প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
কাসমির রেজা | ২১ এপ্রিল, ২০১৮
কোটা আন্দোলনের ঘোর সমর্থক একজনকে জিজ্ঞাস করলাম-
-আপনি কি জেলা কোটার বিপক্ষে?
বললেন - না।
-নারী কোটা?
-তাও থাক।
-প্রতিবন্ধী কোটা চাননা?
- বললেন, তা থাকা উচিৎ।
মুক্তিযোদ্ধা কোটার কথা জিজ্ঞেস করতেই বললেন- -সেটা একটু....।
মানে মুক্তিযোদ্ধা কোটাটাই তাদের আসল টার্গেট। কিছু যুক্তিও দিলেন। সবচেয়ে বড় আপত্তি হল নাতি নিয়ে। তার ভাষায়- "ছেলে-মেয়ে পর্যন্ত মানা যায়, কিন্তু নাতি-নাতনি কেন সুবিধা পাবে? তারপর তাকে একটি গল্প শোনালাম। গল্পটা এরকম-
মনে করুন, আপনি একজন ব্যবসায়ী। একদিন বেড়াতে গেছেন কোন এক নদীর ধারে। ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। গ্রামের নির্জন রাস্তায় হঠাৎ একদল ডাকাত আপনাকে আক্রমণ করল। আপনার আচরণে ক্ষুব্ধ ডাকাত দল আপনাকে জানে মেরে ফেলতে চাইল। অদূরে আপনি দেখলেন তিনজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। এদের একজন আপনাকে মারতে সাহায্য করল, একজন নিরবে দাঁড়িয়েছিল আর তৃতীয় জন আপনাকে বাঁচাতে দৌড়ে আসল। আসার সাথে সাথে ডাকাতদের একজন তাকে প্রতিহত করতে গিয়ে রামদা দিয়ে সজোরে কোপ মারল। সেই কোপ পায়ে লাগল। লোকটি সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেল। সবার মনোযোগ ঐদিকে থাকাতে সুযোগ বুঝে অন্ধকারে আপনি দৌড়ে পালালেন। বেঁচে গেলেন।
এর প্রায় ৫০ বছর পর আপনি যখন বড় এক কোম্পানির মালিক, আপনার কোম্পানি চাকরির বিজ্ঞাপন দিল। লিখিত পরীক্ষা পাশ করে ভাইভা দিতে এল তিনজন। আপনি একজনকে বাছাই করবেন। প্রার্থীদের সাথে আলাপ করে আপনি চমকে উঠলেন। এই তিন চাকুরী প্রার্থী ঐ তিনজনের তিন নাতি, যারা ঐ ডাকাতদলের অদূরে দাঁড়িয়েছিল। আপনি কাকে চাকরি দিবেন? তখন কি ৫০ বছর আগের ঘটনা এখানে কোন প্রভাব বিস্তার করবে না? যদি না করে তাহলে কি আপনাকে অকৃতজ্ঞ বলা যাবে না?
আমাদের দেশটাও একবার ডাকাতের কবলে পড়েছিল। একদল রাজাকার দেশের বিরোধিতা করেছিল। একদল মানুষ তখন গা বাঁচিয়ে চলছিল। আরেকদল মানুষ দেশকে শত্রুর হাত থেকে বাঁচাতে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন
সেই মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই মারা গেছেন, অনেকেই ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছেন। যারা মারা গেছেন, পঙ্গু হয়েছেন কিংবা শারীরিক বা মানসিকভাবে অক্ষম হয়েছেন তাদের দায় কি রাষ্ট্র নেবে না! তারা ভালভাবে আয় রোজগার করতে পারলে তাদের নাতিপুতিরা কি এর সুবিধা পেত না? তাহলে তাদের অবদানের কারণে তাদের নাতিরা যদি মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পায় সমস্যা কোথায়? এদের সেই সুবিধা না দিয়ে আমরা কি অকৃতজ্ঞ হচ্ছি না? বিশ্বের যতদেশ সশস্ত্র যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে সবদেশে যোদ্ধারা ও তাদের পরিবার এরকম বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে। এটাই মানবিকতা।
তবে কি কোটা বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত দেশের সম্ভাবনাময় একদল মেধাবী তরুণকে আমরা অকৃতজ্ঞ বলব? না, এর দায় পুরো প্রজন্ম নিতে পারে না। এদের অনেকেই মিথ্যা তথ্য দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে বা আবেগের চকচকে জালে বন্দি হয়ে আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। তারা জানে না মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরাধিকারকে যারা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে দেখতে চায় না তারা ষড়যন্ত্র করে একটি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ তরুণ প্রজন্মকে "তুমি কে, আমি কে? রাজাকার-রাজাকার"-এর মত স্লোগান দিতে প্রলুব্ধ করে মনে মনে তৃপ্তি পেয়েছে। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যারা কোটা বিরোধী আন্দোলনে ছিল এদের অনেকেই শাহবাগে চিৎকার করে স্লোগান দিয়ে বলেছে- "ক-তে কাদের মোল্লা, তুই রাজাকার, তুই রাজাকার।" এই আন্দোলনে যোগ দেওয়া সাধারণ ছাত্ররাও দেশপ্রেমিক। তবে কেন আজ তাদের রাজাকারের পক্ষে স্লোগান দিতে শোনা যাচ্ছে? কারা মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারকে তাদের পথের কাঁটা হিসাবে দাঁড় করিয়েছে? কারা এর জন্য দায়ী?
যারা এই আন্দোলন করেছে তাদের কাছে তথ্য হল মাত্র তিন ভাগ মানুষ পাচ্ছে ৫৬ ভাগ কোটা। বাস্তবতা হল গত তিন বছরে গড়ে ২৮ ভাগ প্রার্থী চাকরি পেয়েছে বিভিন্ন কোটায়। ৫৬ ভাগ নয়। বাকি ৭২ ভাগই চাকরি পেয়েছে কোটা ছাড়া। এই ২৮ ভাগের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার হয়ত ৫ থেকে ১০ ভাগ। কোটার সুবিধা পাচ্ছেন, নারীরা, অনগ্রসর জেলার জনগণ, প্রতিবন্ধী, আদিবাসীসহ অনেকেই। এরা কি দেশের মাত্র ৩%? অবশ্যই না। শুধু নারীই তো দেশের অর্ধেক মানুষ!
পৃথিবীর সব দেশেই চাকরীতে কোটা আছে। আমাদের সংবিধানে প্রতিবন্ধী ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কথা উল্লেখ আছে। এদেশে নারীদের অগ্রযাত্রা ত্বরান্বিত করতে হলে নারীদের বিশেষ সুবিধা দিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে মেধাবী ছাত্রী কোটার জন্য স্লোগান দিচ্ছে সে কি জানে সে গ্রামের কোন এক মেয়ের ভাগ্যে দুর্গতি ডেকে আনছে? কিন্তু গ্রামের সেই মেয়েটি স্লোগান দিতে জানে না। মানুষের সামনে প্রতিবাদ করতে জানে না। জানলে হয়ত সেও স্লোগান দিয়ে বলত " নারী কোটা বহাল রাখ, রাখতে হবে।"
যুগে যুগে সুযোগসন্ধানী মানুষ আবেগ নিয়ে বাণিজ্য করেছে। জুয়া খেলেছে। এদেশেও এমনটি অনেকবার হয়েছে। তাই বলে একটি মেধাবী তরুণ প্রজন্মকে এভাবে বিভ্রান্ত করার নজির খুব কমই আছে।
এটা সত্য দেশে অনেক শিক্ষিত বেকার রয়েছেন। এদের কষ্টও বুঝতে হবে। তাই প্রয়োজন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি। প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ। এজন্য ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের কম সুদে ঋণ দিতে হবে।
দেশকে এগিয়ে নিতে হলে মেধাবীদের প্রয়োজন আছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি দরকার দেশপ্রেমিকদের। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক মেধাবী নির্দ্বিধায় পাকিস্তান সরকারের অধিনে চাকরি করেছে। সমগোত্রীয় অনেকেই যুদ্ধ করেছেন। তাই শুধু মেধাবী নয় আমরা চাই একটি দেশপ্রেমিক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ প্রজন্ম। তারাই সব ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে একদিন দেশকে এগিয়ে নিবে আরও সামনে। এদের অনেকেই হয়ত কোটার মিছিলেও ছিল।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য