আজ বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

বাকস্বাধীনতার পক্ষে না দাঁড়ালে একদিন আপনারও কণ্ঠ রুদ্ধ হবে

ইমতিয়াজ মাহমুদ  

কারো বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা হয়েছে এটা আমার কাছে এখন আর বিস্ময় বা চমক নিয়ে আসে না। কিন্তু উৎকণ্ঠা ঠিকই হয়। উৎকণ্ঠা হয় কারণ সরকারের সংস্থাগুলি যদি চায় তাইলে একটা ৫৭ ধারার মামলার সূত্র ধরে আপনাকে চূড়ান্ত হেনস্থা করতে পারে। আমি জানি যে যারা প্রচলিত বিশ্বাস ইত্যাদির বিরুদ্ধে হলেও নিজের মতামতটা স্পষ্ট করে প্রকাশ করতে চান এদের বেশিরভাগই এইসব ব্যক্তিগত ভোগান্তির ভয়ে ভীত থাকেন না। তবুও ওদের ভোগান্তির কথা চিন্তা করলে আপনার উৎকণ্ঠা তো হবেই। এছাড়া এমনিতেও, ৫৭ ধারা জিনিসটাই তো বাকস্বাধীনতার উপর ঝুলতে থাকা একটা ইয়ে, এটার বিপক্ষে দাঁড়ানো তো জরুরিই।

অরুন্ধতী রায়ের কথা মনে থাকার কথা আপনাদের। বোম্বের এক কার্টুনিস্টের কথা- অত বিখ্যাত না বলে আপনাদের মনে নাও থাকতে পারে। এইরকম অনুভূতি জাতীয় মামালায় ওকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। কার্টুনিস্ট মহা আনন্দে পুলিশের সাথে চলে গেছে হাজতে। নির্ধারিত সময়ে ওকে হাজির করেছে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে আসামী নিয়ে আসলে আসামী সাধারণত জামিন চায়। এই কার্টুনিস্ট জামিন চাইছে না। ম্যাজিস্ট্রেট ওকে জিজ্ঞাসা করেছে, কি ভাই, আপনার উকিল কই? জামিনের দরখাস্ত কই? কার্টুনিস্ট ম্যাজিস্ট্রেটের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চুপচাপ বসে থাকে।ম্যাজিস্ট্রেট ওকে পাঠিয়ে দিয়েছে জেলে।

সাংবাদিকরা গিয়ে কার্টুনিস্টের বাবাকে ধরেছে। কি ব্যাপার ভাই? আপনার ছেলের নামে মামলা হয়েছে, ছেলেকে জেলে পুরে দিয়েছে। আপনি একটু তদবির-ফতবির করেন, উকিল নিয়োগ করেন, জামিন হয়ে যাবে। কার্টুনিস্টের বাপ বলে কিনা, দুর, আমি কেন ঐসব করতে যাবো? ছেলে যা করেছে ঠিকই করেছে। রাষ্ট্রের কাজ হচ্ছে সকলের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। যে রাষ্ট্র এটা করতে পারে না সে রাষ্ট্রে জেলে থাকা আর বাইরে থাকা একই কথা। করুক, রাষ্ট্রের যা খুশী তাই করুক। এটাই আমার পুত্রের প্রতিবাদ।

তসলিমা নাসরিন একটা প্রবন্ধ লিখেছেন, সেটা উইম্যান চ্যাপ্টারে প্রকাশিত হয়েছে। কে যেন একজন দিয়েছে মামলা ঠুকে- ঐ লেখায় নাকি উনার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে। মামালার আসামী তসলিমা নাসরিন, সুপ্রীতি ধর, লীনা হাসিনা হক আর একজন। জেনেছি ম্যাজিস্ট্রেট মামলা এখনো আমলে নেননি, পুলিশের কাছে পাঠিয়েছেন তদন্ত করে দেখতে।

খবরটা আমার কাছে কৌতুকের মতো মনে হয়েছে। তসলিমা নাসরিন কি লিখেছেন সেই প্রবন্ধে আমি জানিনা, কিন্তু তসলিমার লেখাতে কোন হুজুরের অনুভূতিতে আঘাত লাগবে সেটাতে অবাক হওয়ার তো কিছু নাই। তসলিমা যে জিন্দা আছেন আর ইচ্ছামতো লিখে যাচ্ছেন তাতেই তো হুজুরদের অনুভূতি পারপিচুয়ালি ব্যাথাগ্রস্ত হয়ে থাকার কথা আরকি। একটা বিশেষ প্রবন্ধে তিনি এমন বিশেষ কীইবা লিখতে পারেন যেটাতে হুজুরদের পুরনো ব্যথা নয়া করে চাগিয়ে উঠেছে? আর এইসব মামলা মোকদ্দমা করে যে তসলিমার মুখ বন্ধ করা যাবে না সেকথা কি এরা এখনো টের পায়নি?

না, হাসি তামাশা ঠিক আছে। কিন্তু এটার মধ্যে একটা সিরিয়াস ব্যাপারও আছে।

সুপ্রীতিরা একটা ওয়েব পোর্টাল খুলে সেখানে নানারকম লেখা পোস্ট করে- নারীদের পক্ষে লেখা। নারীবাদী লেখাও বলতে পারেন, কিন্তু সব লেখা যে নারীবাদী ধরনের হয় সেটাও না। নানারকম লেখা সেখানে পোস্ট হয়, অনেক আনাড়ি ধরনের রুডিমেন্টারি কথাবার্তাও লেখেন অনেকে। এই অধমের কিছু লেখাও সেখানে পোস্ট করেছেন ওরা। আবার অনেক দারুণ দারুণ লেখাও সেখানে আসে, অনেক বড় লেখকরাও লিখেছেন কোন না কোন সময় সেখানে। কয়েকজনকে দেখেছি উইম্যান চ্যাপ্টারে লিখতে লিখতেই বেশ হাত পাকিয়েছেন।

নারীদের পক্ষে লেখা ছাপা হবে যে ওয়েব পোর্টালে সেটা যে রক্ষণশীলদের মধ্যে বিশেষ পছন্দের জায়গা হবে না সে তো আর বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। বেচারা সুপ্রীতি আর ওর লেখকরা এইজন্যে মাঝে মাঝেই নানারকম নিগ্রহের শিকার হন। সুপ্রীতি ধরের আবার পেট ভর্তি অভিমান, 'মা আমার সাধ না পুরিল আসা না মিটিল' ধরনের খালাম্মা একটা। ওর নিজের দলের লোকজনের সাথেও ওর লেগে গেছে ঝগড়া। উজ্জ্বল কিছু লেখক সাংবাদিক উইম্যান চ্যাপ্টার ছেঁড়ে চলে গেছেন। কেউ কেউ ঘোষণা দিয়েই ওর সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করেছেন। ছ্যারাবেরা ব্যাপার।

কিন্তু উইম্যান চ্যাপ্টার আর সুপ্রীতি ধরের একটা বিশাল গুরুত্ব আছে আমাদের দেশের জন্যে। উইম্যান চ্যাপ্টার আমাদের মেয়েদের গলা খুলে কথা বলার জন্যে প্রথম একটা বড় প্লাটফর্ম। আজ থেকে পঞ্চাশ বা একশ বছর পরে আমাদের দেশের মেয়েরা যখন ওদের নারী পরিচয় নিয়ে সকল গ্লানি কষ্ট নিগ্রহ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন মানুষ হিসাবে বিচরণ করবে, তখন দেখবেন লোকে চিহ্নিত করবে যে আমাদের এদেশে উইম্যান চ্যাপ্টার নামে একটা ওয়েব পোর্টাল হয়েছিল যেটা নারীমুক্তির জন্যে বেশ বড় একটা ভূমিকা রেখেছিল।

উইম্যান চ্যাপ্টার আর এর সাথে জড়িত সাবেক বর্তমান যারা আছেন ওদের পক্ষে একটু দাঁড়ানো দরকার। ওদের বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে এটা অন্যায় হয়েছে, আর এই মামলায় যদি সুপ্রীতি বা এর সাথে জড়িত অন্যরা হেনস্তা হন, সেটা আমাদের দেশের জন্যে খুব ভালো কিছু হবে না।

আপনি কেন উইম্যান চ্যাপ্টারের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের পক্ষে কথা বলবেন? আপনি ওদের সকলের বক্তব্য সমর্থন করেন বলে? জি না। তসলিমা তার প্রবন্ধে কি লিখেছেন বা উইম্যান চ্যাপ্টারে ওরা কি ছেপেছেন সেটা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ না। ওদের অধিকার আছে কথা বলার। যা ইচ্ছা তাই বলার। এমন কি তাতে যদি আমার নানারকম অনুভূতিতে আঘাত লাগে সেটাও ওদের বলার অধিকার আছে। সেই অধিকারটা রক্ষা করা জরুরি। খুবই জরুরি।

স্পষ্ট কণ্ঠে যদি তসলিমা নাসরিন, সুপ্রীতি ধর, লীনা হাসিনা হক আর অন্যান্যদের বিরুদ্ধে করা হয়রানীমূলক মামলার প্রতিবাদ না করেন তাইলে এর জন্যে আমাদের সকলকেই মূল্য দিতে হবে। আপনি যদি প্রতিবাদ করার আগে লেখাটার কন্টেন্ট বিচার করতে বসেন, সুপ্রীতি বা তসলিমা কেমন মানুষ এইসব বিবেচনা করতে বসেন, আপনি বাক স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়ালেন না। আর আপনি যদি বাক স্বাধীনতার পক্ষে কথা না বলেন, আপনার নিজের কণ্ঠ বা পনার প্রিয় একটি কণ্ঠ আগামীকাল না হলেও পরশুদিনই রুদ্ধ হবে। দেখবেন।

ইমতিয়াজ মাহমুদ, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ