেকে আমি বাদ পড়লাম!

দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা হচ্ছে, আমি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছি চাকরির ভাইভা দিতে। ওয়েটিংরুমে আমার মতো অনেকেই বসে আছেন। হঠাৎ দেখলাম, একজন প্রার্থী কিছু নোটে চোখ বুলিয়ে নিয়ে গুনগুন করছেন। কী যেন মুখস্থ করছেন। সবার মনোযোগও তার দিকে। তিনি কিছুতেই বসে থাকতে পারছিলেন না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, হেঁটে হেঁটে একটা নোটবুকের দিকে চোখ দিয়ে গুনগুন করেই যাচ্ছেন। তাকে খুব নার্ভাস লাগছিল। মনে হচ্ছিল তিনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন যে-কোনো সময়। একসময় তার ডাক পড়ল, তিনি ঢুকলেন নীলবর্ণ ধারণ করে; বেশ কমিনিট পর বেরিয়েও আসলেন। তখন তার মুখ লাল ও হাসি মাখা। কে একজন, কেমন হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, আমি সব পেরেছি! জানা গেল তিনি যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছেন বোর্ডে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকই বিশেষজ্ঞ হিসেবে এসেছেন। চাকরিটা তারই হয়েছিল। যদিও ফল বিবেচনা করলে ছাত্র হিসেবে তিনি ভালোমানের ছিলেন না। আর প্রার্থীদের অনেকেই তার চেয়ে অনেক বেশি যোগ্য ছিলেন, অন্তত অ্যাকাডেমিকভাবে। তো, মুখস্থ করার রহস্য এবং ‘সব’ পারার রহস্য নিশ্চয়ই পাঠককে এখন বলে দিতে হবে না। ‘সব’ পেরে তিনিও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেন!


যেটা বলছিলাম, গত সপ্তাহে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাসে বুঝলাম, চাকরির পরীক্ষা দিতে গিয়ে স্ট্যাটাসদাতা প্রবল ‘ধরা’ খেয়েছেন। বিষয়টা হচ্ছে, ভাইভা থেকে বেরিয়ে এক প্রার্থী নাকি সোল্লাসে জানাচ্ছিলেন, তিনি ‘সব’ পেরেছেন! এবং ওই পরীক্ষার্থীও বোর্ডে ঢোকার আগে নোট মুখস্থ করছিলেন। ফলে তিনি বা তার মতো অনেকেরই ধারণা ‘কী প্রশ্ন করা হবে’ ওই প্রার্থী আগে থেকেই জেনে গেছেন যে-কোনোভাবে। আসলে বিষয়টা আমাদের জন্য শুধু লজ্জার না, এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে আমাদের ভবিষ্যতও; উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যত। এখন, বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ যদি প্রশ্ন পেয়ে পাশ করে, ভালো ফলাফল করে; সে-ই যদি আবার মৌখিক পরীক্ষায়ও এমনভাবে পার পেয়ে শিক্ষক বনে যায়, তাহলে ভাবুন আমাদের ভবিষ্যত কী?

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা, শিক্ষকরাই জাতিগঠনে সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা পালন করেন। সেই শিক্ষক যদি হন ‘হাইব্রিড’, তাহলে একটি জাতির বাঁচার উপায় আর থাকে না। আলাপকালে একবার একজন বলেছিলেন, হালচাষের জন্য দরকার হয় গরু বা মহিষের; ছাগল দিয়ে হালচাষ চলে না। কিন্তু ভাইভা নামক পরীক্ষা দিয়ে আমাদের দেশে এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘ছাগল’ নিয়োগ পায়। একজন প্রার্থীকে পাঁচ থেকে দশ মিনিটে কোনোভাবেই মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। বরং উচিতও না। এমনও শুনেছি কাউকে অ্যাকাডেমিক কোনো প্রশ্ন না-করে শুধু রবীন্দ্র সংগীত গাইয়েই চাকরি দেওয়া হয়েছে। চাকরিটা অবশ্য রবীন্দ্রসংগীতের ওস্তাদের না, ছিল দর্শনের শিক্ষকের।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিপ্রার্থী আমার এক সুহৃৎ জানিয়েছেন, তিনি যখন একবার ভাইভা বোর্ডে ঢুকছিলেন; বোর্ডের চেয়ারম্যান তখন ঘরের একপাশের সোফায় বসে কমলা খাচ্ছিলেন; অন্যদিকে বিভাগের চেয়ারম্যান ওয়াশরুমে ঢুকছিলেন। যেখানে কোনো প্রার্থীকে মূল্যায়নের জন্য একসঙ্গেই মূল্যায়ন করতে হবে নির্বাচকমণ্ডলীকে। একবার এক ভাইভাতে ঢুকেই মনে হলো আমি বুঝি ভুল জায়গায় প্রবেশ করে ফেলেছি। বোর্ডের সবাই খাওয়া-দাওয়া করছিলেন, আর একেকজন আমার দিকে তির ছুঁড়ছিলেন যেন আমি ধরাশায়ী হই। একজন জিজ্ঞেস করে বসলেন, আমি কবিতা না-লিখে নাটক লিখলাম না কেন? সবকিছুর তো একটা সীমা থাকা উচিত?
এরকম কতোকিছুই তো আছে। সবচেয়ে বড়ো কথা, অনেক ভালো ফলাফল করে, ব্যাংক ড্রাফট কেটে ও পয়সা খরচ করে মৌখিক পরীক্ষা দিতে আসে অনেকে। কিন্তু অনেক প্রার্থীর ক্ষেত্রে গোটা বোর্ড এমন নির্বিকার থাকে যে, ভাবতে বেচারীর চোখে জল আসে। দেখা গেল মৌখিক পরীক্ষার পরিবর্তে তামাশাজাতীয় কিছু শুরু হলো। আরেকবার সহকারী অধ্যাপক পদে মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে গিয়েছিলাম দেশের প্রধান এক বিশ্ববিদ্যালয়ে; পরীক্ষাও শেষ হলো। তির ছুঁড়লেন বোর্ডের চেয়ারম্যান মহোদয়, বললেন; আমরা আসলে ‘সহকারী অধ্যাপক’ নিতে চাই; আপনাকে তো নিলে তার ওপরে অর্থাৎ ‘সহযোগী অধ্যাপক’ পদে নিতে হবে! আমি মনে মনে বলালাম, হা ঈশ্বর! সঙ্গে সঙ্গে একজন সদস্য আমার সামনেই উচ্চারণ করেছিন, ‘হোয়াই নট, নাও!’ এখনো বাক্যটি আমার কানে বাজে। এই প্রতিবাদ আমাকে আজো ইনস্পায়ারড করে।

দেখা যায় একটা বিজ্ঞপ্তিতে যে-সব শর্ত চাওয়া হয় শিক্ষক হিসেবে, নির্বাচকমণ্ডলী সে-সব শর্তকেও উপেক্ষা করে প্রার্থী নিয়োগে সুপারিশ দিয়ে বসেন। সম্প্রতি এরকম কাহিনি একটা পোর্টালে দেখলাম। এরকমটা প্রায়শ ঘটে থাকে যে, যারা চাকরির দরখাস্ত করেছিল; সার্টিফিকেট অনুযায়ী অধিকতর যোগ্য প্রার্থীকে রেখে; কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা সিভিল সার্ভিসে চাকরি-করা অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রার্থীকে রেখে, কম যোগ্য প্রার্থীকে নির্বাচিত করে বসে বোর্ড। এতে লাভ কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হতে পারে হয় তো; কিন্তু ক্ষতি হয় সারা দেশের। যোগ্য মানুষকে বঞ্চিত করে অযোগ্যকে পুরস্কৃত করলে, এর ফল শুভ হয় না কোনোকালে। একবার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে একজনের চাকরি হয়েছিল; সম্প্রতি স্বামীর মৃত্যু হয়েছিল বলে। আবার, আরেকটি নিয়োগ হয়েছিল, একজন খুব ‘পরহেজগার’ বলে। আসলে এসব উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে নৈতিক অবক্ষয়েরই লক্ষণ।

একটা সাধারণ বিষয় আমার মতো অর্বাচীন লোক যেখানে বোঝে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো মাননীয় উপাচার্য কেন বুঝতে চান না আমি জানি না। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগে শুধু সার্টিফিকেট বা মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে মূল্যায়ন করা কি উচিত? একজন শিক্ষককে নানামুখী প্রতিভার অধিকারী হতে হয়। তা না হলে ভালো শিক্ষক হওয়াই সম্ভব নয়। আমার মনে হয় পরীক্ষার ফলাফল, আগ্রহ, কর্মক্ষমতা, সৃষ্টিশীল প্রতিভা, জীবনদৃষ্টি, রুচিবোধ, ব্যক্তিত্ব প্রভৃতি মূল্যায়ন করেই নিয়োগ দেওয়া উচিত। ধরুন একজন দেশবিরোধী, মৌলবাদী, ধূর্ত বা প্রতিক্রিয়াশীল কেউ যেনতেন প্রকারেন একটা ভালো ফলাফল করে বসল; এর মানে কি এই, তাকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক করতে হবে?  কিংবা কথা বলতে পারে না গুছিয়ে, এমন কাউকে শিক্ষক করতে হবে? অথবা, সংস্কৃতিবান নয়, শুধু ভালো ফলাফলের জন্য শিক্ষক করতেই হবে? আমার অভিজ্ঞতায় এদের অনেকের দ্বারা আসলে কিছুই হয় না; এতে শুধু সরকারের টাকার অপচয় হয় না, প্রজন্মের তথা দেশের ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি। শুধু ফলাফল আছে, অথচ পড়াশোনায় নেক নেই; এমন কেউ ভাইভার প্রশ্ন ফাঁস করেই তাহলে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে যায়। যেটা সত্যিকার অর্থেই অমঙ্গলজনক।


আমি যখন কলেজে পড়ি, কিংবা পরে কলেজে পড়াই; নব্বইয়ের দশকের শেষ ও শূন্য দশকের প্রথম দিকে বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে গাঢ় অন্ধকার নেমে এসেছিল। পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে এক-একটি পাবলিক পরীক্ষা এলেই নকলের মহোৎসব শুরু হতো সারা দেশে। সর্বত্র ছিল নকলের ছড়াছড়ি। নকলের জন্য ফটোকপি করা ও নকল সাপ্লাই দেওয়া একটা পেশাতে পরিণত হয়েছিল। এরকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন একজন যুবাপুরুষ। আমার মনে আছে মন্ত্রীপরিষদের সদস্য হয়ে তিনি নকলের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন। আমার যতদূর মনে পড়ে, শিক্ষকরাও হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন নকলের প্রশ্নে। দেশ পরীক্ষায় অরাজকতার চরম শিখরে পৌঁছেছিল। মন্ত্রী সাহেব তার একক উদ্যোগে কবছরের মধ্যেই বিষয়টা নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছিলেন। এখন তো নকলের উৎসব আর হয় না। এখানে উদাহরণ হিসেবে রাজনৈতিক এই উদযোগের কথা বললাম। যদি শিক্ষপ্রতিমন্ত্রী হেলিকপ্টার নিয়ে সেন্টারে সেন্টারে না-যেতেন, শিক্ষক-কর্মকর্তাকে সাহস ও সহযোগিতা না-দিতেন তাহলে এখন দেশের অন্য আরেক রূপ হতো। সুতরাং আমি মনে করি লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের মতো মৌখিক পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের বিষয়টিও ধর্তব্যের মধ্যে আনতে হবে এখন। অন্যদিকে নিয়োগে মৌখিক পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস শুধু গর্হিত কাজ নয়, এটা সবচেয়ে বড়ো অপরাধও। এখানে শুধু একজনকে পাশ করানো হচ্ছে না কিংবা শুধু ভালো গ্রেডের বিষয়ও আসছে না; এখানে যোগ্যপ্রার্থীকে ফেলে দিয়ে অযোগ্য প্রার্থীকে নিয়োগ দিয়ে দেশের বড়ো ধরনের ক্ষতিসাধন হচ্ছে। যোগ্যকে ডিপ্রাইভড করা হচ্ছে। এটা শুধু অনাচার নয়, অবিচারও। কিন্তু তা রোধের প্রক্রিয়াও বড়ো কঠিন।

এধরনের অপরাধকে যেমন প্রমাণ করা সম্ভব নয়, তেমনি চ্যালেঞ্জ করাও অসম্ভব। আমার মনে হয় নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের ব্যক্তিগত সততাবোধ ও নিয়োগদানের প্রক্রিয়ার পরিবর্তন করে সার্বিক মূল্যায়নের মাধ্যমে যোগ্যতা বাছাই করলেই এর পরিত্রাণ সম্ভব। আর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা; এমনকি নিজের প্রতিও। এই তো কদিন আগেও একজন উপাচার্য মহোদয় বলেছেন, যে-সব শিক্ষক ক্লাসে পড়াতে পারেন না, গল্প করেন; তাদের ক্লাসে ছাত্ররা বসে থাকবে কেন? এটা ব্যক্তিগতভাবে আমাকে খুব আশাবাদী করে তুলেছে। আমি মনে করি তার কথাই বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়দের কথা। অর্থাৎ, যোগ্যকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বেছে নেওয়া হবে; আর অযোগ্যকে ঠেলে দেওয়া হবে দূরে; ‘অযোগ্য’-এর জন্য রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও অন্য আর জায়গা।

জফির সেতু, কবি, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক। সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ