প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ১৬ এপ্রিল, ২০১৮
তারুণ্যের আন্দোলনে প্রৌঢ় ও বৃদ্ধদের সমর্থন বা বিরোধিতা বা সমঝোতার চেষ্টা থাকতে পারে; কিন্তু সরাসরি অংশগ্রহণ অপ্রয়োজনীয়।
সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনে তরুণরা কারো দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে কেবল মাত্র তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়েছে। এখানে তাদের নিজস্ব কোন ভ্রান্তি চোখে পড়েনি। যতটুকু সমালোচনার জায়গা আছে; তা সম্পূর্ণভাবেই প্রৌঢ় ও বৃদ্ধ দর্শকদের।
শাহবাগে কোটা সংস্কার আন্দোলনে তরুণরা উপস্থিত হবার পর পুলিশ কর্মকর্তারা আলোচনা ও সমঝোতার চেষ্টা না করে বহু ব্যবহারে ব্যর্থ লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপের পথে যাওয়াটা ছিলো প্রথম ভ্রান্তি। শাহবাগে এরকম উত্তাল আন্দোলন যখন হচ্ছে তখন সেখানে স্বাভাবিকভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিত শিক্ষকদের উপস্থিত হয়ে সংঘাত প্রশমন ও সমঝোতার চেষ্টা করার কথা। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক হিসাবে তারা ব্যর্থ হয়েছেন তাদের দায়িত্ব পালনে।
ক্যাম্পাস যখন উত্তপ্ত; তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই উপাচার্যের বাসভবনের সামনে কড়া পুলিশ প্রহরা থাকার কথা। পুলিশ এই কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হওয়ায় অজ্ঞাত তরুণেরা এসে উপাচার্য ভবনে নারকীয় তাণ্ডব ঘটায়। পুলিশ এই দায় এড়াতে পারে না যে কোন ব্লেম-গেমের ফুলের বিছানায় নিরাপদ তন্দ্রায়। এই অজুহাতে চলে আসা পুলিশি পদ্ধতিতে গণ-মামলা দিয়ে আন্দোলনের ছাত্রছাত্রীদের উইচহান্টিং হবে আত্মঘাতী। কারণ পুলিশি বে-আইনি নির্যাতনে আহত কয়েকজন ছাত্র এখনো অসুস্থ। ভিসির বাড়িতে হামলার তদন্ত হতে হবে সভ্যতার নিয়মে; পেশাদারিত্বের সঙ্গে। পুলিশকে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজেদের ভুলগুলো সংশোধন করে প্রাসঙ্গিক ও জনমানুষের বন্ধু হতে হবে।
এই আন্দোলনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে দুটি গুজব প্রচারিত হয়েছে; তা এই আন্দোলনের তরুণদের দ্বারা ঘটেনি। "কলকাতার একটি মিছিলের মুখোশ পরা মানুষের ছবি" দিয়ে ন্যায্য দাবিতে ঢাকায় আন্দোলনরত তরুণদের কথিত জঙ্গি প্রমাণের "গুজব"-টি ছিলো অনভিপ্রেত। আর একটি তরুণের মোবাইল ফোন একটি হলের গেস্ট রুমে পড়ে থাকতে দেখায় ও কয়েক ঘণ্টা তার খোঁজ না পেয়ে "সে নিহত হয়েছে" এমন গুজব প্রচারের মাধ্যমে আন্দোলনে লাশ পড়েছে এমন প্রবণতাটিও ছিলো অপ্রয়োজনীয়। এই কাজ দু'টিতেও প্রাক-প্রৌঢ়দের অংশগ্রহণ ছিলো অনাকাঙ্ক্ষিত।
আর সুফিয়া কামাল হলে ছাত্রলীগ কর্তৃক আন্দোলনকারী ছাত্রীদের নির্যাতনের ও ভীতি প্রদর্শনের অডিও রেকর্ড শোনা গেছে। এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি হলের বাস্তবতা। এটি মানবাধিকার লঙ্ঘন। এর দায় আওয়ামী লীগ এড়িয়ে যেতে পারে না। বিএনপির ছাত্রদলকে পেটোয়া বাহিনী হিসেবে ব্যবহারের ক্লিশে আদিম চর্চাকে বাংলাদেশের জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে জন্যই আওয়ামী লীগকে ২০০৮ নির্বাচনে ব্রুট মেজরিটি দিয়েছে পছন্দের ভোটে। সেই ব্রুট মেজরিটি ব্রুটাল ছাত্রলীগ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি জনতার সন্তানদের জিম্মি করে রাখবে; আর দেশবাসী প্রতিক্রিয়া জানাবে না; তাই কী হয়!
সুফিয়া কামাল হলে আন্দোলনকারী ছাত্রীরা হলের ছাত্রলীগ সভাপতিকে অত্যাচারী হিসেবে বিচার বহির্ভূত জুতার মালা পরানো গর্হিত অপরাধ হয়েছে। ভিডিও ফুটেজে এই দৃশ্য সভ্য সমাজের চিত্র হতে পারে না। কারণ ছাত্রলীগের সভাপতির অসভ্য ও বে-আইনি আচরণের অভিযোগ ও বিচার হতে হবে আইনি পথে। এখানে বিচার বহির্ভূত জুতার মালার ব্যবহার অর্থাৎ আইনকে নিজের হাতে তুলে নেয়া অগ্রহণযোগ্য।
এই প্রবণতাটি জনসমাজেও রয়ে গেছে। রাষ্ট্রের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপক সমর্থন লক্ষ্য করা যায় সাধারণ মানুষের মাঝে। এই বিচার বহির্ভূত বিচার পাবার ভুল আকাঙ্ক্ষা থেকে বের হয়ে আসতে হবে রাষ্ট্র ও জনসমাজকে।
সরকার যখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের মাধ্যমে একটি সমঝোতা আলোচনা আয়োজন করেছে; সভ্যতার নিয়মে সংলাপের মাধ্যমে সংকট নিরসন নিশ্চিত; তখন অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরীর একটি ঢালাও মন্তব্যে পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। মতিয়া চৌধুরী সফল কৃষি মন্ত্রী; উনি জানেন স্বাধীনতার ৪৭ বছরে প্রতিদিন কৃষকের যে শ্রম-ঘাম; তা-ই বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে। বাংলাদেশকে অন্ন যুগিয়েছেন যে কৃষকেরা তাদের সন্তানদের, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের "স্বাধীনতা বিরোধী" তকমা দেয়ার রাজনৈতিক পরিভাষা "রাজাকারের বাচ্চা" উনার সফল রাজনৈতিক জীবনের দ্বিতীয় ভ্রান্তি। প্রথম ভ্রান্তিটি ঘটেছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি করা ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্যে। অথচ বঙ্গবন্ধু ছিলেন খুব শালীন রাজনৈতিক পরিভাষার জন্মদাতাও। উনি পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের উন্নয়নের ঢাকঢোল অথচ বাস্তবে জনমানুষের বিবর্ণ জীবন দেখে আক্ষেপে একে "বেহুদা" আচরণ বলেছিলেন। শব্দচয়নে বঙ্গবন্ধুর এই শালীনতা তাঁকে অনন্য উচ্চতা দিয়েছে।
একাত্তরের জনযুদ্ধের সময় যারা খুনে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর রাজাকার হয়ে হত্যা-ধর্ষণ-লুণ্ঠন-অগ্নিসংযোগের মতো গর্হিত ও সহিংস অপরাধ করেছিলো; তারা মানবতা বিরোধী অপরাধী হিসেবে সুচিহ্নিত। একাত্তরে যারা রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করেছে; অথচ অহিংস থেকেছে; জাতির জনক তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। স্বাধীনতার ৪৭ বছর হয়ে গেলো; এখন বাংলাদেশের নাগরিককে কোন দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির "রাজাকারের বাচ্চা" বলা বে-আইনি বক্তব্য বলেই মনে হয়। মতিয়া চৌধুরীর মতো অভিজ্ঞ রাজনীতিক এমন অসাংবিধানিক বক্তব্য না রাখলে অগ্নিকন্যা হিসেবে জনস্বার্থের পক্ষে উনার নিরাপোষ মনোভঙ্গির সুকৃতিতে মালিন্য আসতো না।
মতিয়া চৌধুরীর বক্তব্য যতই বিতর্কিত হোক না কেন; তা নিয়ে তাকে অশালীন ভাষায় মন্তব্য করা একেবারেই কাম্য নয়। নিজের মা কোন অপছন্দনীয় কথা বললে ঠিক যতটুকু সমালোচনা যে ভাষায় করা যায়; ঠিক ঐটুকুই মতিয়া চৌধুরীর ক্ষেত্রে করা যায়। আন্দোলনের ভাষা- সংস্কৃতিতে শালীনতা না আনতে পারলে সামষ্টিক সাংস্কৃতিক উত্তরণ ঘটবে না। অধরা রয়ে যাবে সভ্যতার স্বপ্ন।
প্রধানমন্ত্রী সংসদে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। পাশাপাশি অনগ্রসর সমাজকে রাষ্ট্রীয় সমর্থন জোগাতে ভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন। কাজেই এটি একটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত এতে কোন সন্দেহ নেই। নারী, মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, আদিবাসী, পিছিয়ে থাকা মানুষের পাশেও সরকার সক্রিয়ভাবে থাকবে এটা স্পষ্ট। এখন দেখার বিষয় সরকার সামাজিক সুবিচার ও স্বচ্ছতা প্রদানে কতটা আন্তরিক।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের অভিঘাতে প্রতিপক্ষতা ও তিক্ততা কারো কারো মাঝে দৃশ্যমান। এ প্রসঙ্গে মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, চোখের বদলে চোখ পৃথিবীকে অন্ধ করে দেয়।
আসলে তারুণ্যের কোটা সংস্কার আন্দোলনে কেউ হারেনি; কেউ জিতেনি; সামাজিক উত্তরণ ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির উদ্ভাস স্পষ্ট হয়েছে কেবল।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য