আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

আহা তরুণ, তোর ‘ক্ষ্যাত’ মুখ!

আলমগীর শাহরিয়ার  

জীবন যাপন করা কতোটা অসহনীয় উঠলে মানুষ আত্মহননের পথ বেঁচে নেয়-ঠিক জানা নেই। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ নামে যে ছেলেটি পুরান ঢাকার এক মসজিদের ছাঁদ থেকে লাফিয়ে পড়ে নিজের জীবনের সব লীলাখেলা সাঙ্গ করে চিরতরে চলে গেছে- সে নিশ্চয়ই জানত।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের কাছে শুনেছি, যুদ্ধে নাকি সবাই যায় দলবেঁধে, কিন্তু পালায় একা। জীবন যদি যুদ্ধ হয় কিংবা উৎসব-সে যুদ্ধ ও উৎসবে আমরা সবাই লড়ছি, হতোদ্যম হচ্ছি আবার জিতে গিয়ে কখনো উদযাপন করছি। কিন্তু অন্তিমে, আখেরে সবাই পালাই একাই। কেননা মৃত্যুই মানুষের জীবনের অমোঘ নিয়তি।

তরুণের জীবনযুদ্ধ থেকে পালানোর ঘটনাটিও স্বাভাবিক ছিল না। ছিল বড্ড অস্বাভাবিক, অসময়ের। কিন্তু কেন এই আত্মহনন?

জানা যায়, আর আট-দশটি ছেলের মেয়ের মত তরুণও বুক আর চোখভরা স্বপ্ন নিয়ে গ্রাম থেকে এই করুণ শহরে এসেছিল। ছোটবেলা মাকে হারিয়েছিল। মায়ের মমতাহীন, জাগতিক শ্রীহীন এক দুঃখের জীবন ছিল তার। অভাব-অনটন নিত্য লেগেই ছিল, ক্ষেত থেকে আসা মজুরের পোলার চেহারায় সেই ছাপ স্পষ্ট ছিল! শহুরে সম্ভ্রান্তরা, নাক উঁচু বিদ্যায়তনে পড়ুয়ারা নিরাপদ দুরত্বে থাকত। তাদের স্মার্টফোনের আকর্ণবিস্তৃত সেলফিতে ওর কালো 'ক্ষ্যাত' মুখ বড় বেমানান ছিল। মুখ ফুটে বলত না কিন্তু ওরা হাবভাবে বুঝিয়ে দিত। বন্ধু ভাবা দূরে থাক নিরাপদ দুরত্ব বজায় করেই শেষ নয়, সুযোগ পেলেই ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ আর উপহাস করতে কসুর করত না (উপরন্তু ছিল ফিনান্সের মত কঠিন বিষয় অধ্যয়নের চাপ, কুলিয়ে উঠতে না পেরে বিভাগ বদলাতে চেয়েছিল ছেলেটি আর ছিল অসহনীয় আর্থিক টানাপোড়েন)।

ধানসিঁড়ি নদী, হেমন্তের মাঠ, মাছরাঙা পাখিটারে নিয়ে উচ্ছ্বাস করা রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ তাদের কাছে অপাংক্তেয়, যেমন অপাংক্তেয় ঠেকে রবীন্দ্র হৃদয়ে বাঙালির হাজার বছরের সঞ্চিত আবেগ মন্থিত গান, "ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কি দেখেছি মধুর হাসি। কি শোভা কি ছায়া গো, কি স্নেহ কি মায়া গো কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে নদীর কূলে কূলে। মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো" যে দেশের জাতীয় সংগীতে দেশকে মায়ের সঙ্গে তুলনা, মওসুমের ভরা ক্ষেত-কে মায়ের সমৃদ্ধি, সুখ ও শান্তির প্রতীকতুল্য মধুর শব্দ হিসেবে দেখানো হয়েছে সেটাকে উপহাসের কুৎসিত অস্ত্র করে তুলল- এ কেমন উন্নাসিক প্রজন্ম!

যে দেশের কৃষি এখনও অর্থনীতির প্রাণভোমরা, যেদেশের কবি গান গায় সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা -সেদেশে কৃষকের মজুরের ছেলেকে 'ক্ষ্যাত' বলে উপহাস করে, বর্ণবাদের অস্ত্র বানায় এরা কোন শ্রেণি ও গোত্রের? জানতে ইচ্ছে করে। এদের শিক্ষা এদেশের মাটি, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ভূগোল, আউল বাউল মরমিয়া মন-মনন, স্বাধিকারের লড়াই সংগ্রাম ও স্বপ্ন থেকে বিচ্যুত কিনা ভেবে দেখা দরকার।
 
নদী-মাঠ-ক্ষেত অধ্যুষিত এই ভূ-খণ্ডের এক গণ্ডগ্রাম থেকে আসা ছেলেটি নিশ্চয়ই ইতিহাসের কোন পৃষ্ঠায় জেনেছিল পুর্ববঙ্গের কৃষকের সন্তানদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছিল একদিন। এর রাজপথেই অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের  উপাদান, প্রেরণা ও পরিচয় ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেওয়া সালাম, বরকত, রফিকের রক্তের উত্তরাধিকারের পথ ধরেই এসেছিল মহান মুক্তিযুদ্ধ, বিজয়, লাল সবুজের পতাকা, বিশ্বমানচিত্রে স্বাধীন একটি দেশ। সেই একখণ্ড রক্তামাখা মাটির বুকেই নতুন স্বপ্ন ও দুর্জয় সাহসে বুক বেঁধে আসে তরুণেরা। কিন্তু কেন এই নির্মম, বেদনাময় তরুণের মূল্যবান জীবন অপচয়! দেখবার কী কেউ ছিল না! ছিল না একটু সাহস, ভরসা ও ভালোবাসা দেবার!

এসব প্রশ্নের উত্তর কারোর না কারোর দেবার কথা, আমাদের ঘুমিয়ে যাওয়া চৈতন্যে আলোড়ন তোলার কথা। কিন্তু সে আলোড়ন উঠছে কই? ত্রিশ বছর ধরে ছাত্র প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ডাকসু নির্বাচন কই? যে ছাত্রদের জন্য সব আয়োজন তাদের বঞ্চনা ও অধিকারের পক্ষে কথা বলার প্ল্যাটফর্ম কই? কারা সচেতনভাবে বছরের পর বছর সুচতুর বুদ্ধিমত্তায়, কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছেন এসব প্রশ্ন? ধীরে ধীরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রামাঞ্চল থেকে আসা ছেলে-মেয়েদের উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন ও সম্ভাবনার জন্য প্রতিকূল হয়ে উঠছে - তা কি ভেবে দেখছেন কেউ? দিনকে দিন এই বিশ্ববিদ্যালয় তাদের স্বপ্নপূরণের সিঁড়ি না হয়ে নব্য এক ধনিক শ্রেণির সন্তানদের জন্য তৈরি হচ্ছে। শিক্ষাপণ্য বেচাকেনার হাট হয়ে উঠছে কিন্তু কারোর কোন বিকার নেই। এখানে বছর বছর বেতন বাড়ছে, যাদের জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয় সেই ছাত্রদের আবাসিক সংকট নিরসন না হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়নাভিরাম সবুজ সৌন্দর্য অবহেলা করে, ধ্বংস করে বছর বছর শিক্ষক-কর্মচারীদের দৃষ্টিকটু আকাশচুম্বী ভবন উঠছে। অথচ ছাত্র-ছাত্রীদের শ্রেণিকক্ষ সংকট নিরসন হচ্ছে না। তারা ক্লাসের সময় রুমের খোঁজে দৌড়ায়! গবেষণা বাজেট বাড়ছে না। সোনালী তারুণ্য যৌবন সমর্পণ করা বিসিএস উন্মুখ প্রজন্ম জ্ঞানজগতে মৌলিক কোন অবদান রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। যেমন চরম ব্যর্থ হচ্ছেন শিক্ষকেরাও।

এখানে শিক্ষকদের পদোন্নতির জন্য নতুন কোন জ্ঞান সৃষ্টিতে ন্যুনতম অবদান রাখতে হয় না। রাজনীতির বিচিত্র রঙে তাদের শান-শওকত বাড়ে। পাইকারি হারে পদোন্নতি এখানে যতোটা সহজ বিশ্বের আর কোথাও এতোটা সহজ আছে কিনা জানা নাই। যতটা না প্রয়োজন তারচেয়ে বেশি জাগতিক হিসেব-নিকেশের যোগ বিয়োগে নতুন নতুন বিভাগ খোলা হচ্ছে। যেন পদায়ন ও পুনর্বাসনের নতুন মওকা ও দ্বার। গোদের উপর নির্লজ্ব বিষফোড়ার মত আছে সান্ধ্যকালীন কোর্স। শিক্ষার নামে বাণিজ্য, বেসাতি। কিন্তু এসব নিয়ে কারোর কোন বিকার নেই! যেন এক আজব কানার হাটবাজার। এই বাজারে তরুণের মৃত্যু কারোর হৃদয়ে কোন আলোড়ন তুলে না।

দুর্ঘটনার মহাসমুদ্রে টুপ করে ডুবে যাওয়া যেন একখণ্ড জঙ ধরা ক্ষয়িষ্ণু লোহা। হয়ত অস্ফুটে তার শোকে একবেলা ভার্চুয়াল হাহাকার হবে, হয়তো কেউ বলবে মরেই গেল মাইরি-উহু, আহা!

আলমগীর শাহরিয়ার, কবি ও প্রাবন্ধিক। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ