আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

নাগরিক আন্দোলনে দুই দশকের পথ-১

আব্দুল করিম কিম  

১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারির একতরফা জাতীয় সংসদ নির্বাচন সবে সম্পন্ন হয়েছে। পঞ্চম সংসদের প্রধান বিরোধী দল ও রাজপথের ছোটবড় সকল রাজনৈতিক দলের তীব্র প্রতিবাদ ও প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া একগুঁয়েমি করে প্রহসনের এ নির্বাচন সম্পন্ন করেছেন। যা দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। সে নির্বাচনে আবার বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি চক্রের রাজনৈতিক দল 'ফ্রিডম পার্টি'কে পরিকল্পিত ভাবে সংসদের প্রধান বিরোধী দল বানানো হয়। যা আন্দোলনরত প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সাথের বৈরিতাকে আরও উস্কে দেয়। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি কর্নেল (অব:) ফারুক রহমান'কে সেই বিরোধী দলের প্রধান নেতা নির্বাচিত করে কেবল বঙ্গবন্ধুর পরিবার নয় বিবেকবান দেশবাসীর সাথে খালেদা জিয়া নিষ্ঠুর রসিকতা করেন। তাই সেই নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে সরকারী দল ও রাজপথের অধিকাংশ বিরোধীদলের অবস্থান সংঘাতপূর্ণ হয়ে ওঠে। দেশ সম্ভাব্য এক ক্রান্তিকালের মুখোমুখি দাঁড়ায়।

সেই জটিল সময়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার তাড়নায় একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে একটি প্রতিবাদ কর্মসূচির আয়োজন করি। চলমান বাস্তবতায় বিক্ষুব্ধ একজন সাধারণ তরুণের সে তাড়নায় ইন্ধনও জুটে যায়। আর সে ইন্ধনেই সিলেটের রাজপথে প্রথমবারের মত আয়োজন করা হয় 'মানববন্ধন' নামের এক অভিনব কর্মসূচির। আর এ কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে সিলেটের নাগরিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি।

গত দুই দশকে স্থানীয় ও জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুতে মানববর্ম, নাগরিকবন্ধন, প্রতিবাদবন্ধন, আলোকবন্ধন ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন নামে অসংখ্য মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছি। ১৯৯৬ সালের ২৪ মার্চ স্থবির সময়টাকে বদলে দেয়ার তাড়নায় আয়োজিত সিলেটের ইতিহাসের সেই প্রথম মানববন্ধন কর্মসূচিতে দেশব্যাপী সৃষ্ট অচলাবস্থা কেটেছে সে দাবি করা হাস্যকর হলেও আমি বিশ্বাস করি সাধারণদের জাগরণেই দিন বদলায়। সেদিন আমরা দাঁড়িয়েছিলাম বলেই নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারের দাবী আদায় হয়েছিল। সেই আমরা বলতে- সাধারণেরা। সাধারণ এক তরুণের ডাকে আয়োজন করা কর্মসূচির সফল সমাপ্তি দেশের তৎকালীন বাস্তবতায় খুব তুচ্ছ ঘটনা হলেও আমার কাছে তা অনেক বড়। এ কর্মসূচি পালনের সপ্তাহ দিনের মধ্যেই অচলাবস্থা কেটে যাওয়ায় আমার বদ্ধমূল ধারণা জন্মে সাধারণ মানুষ জাগলেই রাজপথের আন্দোলন সফল হয়। যার প্রমাণ পরবর্তিতে নানা ভাবে পেয়েছি।

১৯৯৬ সালের সেই কর্মসূচির পর ২০০৪ সালের ১৪ আগস্ট প্রায় আট বছর পর আরেকটি ক্রান্তিকালে রাজপথে দাঁড়াই। এখনো সুশাসন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষা, নাগরিক অধিকার ইত্যাদি নানা বিষয় রাজপথে নামতে তাড়না দেয়। কিছু করা উচিত ভেতর থেকে এ ইন্ধন জাগে। সে ইন্ধনে কখনো নিজে উদ্যোগী হই, কখনো অন্যের উদ্যোগের সাথে সংহতি জানাই। নাগরিক আন্দোলনের একজন অংশগ্রহণকারী হিসাবে সিলেটের রাজপথে নিয়মিত উপস্থিত থাকি। বিবেকতাড়িত নাগরিক সমাজ, সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলন, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন, সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার, নৃশংসতা বিরোধী নাগরিক উদ্যোগ, সিলেটের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ও প্রকৃতি রক্ষা পরিষদ, খ্যাপা তারুণ্য, গণজাগরণ মঞ্চ, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সাংস্কৃতিক মোর্চা, টিপাইমুখ বাঁধ প্রতিরোধ আন্দোলন, রাতারগুল জলারবন রক্ষায় নাগরিক উদ্যোগ, সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি ইত্যাদি বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে মানববন্ধন'সহ অজস্র কর্মসূচি আয়োজনে সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেছি। আমার এসব কর্মকাণ্ডে পরিবার-পরিজন বিরক্ত হয়েছে। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোটা শুরুতে কেউ ভালো ভাবে নেয় নি। এখন সবাই অনিচ্ছাতে মেনে নিয়েছে। নাগরিক আন্দোলনের প্রায় দুই দশকের অভিজ্ঞতা বলে, অধিকার আদায়ে সাধারণ মানুষের হাতে হাত রেখে প্রতিবাদী হওয়ার লড়াই বৃথা যায় না।নাগরিকদের সংগঠিত প্রতিবাদে অবশ্যই দাবী আদায়ের পথ তৈরি হয়।

দেশের চলমান রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ থাকলেও কোন রাজনৈতিক দলের প্রতি সমর্থন ছিলো না। বরঞ্চ প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কার্যকলাপে নাগরিক অধিকারের প্রতি অবজ্ঞা লক্ষ করেছি। দেশের রাজনীতির প্রধান দুই কর্ণধারের উত্তরাধিকার বলে নেতৃত্ব দানও আমার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলো না। আশির দশকে এরশাদ সরকারের ইচ্ছেখুশি মন্ত্রীত্বদান ও কেড়ে নেয়া দেখে রাষ্ট্র পরিচালনা নিয়ে একক ব্যক্তির খামখেয়ালীপনায় বিস্ময়বোধ করেছি। দেখেছি মন্ত্রিত্ব রক্ষায় নানা দল থেকে ভাগিয়ে আনা রাজনীতিবিদদের নির্লজ্জ এরশাদ তোষণ। তাই নব্বইয়ের গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিন জোটের রূপরেখা পড়ে আশাবাদী হয়েছি। কিন্তু অচিরেই আশাহত হয়েছি গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন পরবর্তী সময়ে প্রধান দুই দলের দল পরিচালনা দেখে। বুঝেছি গণতন্ত্রের জন্য হুতাশন করা প্রধান দুই রাজনৈতিক দল পরিবারতন্ত্রের মোড়কে আবৃত স্বৈরতন্ত্র।

আমি তখন অনার্সের স্টুডেন্ট। মদন মোহন কলেজের ম্যানেজমেন্ট অনার্স কোর্সে নাম তালিকাভুক্ত আছে। কলেজের ক্লাসে যেতে বা বাসায় পড়াশোনা করতেও আগ্রহ নেই। বরাবরের মত পড়ালেখায় মন নেই। সে সময় বাসার নিত্যদিনের বাজারসদাই আমাকেই করতে হত। আম্মা বাজারের জন্য আব্বা বা ভাইয়ের থেকে নেয়া টাকা ও সওদাপাতির ফর্দ তুলে দিতেন। সেই টাকা ও ফর্দ নিয়ে বাজার ঘুরে দেখতাম জিনিসপত্রের দাম বাড়ছেই। ফর্দ অনুযায়ী অনেক কিছুই কেনা কঠিন হয়ে যেত। যা কেনার কথা ৩ কেজি তা কিনতাম ২ কেজি। এভাবে বাজার করতে গিয়ে পকেটে নিজের জন্য দুটো পয়সা বাঁচাতে পারতাম না।

চাচাতো ভাই ইব্রাহীম চৌধুরী খোকন-এর প্ররোচনায় তখন সাংবাদিকতার তালিম নিচ্ছি। খোকন ভাই সেই সময়ের বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিক ভোরের কাগজের সিলেট প্রতিনিধি। খোকন ভাইয়ের আগ্রহে টুকটাক লেখালেখি করি।
রাজনীতির সাথে কখনো যুক্ত না থাকলেও এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে জাতীয় রাজনীতির খবরাখবর রাখতাম। আমার কাছে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় বিবিসি ও ভয়েজ অব আমেরিকা শোনার উত্তেজনা অনেক উপভোগ্য ছিল। তখন থেকেই দেশের রাজনৈতিক ঘটনাবলির প্রতি আমার আগ্রহ জন্মে। আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা, কর্মসূচি পালন, পুলিশি বাধা, বাধা উপেক্ষা, নেতাদের মাঠের বক্তব্য, রাজনীতির ভেতরের মেরুকরণ ইত্যাদি নানা বিষয়ে আকর্ষণ বোধ করতাম। ছোটবেলা থেকেই বাসায় আসা দৈনিক পত্রিকা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ার অভ্যাস ছিল।

সে সময়ে ভোরের কাগজের সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় কলাম মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। ছোট চাচার বাসায় গিয়ে পড়তাম ইনকিলাব। আজকের কাগজ, বাংলাবাজার, ইত্তেফাকেও নিয়মিত চোখ রাখতাম। বিচিত্রা, যায় যায় দিন, বিচিন্তা ইত্যাদিও বাসায় আসতো, আগ্রহ নিয়েই পড়তাম। একজন সচেতন তরুণ হিসেবে সে সময়কার এসব ঘটনাবলী আজও স্পষ্ট স্মরণ আছে।

স্পষ্ট মনে আছে '৯১ এর নির্বাচনে নিজেদের ব্যর্থতা নিয়ে আওয়ামী লীগের তৎকালীন জাঁদরেল নেতা ও দেশের অন্যতম সংবিধান প্রণেতা ডঃ কামাল হোসেন-এর দলীয় প্রধানকে লেখা আলোচিত চিঠি ও সেই চিঠির প্রতিক্রিয়া।

একটি গণতান্ত্রিক দল নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ করবে, আত্মসমালোচনা করবে এমনটাই প্রত্যাশিত ছিল। এমনটাই আমাদের শেখানোর কথা। কিন্তু ডঃ কামাল হোসেন-এর চিঠির মাধ্যমে ব্যক্ত করা প্রতিক্রিয়াকে দলের পক্ষ থেকে ধৃষ্টতা হিসাবে ধরে নেয়া হয়। দলের দুঃসময়ের কাণ্ডারি ও দেশের অন্যতম এ সংবিধান প্রণেতাকে সেই চিঠির জেরে হেনস্তা করা হয়। তিনি দলত্যাগ করেন। পুরো বিষয়টা আমার কাছে অযৌক্তিক ও অগণতান্ত্রিক মনে হয়েছে।

নব্বইয়ের গণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারের পতনে দেশে গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের প্রধান দুই নেত্রীর ব্যক্তিত্বের সংঘাত ও সদলবলে চলা বৈরিতা গণতন্ত্র চর্চার সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রকে ধীরে ধীরে বিনষ্ট করতে থাকে। আর এই বৈরিতা শুরুর জন্য এরশাদ পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করা প্রথম সরকার প্রধান ও সংসদ নেত্রী খালেদা জিয়াকে নির্দ্বিধায় দায়ী করা যায়।

স্বৈরাচারের পতনের পর জনমনে প্রত্যাশা ছিল পঞ্চম সংসদে পুনর্বহাল সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চাকে মজবুত করবে।কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকারের সংসদে বিরোধী দলের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা ও সরকার পরিচালনায় বিরোধী দলকে রাষ্ট্র বিরোধী বানানোর চক্রান্ত স্বৈরাচারী কায়দায় চলতেই থাকে। বিএনপির সরকার গঠনের পর জামাতের সাথে আভ্যন্তরীণ বোঝাপড়া ও ফলস্বরূপ গোলাম আজমকে জামাতের আমির নিয়োগ তিক্ততা বাড়াতে থাকে। সংসদে আলোচনার নামে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ও স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে অহেতুক বিতর্কে বঙ্গবন্ধুকে খাটো করা চলতেই থাকে। যা দুই নেত্রীর মধ্যে অবিশ্বাস ও বৈরিতা বাড়াতেই থাকে। এর মধ্যে ১৯৯৪ সালে মিরপুর ও মাগুরা উপনির্বাচনে সরকারী দলের নগ্ন কারচুপি পরিস্থিতি আরও জটিল করে। সংসদের ও রাজপথের বিরোধী দলসমুহ নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন সম্পন্নের দাবীতে একাট্টা হতে থাকে। বিরোধী দল সমূহ নানান কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী জনসংযোগ করতে থাকে। অন্যদিকে সরকারী দল তা প্রতিরোধে পুলিশি অভিযান চালাতে থাকে।

১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত মাগুরা উপনির্বাচনে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ আনে। ফলাফল বাতিলের দাবি জানায়। কিন্তু ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার সে দাবী প্রত্যাখ্যান করে।

২০ মার্চ মাগুরায় ভোট শেষ হওয়ার পর তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী আওয়ামী লীগ প্রার্থীর শহরের বাড়িতে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন। নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তোলেন। পরদিন জাতীয় দৈনিক সমূহে মাগুরা উপনির্বাচনের কারচুপির তথ্য প্রকাশিত হয়। আর এভাবেই একটি উপনির্বাচনে করা নির্লজ্জ কারচুপিতে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবী গণদাবিতে পরিণত করার আন্দোলন শুরু হয়। অবশ্য মাগুরা উপনির্বাচনের আগ থেকেই তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী সংসদ বর্জন করে আসছিল। ফেব্রুয়ারি মাসে হেবরনে একটি মসজিদে ২৯ জন ফিলিস্তিনি নাগরিককে হত্যার ঘটনায় নিন্দা প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে বিরোধী দল সংসদ থেকে বেরিয়ে যায়। মাগুরা উপনির্বাচনের পর দাবি করা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে সংসদে আলোচনা করতে রাজি হলেই কেবল বিরোধী দল সংসদে যোগদান করবে। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে দাবি জানানো হয় ২৬ জুনের মধ্যে সরকার একটি সংশোধনী বিল উত্থাপন করলে তারা সংসদে যোগদান করবে। সরকারকে এ নিয়ে আলোচনায় বাধ্য করে তুলতে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে তিনটি অনুরূপ সংশোধনী বিলও জাতীয় সংসদে পেশ করা হয়। ২৭ জুন বিরোধী দল এক সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের উদ্যোগে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ভবিষ্যতের সব সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি কাঠামো বা রূপরেখা প্রকাশ করে। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের দাবীকৃত এই প্রস্তাব তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল বিএনপি নাকচ করে দিয়ে বলে, বিরোধী দল স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণ করে সেখানে মনোনীত ও অনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতায় বসাতে চাইছে। এ ধরনের অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক প্রস্তাব কখনোই জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া নিরপেক্ষ ব্যক্তি বলতে 'পাগল ও শিশু বোঝায়' এমন উক্তি করে এই দাবির অসাড়তা তুলে ধরেন। সরকারী দল একগুঁয়ে থেকে নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করায়। এদিকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সংসদ ও রাজপথের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল সে নির্বাচন প্রতিরোধে সহিংস কর্মসূচি পালন করতে থাকে।

খালেদা জিয়া সরকার প্রধান হিসাবে যেখানেই নির্বাচনী জনসভা করতে চেয়েছেন সেখানেই হরতালের কর্মসূচি দেয় আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে বাম দল সমূহ ও যুগপৎ আন্দোলনে থাকা জাতীয় পার্টি ও জামায়াত-ই-ইসলামী। জাতীয় ও আঞ্চলিকভাবে ডাকা নির্বাচন প্রতিরোধের এসব কর্মসূচিতে ব্যাপক ভাঙচুর, বোমাবাজি, ককটেল নিক্ষেপ, অগ্নিসংযোগ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে এবং সহিংসতায় নিহত হয় প্রায় অর্ধশত লোক, আহত হয় সহস্রাধিক।

’৯৪, ’৯৫ ও ’৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী অভিন্ন কর্মসূচিতে মোট ৯৬ দিন হরতাল, অবরোধ এবং অসহযোগ কর্মসূচি পালন করে। এর মধ্যে ৭০ দিন হরতাল অবরোধ এবং ২৬ দিন অসহযোগ। এসব কর্মসূচিতে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের পাশাপাশি একটি লাগাতার ৯৬ ঘণ্টা, ২টি ৭২ ঘণ্টা এবং ৫টি ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডাকা হয়। আর ২৬ দিনের অসহযোগ কর্মসূচির মধ্যে লাগাতার পালিত হয় ২২ দিন।

বিরোধী দলের আন্দোলনে চট্টগ্রাম বন্দর অচল হয়ে যায় এবং সারা দেশে সহিংসতার কারণে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। বিদেশী বিনিয়োগ চরমভাবে হ্রাস পায়। দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে।

নব্বইয়ের গণআন্দোলনের পর স্বৈরাচারী এরশাদের পতন ও সকল রাজনৈতিক দলের ঐক্যমত্যে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ-এর নেতৃত্বে কেয়ারটেকার সরকার গঠন হয়। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ-এর সাদাসিধে কথা ও জীবনাচরণ আমাকে মুগ্ধ করে। সাহেব-বিবি-গোলামের বাক্সখ্যাত বিটিভির পরিবর্তনটা চোখে পড়ে। সেই থেকে কেয়ারটেকার সরকারের কনসেপ্টের প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন সমর্থন অনুভব করি। যদিও ইতোমধ্যে জেনে গেছি, প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কেয়ারটেকার সরকার ব্যতীতই সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ও বিনা কারচুপিতে সে নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন হয়। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা নেই বলে এখানে কেয়ারটেকার সরকার ব্যতীত সাধারণ নির্বাচন অবাধ ও স্বাধীন হবে না বলেই আমার ধারণা জন্মায়।

মাগুরার উপনির্বাচন দেখে সেই ধারণার যৌক্তিকতা আরও দৃঢ় হয়। আমি বিনা তর্কে বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন কোন ভাবেই অবাধ হবে না। দেশের রাজনীতির মাঠ গরম করা প্রধান দলসমুহ যেহেতু ১০০% গণতান্ত্রিক নয়, সেহেতু এদের যে কেউ লংকায় গেলে রাবণ রূপেই আবির্ভূত হবে। তাই ১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর দেশব্যাপী চলা টানা অসহযোগ আন্দোলনকালে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে নাগরিক হিসাবে আমি কি করতে পারি সেই প্রশ্ন মনে জাগে।

অগ্রজ ইব্রাহীম চৌধুরী খোকনের মুখোমুখি হলাম। চৌহাট্টায় খোকন ভাইদের পার্টি অফিস। মির্জা সুলতান রাজা ও মাহমুদুর রহমান মান্না'র জনতা মুক্তি পার্টি'র সিলেট অফিস। খোকন ভাই ও শামিম সিদ্দিকী ভাই-এর যৌথ প্রযোজনায় অফিস খোলা হয়। আমি ও জয়দ্বীপ দাস সুজক মাঝেমধ্যে আড্ডা দিতে যেতাম। একদিনের আড্ডায় খোকন ভাইকে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে আমার উৎকণ্ঠার কথা জানালাম। জানতে চাইলাম, এ অচলাবস্থা থেকে কিভাবে দেশ বেড়িয়ে আসবে ?

খোকন ভাই স্বভাব সুলভ ভাবে বললেন, পরিস্থিতি বদলাতে হলে সাধারণ মানুষকে জেগে উঠতে হবে। আর এই জেগে উঠার দুইটা ধাপ। প্রথম ধাপে সাধারণ মানুষকে স্পষ্ট করতে হবে সে কি চায় চাচ্ছে। আর দ্বিতীয় ধাপে সে যা চায়, তা আদায় করতে রাজপথে দাঁড়ানোর প্রয়োজন। এখন তুমি কি চাও ?

আমি বললাম, আমি চাই নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন।

জানতে চাইলেন, কেন চাই ?

কেন চাই, আমার মত করে বললাম।

খোকন ভাই, বললেন তুমি কোন রাজনৈতিক কর্মী নও। তুমি যখন চাইছো, তাহলে এ দাবী আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু তোমার চাওয়াটা আওয়াজ দিয়ে জানান দিতে হবে।

জিজ্ঞেস করলাম, কিভাবে আওয়াজ দিবো।

খোকন ভাই বললেন, তুমি তোমার মত করে রাজপথে দাঁড়িয়ে যাও। নিজের মত করে তোমার পরিচিতদের আহ্বান জানাও। একটা নাম লাগবে। ব্যক্তির আহ্বানে সবাই যাবে না। এই দাবীর পক্ষে অন্য অনেকেই আছে। তুমি একটা সাইন বোর্ড খাঁড়া কর। সেই নতুন সাইন বোর্ডে অনেকেই সমবেত হবে।

আলোচনা করে নাম ঠিক হ'ল- 'বিক্ষুব্ধ তারুণ্য'।

এখন 'বিক্ষুব্ধ তারুণ্য' থেকে কি ধরনের প্রোগ্রাম করবো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না।

খোকন ভাই বললেন, 'মানববন্ধন' কর। হাতে হাত ধরে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকবা। মানুষ ২০ জন আনতে পারলেই হবে। এই জিনিস সিলেটে এখনো হয়নি। এইটা করতে পারলে একটা জাগরণ হবে।

আমি সুজকের সাথে কথা বললাম। সিদ্ধান্ত হলো ২৪ মার্চ কোর্ট পয়েন্টে সকাল বারোটায় 'মানব বন্ধন' নামের নতুন এক কর্মসূচি নিয়ে বিক্ষুব্ধ তারুণ্যের ব্যানারে আমরা দাঁড়াবো।

খোকন ভাই বললেন, খালি দাঁড়ালে হবে না। কি চাও সেটা ব্যানারে লেখা লাগবে। কি চাই, তাতো আগেই বলেছি।

শামীম ভাই বললেন, তুমি রাজনৈতিক কর্মী নও, কারো পরামর্শে রাজপথে দাঁড়াচ্ছ না। শুধু 'নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাই' বললে মনে হবে তুমি বিরোধী দলের মদদপুষ্ট বুদ্ধিজীবী। তোমাকে দুই পক্ষ থেকে একটা ব্যবধান রাখতে হবে। কথাটা মনঃপুত হল।

খোকন ভাই এবার বললেন, প্রোগ্রাম সফল করতে হলে কিছু প্রচারণা দরকার। মানুষকে জানাতে হবে।

কিন্তু কিভাবে প্রচারণা করবো ?

খোকন ভাই বললেন, প্রথমে একটা প্রেস রিলিজ লেখো। প্রেস রিলিজের ভাষাতেই বিক্ষুব্ধ তারুণ্যের ক্ষুব্ধ আওয়াজ যেন পাওয়া যায়। এরপর কালকের দিন রিকশায় মাইক নিয়ে বেড় হয়ে যাবা। বিভিন্ন পয়েন্টে দাঁড়িয়ে মাইকিং করবা। এতে পরশু দিন বক্তৃতা দেয়ার একটা ভালো প্র্যাকটিস হয়ে যাবে।

প্রেস রিলিজ লিখতে বসলাম। লিখলাম, "সিলেটের বিক্ষুব্ধ তারুণ্যের আহ্বানে মানব বন্ধন কর্মসূচি পালিত হবে। আগামীকাল রোববার সকাল ১১টায় সিলেটের কোর্ট পয়েন্ট এ কর্মসূচি শুরু হবে। দেশের চলমান বাস্তবতায় বিক্ষুব্ধ সকল সচেতন মহলকে এ কর্মসূচীতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উপস্থিত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।

গতকাল শুক্রবার সিলেটের কতিপয় উদ্যোগী তরুণের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, দেশে এখন এক অসহনীয় বাস্তবতা বিরাজ করছে। জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসা ক্ষমতাসীনদের কাছে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামত উপেক্ষিত। নিত্য নতুন টালবাহানা ও সংকট সৃষ্টি করে দেশকে বিপর্যয়ে নিপতিত করা হয়েছে।

ঐতিহাসিক বাস্তবতায়ই আজ প্রয়োজন ক্ষোভ ও দ্রোহের দাবানল। সিলেটের সকল বিবেকতাড়িত অগ্রসর নাগরিকদের সম্মিলিত উচ্চারণে সফল হোক মানব বন্ধন কর্মসূচি। নিজের বিবেকের কথা জানাতে সকল মহলকে এ কর্মসূচীতে যোগ দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।"

সুজকের হাতের লেখা সুন্দর। সুজক'কে দিয়ে প্রেস রিলিজের ফরমেটে লিখিয়ে সেটা ফটোকপি করালাম। খোকন ভাই বললেন, সব দৈনিক পত্রিকায় প্রেস রিলিজ হাতে হাতে নিয়ে পৌঁছে দিতে।

ব্যানার বানানো ও মাইকিং ও কর্মসূচি পালনকালে মাইকের ব্যবস্থার জন্য প্রায় বারো'শ টাকা লাগবে।

খোকন ভাইকে বললাম, টাকা দেয়ার জন্য। খোকন ভাই বললেন, বুদ্ধি দিলাম টাকাও যদি আমি দেই তাহলে কিভাবে হবে ? টাকা দেয়ার লোক পাবা, কিন্তু বুদ্ধি দেয়ার লোক পাবা না। তোমাদের সমস্যা হ'ল, সব এক জায়গা থেকেই সেরে ফেলতে চাও।

আমি আর কথা বাড়ালাম না। খোকন ভাইয়ের থেকে টাকা পয়সা পাওয়া যাবে না, সে আমি জানতাম। তবুও বলা।

আমরা প্রেস রিলিজ নিয়ে বেড় হয়ে গেলাম। মধুবনে 'সিলেটের ডাক' প্রথম টার্গেট। জিন্দাবাজার এসে লতিফ সেন্টারের সামনে মিশফাক আহমদ মিশু ভাইকে দেখে মটর সাইকেল থামালাম। মিশু ভাই ওভারসিজ সেন্টারে 'চিয়াং মাই' চায়নিজে যাচ্ছেন। উনি 'চিয়াং মাই' চায়নিজের একজন পরিচালক। আমরা উনার সাথে চিয়াং মাই চায়নিজে গিয়ে বিস্তারিত জানালাম। উনি উদ্যোগটাকে স্বাগত জানালেন। এবার অর্থনৈতিক সহযোগিতা চাইলে, উনি ৫০০/= টাকা দিলেন। আমরা সেই টাকা নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম স্থানীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতে প্রেস রিলিজ পৌঁছে দিতে।

"বিক্ষুব্ধ তারুণ্যের উদ্যোগে কাল 'মানববন্ধন'"-এই শিরোনামে পরদিন স্থানীয় সকল দৈনিকে এ প্রেস রিলিজ প্রকাশিত হয়। সকালে বাসায় আসা দৈনিক সিলেটের ডাকে প্রেস রিলিজ ছাপা হতে দেখে উৎসাহ বেড়ে যায়। দুপুর ১১টা থেকেই দরগা গেইটের আওয়াজ মাইক থেকে মাইক ভাড়া করে ঘণ্টা চুক্তিতে রিকশায় লাগাই। আমি ও সুজক মাইকিং করতে করতে শহর ঘুরতে থাকি। লাল্টু চেহারার সুজক আর আমি শহর ঘুরে অদ্ভুত এক মাইকিং করি। একেক পয়েন্টে দাঁড়িয়ে পথসভার মত একক বক্তৃতা। মানুষ উৎসাহ দেয়। আমরা সরকারের একগুঁয়েমির বিরুদ্ধেও বলি, বিরোধী দলের টানা কর্মসূচির বিরুদ্ধেও বলি।

বিকালে খোকন ভাইয়ের সাথে দেখা করে মাইকিং করার বিবরণ দিলাম। জানালেন, খুব আলোড়ন তৈরি হয়েছে। বললেন, 'কিম, বহুত মানুষ আইবো মানব বন্ধন জিনিসটা কিতা ওখান বুঝার লাগি। মানুষ নিয়া চিন্তা করিও না।'

খোকন ভাই, আমাকে পরামর্শ দিলেন লুলু আপা ও প্রফেসর হাবিবুর রহমান স্যারকে দেখা করে দাওয়াত দিতে। হাবিবুর রহমান স্যারের বাসা চিনি না, জানালে খোকন ভাই উনাকে জানানোর দায়িত্ব নেন।

খোকন ভাই, হাবিবুর রহমান স্যারকে কর্মসূচির উদ্বোধন করার জন্য বলবেন জানালে আমি আপত্তি জানাই।

বলি, উনারা রোজই উদ্বোধন করেন। প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন। এখানেও আমরা ব্যতিক্রম করতে পারি। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে সদ্যযোগ দেয়া নাসিম সাঈদী'কে দিয়ে কর্মসূচির উদ্বোধন করাতে চাই। খোকন ভাই একমত হলেন।

নাসিম সাঈদী বয়সে আমার কিছু বড় হলেও একটা বন্ধুত্বপূর্ণ হৃদ্যতা ছিল। তাঁকে ফোন দিয়ে কর্মসূচি উদ্বোধন করার জন্য বললাম। নাসিম ভাই সম্মতি জানালো।

এবার সুজক'কে নিয়ে সুপ্রিয় চক্রবর্তীর বাসায় এলাম। লুলু আপা মানে এডভোকেট সুলতানা কামাল তখন সিলেটে থাকতেন। উনার বাসাতে তখন রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের কার্যালয় ছিল। সেখানে তখন রিহার্সাল চলছে।

আমরা সুপ্রিয় চক্রবর্তী রঞ্জু'দার চেম্বারে বসে উনার সাথে গল্প করতে থাকলাম। রঞ্জু'দাকে সুজক 'রঞ্জু খাক্কু' ডাকে। একটু পর লুলু আপা আমাদের ভেতর বাড়িতে ডাক পাঠালেন। এই আয়োজনের খবর তিনি পেয়েছেন।

বললেন, খোকন বলেছে। আমি থাকবো। তোমরা শম্পা রেজা ও হ্যারল্ড রশীদ'কেও আমন্ত্রণ জানাও।

কর্মসূচির পূর্বে প্রতিবাদী গান বা জাগরণের গান আছে কি না জানতে চাইলেন।

আমরা এমন কোন ব্যবস্থা রাখিনি জানালে উনি 'রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ-কে দিয়ে গান গাওয়ানোর কথা বলেন। পাশের রুমে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানের জন্য সম্মিলন পরিষদের তখন রিহার্সাল চলছে। উনি বিপ্লব কুমার রায়'কে বলে দিলেন আমাদের প্রোগ্রামে একটি টিম নিয়ে থাকতে।

আমরা লুলু আপার বাসা থেকে বেড় হয়ে প্রান্তিকে এলাম। রোটার‍্যাক্ট আন্দোলনের বন্ধু জাহাঙ্গীর আহমদ রুবেল সাথে কথা বললাম। সে নান্দিক নাট্যদল,সিলেট-এর সাথে যুক্ত। রুবেল শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকায় সে এই ইস্যুতে প্রোগ্রাম করা নিয়ে দো'টানায় পড়ে। তখন @রাজিব দাস মান্না'র সাথে কথা বলি। ঠিক হয়, নান্দিক নাট্যদল একটি পথনাটক করবে।

রাতে বাসায় এসে ছোটভাই নাসিম'কে এই আয়োজন সম্পর্কে জানাই। নাসিমকে সাথে নিয়ে প্রায় ১০০টি প্রতিবাদী ব্যাজ বানাই। মানববন্ধন কর্মসূচীতে অংশগ্রহণকারীদের বুকে লাগানোর জন্য দুই ভাই মিলে এই প্রতিবাদী ব্যাজ বানাই। ব্যাজের জন্য কাগজ ও ফিতা বাসায় আসার পথে কিনে নিয়েছিলাম। যদিও এই ব্যাজ সবাইকে দেয়া সম্ভব হয়নি।

সকাল প্রায় সাড়ে দশটায় ব্যানার ও ব্যাজ নিয়ে কোর্ট পয়েন্টে পৌঁছে যাই। মাইক এনে লাগানো হয়। এখন যেখানে কোর্ট মসজিদ ঠিক এ জায়গাতেই আমাদের অবস্থান। ১১টা থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের গান ও নান্দিকের পথনাটক দিয়ে জমায়েতকে চাঙ্গা করা চলতে থাকে। আর সঞ্চালনায় থেকে বিক্ষুব্ধ তারুণ্যের ক্ষোভ আমি মনের মাধুরীতে ঢালতে থাকি। মানুষের জমায়েত বাড়তে থাকে। খবর আসে জেলাবার থেকে আইনজীবীদের একটি মিছিল এসে যোগ দেবে। আরও কিছু মিছিল আসে। সে মিছিলগুলো কাদের ছিল এখন আর মনে নাই। বেলা বারোটায় হাতে হাত ধরে মানববন্ধন যখন শুরু হয় মূল ব্যানারের প্রয়োজন হয় না। প্রফেসর হাবিবুর রহমান, ভাষা সৈনিক সা'দত খান, সাংস্কৃতিক সংগঠক সুলতানা কামাল, অভিনেত্রী শম্পা রেজা, অনুজ রায় বাদল সহ বিশিষ্টজনেরা রাস্তার ঠিক মাঝখানে হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে পরেন। দুই পাশে সে বন্ধন দীর্ঘ হতে থাকে। এক প্রান্ত যখন বন্দর ফাঁড়ির সামনে অন্যপ্রান্ত তখন শুকরিয়া মার্কেট অতিক্রম করে জিন্দাবাজার পয়েন্ট ছুঁই ছুঁই। এ কর্মসূচিতে অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকে "বিক্ষুব্ধ তারুণ্যের মানববন্ধন / ক্ষোভ ও দ্রোহের সম্মিলিত উচ্চারণে কেঁপে উঠেছিল রাজপথ" শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে। উপস্থিত বিশিষ্টজনের তালিকা দীর্ঘ থাকায় যারা বক্তব্য রেখেছিলেন তাঁদের নাম আসে। এই কর্মসূচী পালনের পর ২৬শে মার্চ থেকেই ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ-এর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় 'জনতার মঞ্চ'। 'জনতার মঞ্চ' ধীরে ধীরে দেশব্যাপী শাখা বিস্তার করতে থাকে। সিলেট পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান বদর উদ্দিন আহমেদ কামরান-এর নেতৃত্বে মধুবন মার্কেটের সম্মুখে হাসান মার্কেটের উত্তর-পূর্ব কোনে স্থাপিত হয় 'জনতার মঞ্চ'। সেই মঞ্চের প্রতিদিনের অংশ হয়ে যাই। জনতার মঞ্চে জনতার উপস্থিতি বাড়তে থাকে। ঢাকায় 'জনতার মঞ্চ'-এ সরকারী কর্মকর্তারা সচিবালয় থেকে বেড়িয়ে এসে সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেন। আমার আপন ভগ্নিপতি বাংলাদেশ পুলিশ-এর তৎকালীন এআইজি সৈয়দ বজলুল করিম জনতার মঞ্চে ওঠে জনতার আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। তিনি অধীনস্থ পুলিশ সদস্যদের ভাই সম্বোধন করে ন্যায় সঙ্গত আন্দোলনে থাকা জনতার উপর হামলা-মামলা না করতে অনুরোধ করেন। এভাবে সরকারী কর্মকর্তাদের অভাবনীয় বিদ্রোহ জনতার আন্দোলনে যুক্ত হওয়ায় দ্রুত সফলতা আসে। দেড় মাসের মাথায় ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত ষষ্ঠ সংসদকে তত্বাবধায়ক সরকারের দাবী মেনে নিতে হয়। খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় মেয়াদের প্রধানমন্ত্রীত্ব শেষ হয়। সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে গঠিত হয় নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকার। সেই সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় ৭ম জাতীয় সংসদ। একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে দীর্ঘ একুশ বছর পর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পুনরায় অর্পিত হয় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী আওয়ামীলীগের উপর। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্নের চেষ্টা করা হয়। প্রবাসে থাকায় সৌভাগ্যক্রমে সেদিন প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। পিতাকে হত্যার অর্ধযুগ পর ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা স্বদেশে ফিরে আসেন। বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এরপর দেড় দশকের গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের বিরামহীন পথপরিক্রমা শেষে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন।

আব্দুল করিম কিম, সমন্বয়ক, সিলেটের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ও প্রকৃতি রক্ষা পরিষদ।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ