প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
রাজেশ পাল | ২৫ মার্চ, ২০১৮
২৫ মার্চ, ১৯৭১
ডেটলাইন: ঢাকা, পূর্ব পাকিস্তান
নি:স্তব্ধ ঢাকা শহরের বুকে আচমকাই জ্বলে উঠলো অনেকগুলো হেডলাইট। রাতের বুক চিরে সকল নিস্তব্ধতাকে খান খান করে দিয়ে দানবীয় উল্লাসে পৈশাচিক ক্রূরতা নিয়ে অট্টহাস্যে ইতিহাসের নির্মমতম রক্তবন্যার প্রলয় নাচনে নেচে ওঠলো পাক মিলিটারি কনভয়গুলো।
ক্যাপ্টেন ইস্কান্দারের নেতৃত্বে একশানে নেমে পড়েছে "চিতা"রা। (স্ট্রাইকিং ফোর্স), লাশের স্তূপ জমে ওঠলো ঢাকা, বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা ইপিআর হেডকোয়ার্টার্সে। ৬৯-এর খলনায়ক পুলিশবাহিনী পরিণত হলো মহানায়কে। "জীবন দেবো তবু বাংলাদেশ ছাড়বোনা" বলে গর্জে ওঠলেন সেই নাম না জানা বৃদ্ধ হাবিলদারটি। যার চাকরি আর মোটে বাকি ছিলো এক মাস। ব্রিটিশ আমলের থ্রিনটথ্রি যেন হার মানালো লক্ষণের শক্তিসেলকেও। হয়েছিলো এক মহাপ্রলয়ের ধ্বংসের কাহিনীর সূত্রপাত। যে ধ্বংসযজ্ঞের স্তূপ থেকে জেগে উঠেছিলো বাঙালি আবার ফিনিক্স পাখির ডানায় ভর করে। বাঙালি সত্যি বাঙালি হয়ে ওঠেছিলো সেদিন।
আহমদ ছফার ভাষায় বলতে গেলে:
"মনে আমার আজো ভাসে একাত্তরের রক্তরোদন ,
নদীর মাজা কাপিয়ে এলো স্বাধীনতার অকাল বোধন।
ডালে ডালে পাতায় পাতায় সেই কি তোমার পাগলা নাচন ,
এক পলকে খসে গেলো , হাজার সনের জরার বাধন"
একাত্তরের ২৫ মার্চের সেই ভয়াল কালো রাতের ঠিক ৯ বছর পরের কথা'
২৫ মার্চ, ১৯৮০
ডেটলাইন: কাউখালী, বাংলাদেশ
সেদিন ছিল হাটবার। বৌদ্ধ মন্দির সংস্কার এবং উন্নয়ন কাজের জন্য রাঙামাটির কাউখালী বাজারে মিটিং আহবান করে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর কথা বিশ্বাস করে কাউখালী এবং কলমপতির সাধারণ পাহাড়িদের সাথে ধর্মীয় নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা জড়ো হতে থাকেন কাউখালী বাজারে। স্থানীয় সেনা ইউনিটের কমান্ডার হাটে ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা দেন পোয়াপাড়া বৌদ্ধ মন্দির মেরামত কর হবে। তাই পাহাড়িরা যাতে বৌদ্ধ মন্দির প্রাঙ্গণে অনতিবিলম্বে হাজির হয়। পাহাড়িরা মন্দির মেরামতের কাজ করার জন্য সেখানে উপস্থিত হলে সেনা কমান্ডার সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করার নির্দেশ দেয়। গুলিতে নিমিষেই প্রাণ হারান তিন শতাধিক পাহাড়ি আদিবাসী। নিহতের মধ্যে বাজার চৌধুরী কুমুদ বিকাশ তালুকদার, স্থানীয় ইশকুল কমিটির সেক্রেটারি কাশীদেব চাকমাও রয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর দ্বারা সংঘটিত প্রথম গণহত্যার সাক্ষী হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম। এ হত্যাকাণ্ডের পরও সেনাবাহিনী ক্ষান্ত হয়নি। কেউ যাতে বেঁচে পালিয়ে যেতে না পারে, সেজন্য পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী দা, কুড়াল এবং দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সেটেলারদের লেলিয়ে দেয় সেনাবাহিনী।
সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পাহাড়ি অধ্যুষিত কাউখালী মুখ পাড়া, পোয়াপাড়া, কাউখালী বাজার, তোং পাড়া এবং হেডম্যান পাড়া আক্রমণ করে। সেনাবাহিনী গ্রামের চারিপাশে ঘিরে থাকে যাতে কেউ বেরুতে না পারে। আর সেটলাররা দা, কুড়াল ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে পাহাড়িদের কুপিয়ে হত্যা করে ও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। মুখপাড়া বৌদ্ধ মন্দির, তোং পাড়া আনন্দ মোহন বৌদ্ধ মন্দির, পোয়া পাড়া বৌদ্ধ মন্দির, কাউখালী বৌদ্ধ মন্দির এবং হেডম্যান পাড়া বৌদ্ধমন্দিরও এদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি।
ঘটনার প্রায় একমাস পর ২২ এপ্রিল (১৯৮০) বিরোধী দলীয় তিন সংসদ সদস্য শাহজাহান সিরাজ (জাসদ), উপেন্দ্র লাল চাকমা (জাসদ) ও রাশেদ খান মেনন (ওয়ার্কার্স পার্টি) ঘটনা সরেজমিন তদন্ত করতে কলমপতি যান। ঢাকায় ফিরে ২৫ এপ্রিল (১৯৮০) তারা এক সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করেন। এতে তারা জানান, “নৃশংস ঘটনাবলীর খবর সম্পূর্ণ সত্য। ২৫ মার্চ সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে তিনশ পাহাড়ি নিহত ও সহস্রাধিক নিখোঁজ হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডকে একাত্তরের পঁচিশে মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের সাথে তুলনা করে তারা বলেন- এই হত্যাকাণ্ড বাঙালি জাতির জন্য লজ্জার।”
জীবন বাঁচাতে সেদিন সহস্রাধিক পাহাড়িকে নিজ জন্মভূমি ছেড়ে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে শরণার্থী হতে হয়েছিলো। সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় আদিবাসীদের বসতবাড়ি এবং কৃষিজমি দখল করে নেয় সেটেলাররা। অসংখ্য আদিবাসী নারী-পুরুষকে সেনাক্যাম্পে নিয়ে অত্যাচার করা হয়, অনেকের মৃতদেহেরও সন্ধান পাওয়া যায়নি।
এই ঘটনা দেশেবিদেশে ব্যাপক নিন্দার ঝড় তোলে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো থেকে জানানো হয় তীব্র প্রতিবাদ। যদিও জেনারেল জিয়ার সামরিক সরকার তা অস্বীকার করে গেছেন। যেভাবে করেছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া একাত্তরে।
বটমলাইন: ইতিহাসের দুর্ভাগ্য হলো ইতিহাস বার বার একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি ঘটায় বটে কিন্তু ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয়না। ভাবতে অবাক লাগে, মাত্র ৯ বছর আগে "সূর্যকে তারা বন্দি করবে, এমন অহংকার" দেখানো সেনা সদস্যরা নিজেরাই আবার পুরনো ট্রেনিং প্র্যাকটিস করলেন নিজ মাতৃভূমির মাটি আর মানুষের!
হুমায়ুন আজাদ স্যারের ভাষাতেই বলি-
"পাকিস্তান নামটি শুনলেই যেখানে বমির উদ্রেক হয়।। সেখানে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অবসান ঘটিয়ে আমরা সেখানে জন্ম দিচ্ছি আরেকটি অপ-পাকিস্তানের"
নাসিরনগর থেকে রংপুর এর সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব, কাউখালী ম্যাসাকার থেকে রামুর ধ্বংসযজ্ঞ, পূজা, তনু, ইয়াসমিন, কল্পনা চাকমাদের ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ বা চাপাতি-বাহিনীর কসাইদের হাতে রাস্তার পাশে লাশ হয়ে পড়ে থাকা রক্তাক্ত অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাশ, ওয়াশিকুর বাবু, নীলাদ্রি নিলয়, নাজিমুদ্দিন সামাদদের অতৃপ্ত আত্মাগুলো হয়তো আজও হাহাকার ভরে ধিক্কার জানায় আমাদের প্রতি, আর সেই ধিক্কার থেকেই এবারের স্বাধীনতা দিবসে আপনমনেই ভাবনা জাগে, "আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম?
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য