আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

শামসুর রাহমান থেকে জাফর ইকবাল

সুকান্ত পার্থিব  

কবি শামসুর রাহমান থেকে লেখক ও অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। ১৯৯৯ সালের ১৮ জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ০৩ মার্চ। মাঝখানে কেটে গেছে প্রায় কুড়ি বছর!

হরকাত-উল জিহাদ (হুজি) থেকে জেএমবি, জেএমবি থেকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, তারপর জেএমজেবি, নিও-জেএমবি আরও কতশত নাম! একই নামের কতশত রূপ; যাদের উদ্দেশ্য একটাই। একাত্তরের ঘাতক জামায়াত ইসলামির আদর্শিক ধারায় বাংলাদেশকে প্রতিক্রিয়াশীল, ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক, কূপমণ্ডূকের রাষ্ট্রে পরিণত করা।

যাইহোক, অধ্যাপক জাফর ইকবাল স্যারের মতোই ২০০৪ সালে একই ধরণের বর্বরতার শিকার হয়েছিলেন প্রথাবিরোধী বহুমাত্রিক লেখক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ! তিনিও সিএমএইচ -এ চিকিৎসাধীন ছিলেন। মৃত্যুর সাথে লড়াই করে কিছুদিনের জন্য ফিরে আসতে পেরেছিলেন জীবনে। তবে ঘাতকের বর্বরতা, শরীরের গভীর ক্ষত, আঘাতের চিহ্ন তাঁকে আর জীবনাশ্রয়ে টিকতে দেয়নি। প্রশ্নবিদ্ধ এক মৃত্যুর কালিমা বয়ে বেড়ায় বাংলাদেশ, তাঁর ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল। একটা জঙ্গি সংগঠন নিষিদ্ধ হলে দশটির জন্ম হয়েছে নতুন উদ্যমে, ভিন্ন কূটকৌশলে, একই অর্থদাতার আশ্রয়ে। রাষ্ট্র জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে পারেনি বাংলাদেশ থেকে। বারংবার উত্থান হয়েছে জঙ্গিবাদের খুবই সুকৌশলে, গভীর ষড়যন্ত্রে। ফলশ্রুতিতে আমাদের দেশের সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতায় একইরকম বর্বরতায় হারাতে হয়েছে স্থাপত্যবিদ ও ব্লগার রাজীব হায়দার শোভন, বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়, ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু, ব্লগার ও বিজ্ঞান লেখক অনন্ত বিজয় দাশ, ব্লগার নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় নীলয়, জাগৃতির প্রকাশক ফয়সাল আরেফীন দীপন, অনলাইন এক্টিভিস্ট নাজিমউদ্দিনকে।

মধ্যযুগীয় বর্বরতার শিকার হয়ে প্রাণে বেঁচে যান শুদ্ধস্বরের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল, লেখক ও গবেষক রণদীপম বসু ও কবি তারেক রহিম। গণজাগরণমঞ্চের উত্থানকালে রাজীব হায়দারের হত্যা ব্যতীত পরবর্তীতে কোন লেখক-ব্লগার-প্রকাশকের হত্যায় কিংবা প্রাণনাশের হামলায় বাংলাদেশ সরকার প্রধানের কোন বক্তব্য শোনা যায়নি তাদেরকে নিয়ে, তাদেরকে হারিয়ে। অনুশোচনার স্বর ব্যক্ত হয়নি কোথাও! শুধু শোনা গেছে শান্তির স্বপক্ষে বাণী।

যাইহোক, বাংলাদেশের প্রধানতম কবি শামসুর রাহমান হত্যাপ্রচেষ্টার শিকার হয়েছিলেন প্রায় বিশ বছর আগে নিজের বেডরুমে। দুই দশক অতিক্রমণকালীন সময়েও আমরা তাঁর হত্যা চেষ্টাকারীদের বিচারিক আদালতের রায়ে দোষী সাব্যস্ত করতে ব্যর্থ হয়েছি। মামলার পুনর্জাগরণ ব্যবস্থার আয়োজন এখনো সম্পন্ন হয়নি!

পেরিয়ে গেছে চৌদ্দটি বছর, এখনো সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়নি লেখক হুমায়ুন আজাদের প্রাণনাশের মামলার। চার্জশীট থেকে হুকুমের আসামীর নাম উধাও! আজব দেশের সরব কারবারি। অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাশ হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন তিনবছরেও চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি! কিন্তু, প্রমাণ, তথ্য-উপাত্ত, তদন্তকারীদের চোখের সামনে দিয়ে নাকের ডগা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে তদন্তের কিন্তু শেষ হচ্ছে না অনেক প্রমাণ থাকা সত্বেও। বিচারিক কালক্ষেপণ তো দূরেই থাকলো, এই সময়ক্ষেপণ-ই যে কবে শেষ হবে তা কে জানে?

অধ্যাপক জাফর ইকবাল স্যারের উপর আঘাত মানে বাংলাদেশের মানচিত্রের উপর আঘাত। মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের হত্যার চেষ্টাকারীকে হাতেনাতে ধরা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সহায়তায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই হামলায় নিন্দা প্রকাশ করে স্যারের উন্নত চিকিৎসার ব্যাপারে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি হামলাকারীর বিষয়ে বক্তব্যও দিয়েছেন এক অনুষ্ঠানে। তবে রাজীব হায়দারের পর এবারই প্রথম ছিল এমন সহমর্মিতার আভাস তাঁর বক্তব্যে!

পুলিশ হেফাজতে আছে হামলাকারী মাদ্রাসাছাত্র ফয়জুল হাসান ওরফে শফিকুর। প্রাথমিকভাবে সে স্বীকারোক্তিতে বলেছে, 'জাফর ইকবাল ইসলামের শত্রু বলে তাঁকে হত্যা করতে এসেছিল।' এতে বোঝার কোন ঘাটতি থাকে না যে, এই ফয়জুল কোন মতাদর্শের, কাদের আশ্রয়ের? ফয়জুল গ্রেফতার হলেও এবার কী এই হত্যাচেষ্টার পেছনে মূল পরিকল্পনাকারী, মূলহোতা অন্ধকারেই রয়ে যাবে নাকি জনগণের সামনে বেড়িয়ে আসবে তাদের নাম-পরিচয়?

'৭১ -এর ২৫ মার্চ, ১৪ ডিসেম্বর আমরা একবারে হারিয়েছি বাংলার সূর্য সন্তানদের। আর স্বাধীনতার ৪৭ বছরে পা রেখেও আমরা এমন প্রতিক্রিয়াশীল আক্রমণ, রাষ্ট্রের বুকে-মাথায় আঘাত সহ্য করে যাচ্ছি স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বারংবার উত্থানে। আর এখনো কোন প্রথিতযশা ব্যক্তির হত্যা বা হত্যাচেষ্টা মামলার বিচারিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি বিচার ব্যবস্থা। যেখানে অন্তর্নিহিত রাষ্ট্রের সরকারের ব্যর্থতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথাযথ সহযোগিতার অভাব, নেপথ্যকারীদের পরোক্ষ সমর্থন, তদন্ত প্রতিবেদনের ফাঁকফোকর, মূলহোতাদের নিয়ে লুকোচুরি এবং বিচারিক জটিলতায় কালক্ষেপণ তো আছেই। অনেকক্ষেত্রে মূলহোতা বা পরিকল্পনাকারীদের কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যা তো নতুন কিছু নয়! অনেককিছুই তখন থমকে দাঁড়ায়, পার পেয়ে যায় অপরাধী, গতি বদলায় মামলার রূপ, স্রোত প্রবাহিত হয় তখন ভিন্ন দিকে!

জাফর ইকবাল স্যারের প্রাণনাশের হামলার মূলহোতারা, রাঘব-বোয়ালরা আলোর সামনে আসুক, বিচারিক কাঠগড়ায় দ্রুত বিচার আইনে অপরাধীদের বিচার হোক -এটাই মুক্তচিন্তার মানুষদের প্রত্যাশা। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সকল ক্ষেত্রে আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠা অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক 'ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট রুল অব ল ইনডেক্স' -এর এক জরিপে দেখা গেছে, বিচারহীনতার দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান এশিয়াতে তৃতীয় (১১৩ এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০২), পাকিস্তান দ্বিতীয়।

এখনো ভয় হয়; ভয় জন্ম দেয় চারপাশের উচ্চাভিলাষী বক্তব্য, আইনের রক্ষকদের আচার-ব্যবহার, বিচারিক প্রহসন, গোষ্ঠীবাজির অপসংস্কৃতি, মুখোশধারীদের চালচলনে!

আমরা কী আরেকটি পাকিস্তানের দিকে ধাবিত হচ্ছি নাকি স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে এখনো বদ্ধ পরিকর?

তাহলে বারবার এমন হবে কেন?

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ