প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ২২ মার্চ, ২০১৮
যুদ্ধাহত বাংলাদেশ যখন অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু; পাকিস্তানের দখলদার বাহিনী যখন পুড়িয়ে দিয়ে গেছে সোনার মাটি; চারিদিকে স্বজন হারানোর হাহাকার; সুযোগ সন্ধানীদের অতি দ্রুত মুক্তিযুদ্ধের সুফল কুড়ানোর তোড়জোড়; পরাজিত শক্তি আবার ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে গিয়ে জনপ্রিয় পেশা দালালিবৃত্তি খুঁজে নিচ্ছে; ঠিক তেমনি একটি টাল-মাটাল মুহূর্তে শেখ মুজিবুর রহমান একজন সীমিত সামর্থ্যের পিতা হয়েও স্বপ্ন দেখার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন।
রাষ্ট্রের অর্থনীতির মেরামত কাজ তো চলবেই। কিন্তু অর্থনীতিই যে সভ্যতার একমাত্র সূচক নয় তা তিনি জানতেন। তাই তিনি শিক্ষা-সংস্কৃতির আলো জ্বেলে রাখতে চেয়েছেন আর্থিক বিপন্নতার সময়েও।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার তার মিত্র শক্তি পাকিস্তান বাংলাদেশে যুদ্ধে হেরে যাওয়ায় বাক-প্রতিশোধ নিতে বাংলাদেশকে বটমলেস বাস্কেট বলে উপহাস করছেন; বঙ্গবন্ধু সেদিকে কান না দিয়ে, বাংলাদেশের মেধাবী ছাত্র খুঁজেছেন; তাদের দেশের বাইরে উচ্চতর শিক্ষা নিতে পাঠিয়েছেন; যাতে তারা ফিরে এসে সমসাময়িক বিদ্যা বাংলাদেশে কাজে লাগাতে পারে। বাংলাদেশের মেধাবী চিত্রকরদের প্যারিস-গ্রিসে চিত্রকলার বৈশ্বিক ধারা সম্পর্কে জানতে পড়তে পাঠিয়েছেন। তরুণ অভিনেতা ও নির্মাতাদের পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটে পড়তে পাঠিয়েছেন; যেন তারা দেশে ফিরে ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌল উপাদান এর ভাষা- সংস্কৃতি; যে দেশ হাজার বছর ধরে গানের দেশ, কবিতার দেশ, আঁকিয়ের দেশ; সেখানে শিল্প-সংস্কৃতির নবজাগরণের স্বপ্নটি অনিবার্যভাবেই বঙ্গবন্ধুর মাঝে ছিলো।
অপরিণামদর্শী লোকজনের কোলাহলে ভারতীয় উপমহাদেশের কালচারাল জিনে সতত প্রবহমান খুনেরা নতুন স্বাধীন দেশে আঙুল ফুলে কলাগাছ হবার ভাগ-বাটোয়ারায় অসন্তুষ্ট হয়ে বঙ্গবন্ধুকে খুন করে ফেলে। কিন্তু খুন করা যায়নি তার সাংস্কৃতিক নবজাগরণের স্বপ্নকে।
বঙ্গবন্ধু ছাত্র সংগঠনের ছেলেদের সঙ্গে দেখা হলে বলতেন, একটু পড়াশোনাটা করিস বাবা.... চোখের বাইরে গেলেই তো তোরা লটর-পটর করিস।
এই যে পড়াশোনা ফেলে লটর-পটর করে বেড়ানোর বদ-অভ্যাস; এ আসলে সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতার ফলাফল। এইজন্য বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক নবজাগরণের মাধ্যমে চিন্তার অনগ্রসরতা দূর করতে চেয়েছিলেন। তিনি সারাদেশে শিশু একাডেমি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিশুদের সংগীত-নৃত্য-অভিনয়- চিত্রকলা-বক্তৃতা-বিতর্ক এরকম সৃজনশীল বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। সুন্দর চিন্তা বিকশিত হলে অসুন্দর লটর-পটর করার স্বভাবটা সমাজ থেকে চলে যাবে এটা উপলব্ধি করেছিলেন তিনি।
৪৭ বছরে একটি দিনও বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিক বসে থাকেনি। অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে তারা যে শ্রমের ঘাম নিবেদন করেছেন; তা একাত্তরের সাহসী মুক্তিযোদ্ধার রক্তের মতোই পবিত্র। বাংলার কৃষক-শ্রমিক তাই ছিলো জনমানুষের আত্মবিশ্বাসের জায়গা। এই কৃষক-শ্রমিকের জীবন কিন্তু কেবল পাকস্থলি কেন্দ্রিক নয়; সংগীত এবং কৃষিকাজ বা গানের সুরে সুরে শ্রম দেয়ার মানুষ এরা।
বঙ্গবন্ধু সুরের মানুষদের ওপর আস্থা রাখতে পেরেছিলেন; কিন্তু 'চোরের খনি"-র অসুরেরা তার লক্ষ্য অর্জনে বাধা হয়েছে; বাংলাদেশকে সম্পদের অসম বণ্টনের মাধ্যমে নিষ্ঠুর একটি সমাজে রূপান্তরিত করেছে এরাই।
দক্ষিণ এশিয় সমাজের অংশ বাংলাদেশের চিরস্থায়ী সংকট এইসব অসুর-মানব নিয়ে। এদের মনে লুণ্ঠন আর দখলের চর্বি জমিয়ে জলহস্তির মতো ঘোরাঘুরি করার স্থূল লোভটাই মানবঘাতী।
এই ত্রুটিপূর্ণ জিন সংশোধনের জন্য শিক্ষা-সংস্কৃতি-সামাজিক শৃঙ্খলাকে অগ্রাধিকার দিতে না পারার অক্ষমতা বঙ্গবন্ধু পরবর্তী প্রতিটি সরকারকে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ করেছে আজ অবধি। এ আসলে সমাজের সামষ্টিক ভরাডুবির চিত্র। ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার ৭০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। একই সময়ে স্বাধীন হওয়া বা যুদ্ধাহত রাষ্ট্রগুলো আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। পার্থক্য কেবল শিক্ষা-সংস্কৃতিকে অগ্রাধিকার দেয়া না দেয়ার মাঝেই নিহিত।
ভারত-পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকেরা কেবল টাকা আর পরিসংখ্যান গুনেছে ; এরা যেন প্রাইস ট্যাগ কান্ট্রি; কোন চিত্রকলা দেখলেও এদের প্রথম প্রশ্ন, এর দাম কত!
সেই ৯৯ সালে ইন্ডিয়া শাইনিং -এর বিজ্ঞাপন বাজিয়ে বাজিয়েও ভারত আজ কট্টর হিন্দুত্ববাদ আর দুর্নীতির অন্ধকারে নিমজ্জিত।
পাকিস্তান আশির দশক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের ঠিকাদার হয়ে সামরিক সাহায্যের ডলার গুণে গুণে আজ কট্টর ইসলাম আর দুর্নীতির ছোবলে ক্ষত-বিক্ষত।
স্বাধীনতার ৪৭ বছরে পৌঁছে প্রশ্ন জাগে বাংলাদেশ কোন পথে হাঁটবে!
শিক্ষা-ব্যবস্থা শেষ হয়ে গেছে; সংস্কৃতির অবস্থা তথৈবচ; এখন জনগণকে উন্নয়নের পরিসংখ্যানের আলেয়ায় ভূতের নাচন দেখিয়ে ঠিক কতদূর যাওয়া যাবে!
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য