আজ মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

ব্ল্যাক-আউট!

মাসকাওয়াথ আহসান  

৪৭ বছর ধরে অন্যমনস্কতা তাকে হুট করে পদ্মার পাড়ে পুলিশ একাডেমির মাঠে নিয়ে যায়। স্পষ্ট দেখতে পায় আব্বা দাঁড়িয়ে আছে; পাশে সার বেধে দাঁড়িয়ে আছে শিবলি-পরাগ-পান্না; থানাপাড়ার অন্য স্বজনেরা। সেদিন কী রোদ ছিলো নাকী কুয়াশা; এই প্রশ্ন প্রায়ই তাড়িয়ে ফেরে। রোদ থাকলে এই স্মৃতির মুহূর্তগুলো এতো ঘোলাটে দেখায় কেন! কয়েক সেকেন্ডের জন্য ফিরে ফিরে আসে ঝাপসা কুয়াশার মধ্যে স্পষ্ট মুখগুলো; তারপর ব্রাশফায়ারের শব্দ শোনা যায় খুব স্পষ্ট; এরপর কুয়াশা ঢেকে যায় চারপাশ। একটা গুলি পিঠ ঠিকরে চলে গেছে; কিছুক্ষণ মৃতের মতো ভান করে পড়ে থাকা; নৈঃশব্দ্যের মধ্যে শুকনো পাতার খড়মড় এড়িয়ে হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে নদীর মধ্যে ডুবে যাওয়া; এরপর ডুবতে থাকা-ক্রমশ অন্ধকারে চলে যাওয়া; ব্ল্যাক-আউট।

৪৭ বছর ধরে এই স্মৃতির সঙ্গে যুদ্ধ চলছে। কাউন্সেলিং সেশানে ডাক্তার বলেন, এই স্মৃতিটা তেড়ে এলেই আপনি কল্পনা করবেন একটা বিশাল সমুদ্রের মাঝে আপনি ইয়টে ভেসে যাচ্ছেন। সারা চোখ জুড়ে ছোপ ছোপ সাদা মেঘের আকাশ। সূর্যের তীব্র আলো আপনার চোখে এসে পড়ছে। আপনাকে এই নতুন স্মৃতি দিয়ে পুরোনো স্মৃতিটাকে আটকে দিতে হবে; নইলে আপনি একই স্মৃতির গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেতে থাকবেন।

এই স্মৃতি থেকে পালাতে পালাতে ব্রাসেলসে একটা সূর্য হানা দেয়া বড় খোলা জানালার এপার্টমেন্টে কতগুলো বছর; নীল একটা সোফায় বসে জানালার দিকে মুখ করে কত বসে থাকা; অথচ ঠিকই সেই স্মৃতি এসে হানা দেয়; কীকরে যেন রোদেল দিনটাকে প্রথমে কুয়াশা তারপর অন্ধকারে ঢেকে দেয়; সেই ব্ল্যাক-আউট; ৪৭ বছর পিছু ছাড়েনি।

একটা কফিশপে পরিচয় হয়েছিলো একজনের সঙ্গে। ওয়ারশ থেকে সে এই ব্রাসেলসে এসে থিতু হয়েছিলো। লোকটা কফিশপের একটা চেয়ারে বসে ঝিমাচ্ছিলো। ঝিমুনির মাঝে গোঁ গোঁ শব্দ করলে এগিয়ে গিয়ে তাকে খানিকটা ঝাঁকুনি দিয়ে জাগালে সে বলেছিলো, ধন্যবাদ; বাঁচালে আমায়; আবার আমার ওয়ারশ'র ব্ল্যাক-আউটের স্মৃতিটা তেড়েফুঁড়ে এসেছিলো।

পরে কফি খেতে খেতে সে বলেছিলো, একটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকি; ঐ স্মৃতিটুকুই আমার বাবা-ভাইদের শেষবার দেখা মুখ। সেই মুখগুলো দেখতে বড় লোভ হয়। কিন্তু ডাক্তার বলেন, এই স্মৃতিকে নতুন স্মৃতি দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে হবে। নইলে আমার পিটিএসডি ঠিক হবে না।

জানো, জার্মান নাৎসিরা ওয়ারশ'তে আমাদের পুরো পরিবারকে সার বেধে দাঁড় করিয়ে গুলি করেছিলো। আমার হাতে গুলি লেগেছিলো। তবুও আমি মরার ভান করে পড়েছিলাম। পেট্রোল ঢেলে মৃতদের পুড়িয়ে দেবার আগেই আমি গড়িয়ে নালায় পড়ে গিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে আরেকটা ছোট গলির মধ্যে ঢুকে পড়েছিলাম। এরপর ব্ল্যাক-আউট হয়ে যায় আমার স্মৃতিটা।

--আমিও তো একই স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছি। পাকিস্তানের খুনে সেনারা রাজশাহীতে আমাদের পুরো পরিবারকে সার বেধে দাঁড় করিয়ে গুলি করেছিলো। আমার পিঠ ঠিকরে গুলি চলে যায়। তবুও আমি মরার ভান করে পড়েছিলাম। পেট্রোল ঢেলে মৃতদের পুড়িয়ে দেবার আগেই আমি হামাগুড়ি দিয়ে নদীতে পড়েছিলাম। এরপর ব্ল্যাক-আউট হয়ে যায় স্মৃতিটা। আমি নদী সাঁতরে একটু দূরে গিয়ে চরে উঠেছিলাম। অবশ্য আমার মনে নেই সেসব। যারা আমার চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফিরিয়েছিলো; তাদের মুখে শুনেছিলাম।

ওয়ারশ'র বৃদ্ধ ভদ্রলোকই তার পিটিএসডি আছে সন্দেহ করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। কয়েক বছর আগে ভদ্রলোক মারা যায়। কিন্তু সে আজো ডাক্তারের কাছে যায়। মারা যাওয়ার আগে ভদ্রলোক একদিন পার্কের বেঞ্চে বসে বলেছিলো, ওয়ারশ'র ব্ল্যাক-আউটের স্মৃতির সঙ্গে যুদ্ধে হেরে যাচ্ছি প্রতিদিন। ডাক্তারের কথা মতো একটা সাদা ক্যানভাসে একটা নীল বিন্দু কল্পনা করে তাতে মনোযোগ থিতু করার কৌশলটা কোনভাবেই কাজে আসছে না। ঘুরে ফিরে আসে বাবা-ভাইদের মুখগুলো। কতজন কতবার বলেছে, মুভ ফরোয়ার্ড; স্মৃতির গোলক ধাঁধা থেকে বেরিয়ে এসো। আমি পারলাম না মনে হচ্ছে।

ব্রাসেলসের রোদ-মুখর এপার্টমেন্টের নীল সোফায় বসে ইয়টে শুয়ে সাদা ছোপ ছোপ মেঘের আকাশের স্মৃতিটাকে সামনে এগিয়ে দিয়ে কতবার ব্ল্যাক-আউটের স্মৃতির কাছে আকুতি জানায়, ফিরে এসো না পুলিশ একাডেমির মাঠ, আব্বা-শিবলি-পরাগ-পান্নার মুখগুলো, ব্রাশফায়ারের শব্দ, হামাগুড়ি দেবার সময় শুকনো পাতার খড়মড়। তবু নতুন স্মৃতির প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেঙে সে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে। ব্ল্যাক-আউট।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ