প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
সুকান্ত পার্থিব | ৩০ এপ্রিল, ২০১৮
সামনাসামনি প্রথম পরিচয় ১৯৩৭ সালে। দার্জিলিং মেইলে চড়ে রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের নিয়ে তিনি আসেন বগুড়ার সান্তাহারে। সেখান থেকে রওনা হন বগুড়া জেলার দুপচাঁচিয়া থানাধীন তালোড়ার আলতাফ আলী হাই স্কুলে। বক্তব্য রাখেন বিশাল এক জনসভায়। তাঁকে একঝলক দেখতে সেসময় উন্মুখ হয়ে ছিল বগুড়াবাসী। সেই মানুষটি বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের মহানায়ক, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রবাদপুরুষ নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। অন্তরে ধারণের সম্পর্ক পুরনো হলেও সেদিনই মুখোমুখি পরিচয় ঘটে নেতাজীর সাথে টগবগে যুবক অনন্তমোহন কুণ্ডুর।
নেতাজী কলকাতা থেকে বগুড়ায় এসেছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে এক ঐতিহাসিক জনসভায় বক্তৃতা দিতে, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় দাঙ্গা-ফাসাদহীন হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের ডাক দিতে। জনসমাবেশের আয়োজকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন স্থানীয় স্বনামধন্য চিকিৎসক ডা. প্রাণবল্লভ সাহা, ক্ষিতীশ চন্দ্র কুণ্ডু, অনন্তমোহন কুণ্ডু, নসিব খান, মণীন্দ্রনাথ সাহা, চপলানাথ চৌধুরী, গোপাল বসাকসহ আরও অনেকে। সমাবেশ শেষে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু রাত্রিযাপন করেছিলেন দুপচাঁচিয়া থানা সদরে ডা. প্রাণবল্লভ সাহার বাড়িতে। দেশমাতৃকা রক্ষার চেতনায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তৃণমূল পর্যায়ে নির্বিশেষে হিন্দু-মুসলমান যুবকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ বাড়াতে তিনি সকলকে সংঘবদ্ধ হবার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তবে তাঁর আগমনে ক্ষোভে-রোষে স্থানীয় মুসলিম লীগের নেতারা কালো পতাকায় ছেয়ে ফেলেন থানা সদর এলাকা।
১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের'বেঙ্গল প্যাক্ট' –এর প্রস্তাবনায় প্রথম অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন অনন্তমোহন কুণ্ডু। বিভেদ-বৈষম্যহীন, সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, কাঁটাতারহীন অখণ্ড বাংলার স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অর্জনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হন চিত্তরঞ্জন দাশ ও সুভাষ চন্দ্র বসুর আদর্শ-দর্শন ও চেতনায়। মাত্র ২০ বছর বয়স থেকেই তিনি সক্রিয় ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াইয়ে।
অনন্তমোহন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সাহচর্যে ও বিপ্লবী অনুপ্রেরণায় নতুন উদ্যমে উজ্জীবিত হয়েছিলেন। এরপর থেকেই নিয়মিত তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে সান্তাহার থেকে দার্জিলিং মেইল ট্রেনে চড়ে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ হয়ে কলকাতা যাওয়া-আসা করতেন রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কাজে। নেতাজীর দিকনির্দেশনা অনুসরণ করে তা তিনি বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন সর্বাত্মকভাবে। ‘ইংরেজ ভারত ছাড়’ আন্দোলনে বিভিন্ন মিছিল-মিটিং -এ নেতৃত্বদান করেছেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতায়, অখণ্ড বাংলার লড়াইয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় হিন্দু-মুসলিম একাত্মতা গঠনে সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে উদ্বুদ্ধ করে গেছেন আপামর মানুষকে। ব্রিটিশ শাসকের রোষানল থেকে বাদ যাননি তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধারা। আটকও হয়েছেন বেশ কয়েকবার। শাসকের রক্তচক্ষুর নিষ্পেষণ থেকে জেল-জুলুমও বাঁধ সাধেনি!
১৯৪০ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাথে সুভাষ চন্দ্র বসুর মতপার্থক্য হলেও অনন্তমোহন, প্রাণবল্লভ, ক্ষিতীশরা পাশেই ছিলেন শেষ অবধি। অহিংসায় নয়, উদারতায় নয়, শক্তি প্রয়োগ করেই ব্রিটিশকে ভারত থেকে তাড়াতে হবে -এই মন্ত্রকে ধারণ করে ব্রিটিশ শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে আমৃত্যু লড়াই-সংগ্রাম চালিয়েছেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। ১৯৪২ সালে গঠিত হয় আজাদ হিন্দ ফৌজ। ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা গঠিত একটি সশস্ত্র সেনাবাহিনী ছিল এটি। ১৯৪৩ সালে নেতাজী সুভাষ বসুর নেতৃত্বে এই বাহিনীর ভিতরে ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকামী মানুষ, ইংরেজ দ্বারা নির্যাতিত জনসাধারণ, কৃষক, শ্রমিক ও মজুর ছিল। নেতাজী সুভাষের অসাধারণ নেতৃত্বের ফলে প্রায় ৬০ হাজার সৈন্যের একটি সুশৃঙ্খল দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী গড়ে উঠেছিল তখন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সশস্ত্রভাবে উজ্জীবিত করতে। প্রাণবল্লভ, ক্ষিতীশ, অনন্তমোহনরাও সেদিন পিছপা হননি নেতাজীর বিপ্লবী চেতনায় একাত্ম হতে। ১৯৪৪ সালের ৪ জুলাই তৎকালীন বার্মাতে এক শোভাযাত্রায় ভারতের যুব সম্প্রদায়কে নেতাজী বলেছিলেন—‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’ হিন্দিতে- (‘তুম মুঝে খুন দো, ম্যায় তুমহে আজাদি দুঙা’’)। ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট এক প্রশ্নবিদ্ধ অন্তর্ধান ঘটে উপমহাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের প্রবাদপ্রতিম বাঙালি এই মহান নেতার। তাঁর এই আকস্মিক অন্তর্ধানের কারণ প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে দিয়েছিল তাঁর অনুরাগী, অনুসারীদের মাঝে! সেসময় নেতাজীর অভাবে নেতৃত্বের শূন্যতা অনুভব করে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন অনন্তমোহন, প্রাণবল্লভ, ক্ষিতীশরা।
১৯০৫ সালের ২২ জানুয়ারি অনন্তমোহন কুণ্ডু বগুড়া জেলার দুপচাঁচিয়া থানাধীন চৌধুরীপাড়ায় (বর্তমানে কুণ্ডুপাড়া) জন্মগ্রহণ করেন। স্বনামধন্য ভাস্কর ও কারুশিল্পী নলিনী মোহন কুণ্ডু ছিলেন তাঁর বাবা। পেশায় কৃষিজীবী ছিলেন অনন্তমোহন। তিন পুত্র ও দুই কন্যাসন্তানের জনক ছিলেন তিনি। দুপচাঁচিয়া হাই স্কুলে (তৎকালীন মিডল ইংলিশ স্কুল) অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। তখন এর বেশী আর সুযোগ ছিল না ঐ স্কুলে। উনিশ শতকের শেষদিকে প্রথমে (সংস্কৃত স্কুল) পরবর্তীতে ১৯২১ সালে দুপচাঁচিয়া হাই স্কুল প্রতিষ্ঠায় তাঁর পরিবারের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর পিতামহ জয়চন্দ্র কুণ্ডু, বাবা নলিনী মোহন কুণ্ডু ও কাকা প্রভাষ চন্দ্র কুণ্ডু থানা সদর এলাকায় নিজেদের সিংহভাগ সম্পত্তি স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে দান করে গেছেন অত্র এলাকায় শিক্ষা ও জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রসারে। জনহিতৈষিমূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তিনি সচেষ্ট ভূমিকা রেখেছেন সবসময়। নিজের আদর্শিক চেতনায় গড়ে তুলেছিলেন সন্তানদের।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুভাষ চন্দ্র বসুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বগুণ ও আদর্শ-চেতনায় বিমুগ্ধ হয়ে ১৯৩৩ সালে 'তাসের দেশ' নাটক নেতাজীকে উৎসর্গ করেছিলেন। নওগাঁ পতিসরের কাছারিবাড়িতে অবস্থানকালীন সময় থেকেই রবি ঠাকুরের সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল অনন্তমোহন কুণ্ডুর। ১৯৩৯ সালে রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ থাকাকালীন অনন্তমোহন কলকাতার ঐতিহ্যবাহী জোড়াসাঁকো জমিদার বাড়িতে রাত্রিযাপন করেছিলেন তাঁর সান্নিধ্য পেতে ও খবরাখবর নিতে।
মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল শহীদ পরিজনদের লাশসহ অন্য প্রতিবেশীদের নিথর দেহ নিজের বাড়ির পেছনে তিনি, স্থানীয় শিক্ষক নিমাইসুন্দর চৌধুরী ও বীরেন্দ্রনাথ চৌধুরী গণকবর খুঁড়ে সমাধিস্থ করেন। অনন্তমোহন কুণ্ডু তাঁর দুই পুত্রসন্তানকে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন বাঙালি জাতির মুক্তি অর্জনের স্বপ্নে। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র অশোক কুমার কুণ্ডু পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মেজো ছেলে জয়ন্ত কুমার কুণ্ডু মহান মুক্তিযুদ্ধে সংগঠক হিসেবে সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন।
মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ে শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে, সমাজের মানুষের উন্নয়নে, মানবিক চেতনার বিকাশে সারাজীবন নিঃস্বার্থভাবে অনন্তমোহন নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন দেশ ও দশের জন্য। সংগ্রামী চেতনায় আর দেশপ্রেমের মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন এই মহৎ প্রাণের মানবতাবাদী মানুষ। জীবনের শেষ দিনগুলোতে পোশাকি চেতনা বিক্রয়কারী আর ক্ষমতার ধ্বজাধারীদের বড় বড় কথা শুনলে বেশ আশ্চর্যবোধ করতেন! আর ভাবতেন তাঁর প্রিয় নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর সংগ্রামের কথা, আদর্শিক লড়াইয়ের কথা। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান -এর স্বপ্নের সোনার বাংলা দেখার। শেষ বয়সেও খালিচোখে খবরের পাতা হাতে নিয়ে থমকে দাঁড়াতেন! বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে খুব আক্ষেপ ছিল তাঁর। একটি মূল্যায়ন বা উক্তি জীবনের শেষদিনগুলোতে প্রায়ই বলতেন, 'মানুষ কি আর মানুষ আছে, মানুষ আর মানুষ নাই!'
২০০৭ সালের ৩০ এপ্রিল সোমবার বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় বার্ধক্যজনিত কারণে ১০২ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। প্রয়াণ ঘটে ইতিহাসের এক মহান সাক্ষীর বর্ণাঢ্য জীবনের শারীরিক উপস্থিতির।
ইতিহাস খুব সহজেই ভুলে যায় তাঁর প্রিয় সন্তানের নাম! ব্যতিক্রম ঘটেনি অনন্তমোহন কুণ্ডুর বেলায়ও। কালে-কালে কত সংগ্রামী কত মুক্তিযোদ্ধা আমাদের বিস্মৃতিতে স্থান পান ও পাচ্ছেন। অনন্তমোহন কুণ্ডু তাঁদেরই একজন।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য