আজ বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

‘ক্রাশ’

আলমগীর শাহরিয়ার  

আজকাল উঠতি তরুণ-তরুণীদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় একটি শব্দ 'ক্রাশ'। বললেই বলে বিনোদন জগতের অমুক অভিনেত্রী, তমুক অভিনেতা, ক্রীড়াঙ্গনের এই খেলোয়াড়, ক্রিকেটার, ফুটবলার, ক্যাম্পাসে ওই ভাইয়া বা আপু, সুদর্শন বা কোন সুন্দরী আমার ক্রাশ।

আমরা যারা গ্রামের, ছোটবেলা কেটেছে গ্রামে, রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের ফটিক চরিত্রের মত উদ্দাম আনন্দেভরা আমাদের শৈশব, পড়াশুনাও গ্রামের স্কুলে তাদের মনে হয় ‘ক্রাশ’ কি ঠিক জানা নেই। আমাদের ছেলেবেলায় এই শব্দের সঙ্গে ঠিক পরিচয় ঘটেনি। সেসময় পছন্দের কোন সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে শুনতাম কিছু ইঁচড়ে পাকা বা বখে যাওয়া ছেলেরা 'লাইন' মারার চেষ্টা চালাচ্ছে। আজকের মত প্রযুক্তির বিকাশ না ঘটায় ‘ক্রাশ’ খাওয়া ঠিক কি জিনিস তারা চিনে উঠতে পারেনি তখনো।

তবে সিলেট অঞ্চলে বাড়ি বলে ছোটবেলা থেকেই সুরমা নদীর তীরজুড়ে পাথরভাঙার অনেক ক্রাশার মেশিন দেখতাম। শিল্পনগরী ছাতক, পাথর কোয়ারি খ্যাত ভোলাগঞ্জ, পর্যটন স্পট জাফলংয়েও ভুরি ভুরি ক্রাশার মেশিন দেখেছি। এই হলো আমাদের ক্রাশজ্ঞান। 'ক্রাশ' কী তবে এমন কিছু যা অক্ষত কোন শক্ত বস্তুকে ভেঙেচুরে দুমড়ে মুচড়ে গুড়ো করে দেয়। হয়তো দেয় তাদের হৃদয়কে। ঠিক জানি না। তবে আন্দাজ করি এমন কিছুই হবে।

সেদিন রাতে ইউটিউবে আব্বাসউদ্দিনের কণ্ঠে, "ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে...." গানটি শুনছি। এমন সময় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছোটবোন আসছে রুমে। এসে বলল, ভাই তুমি এমন সব পুরনো গান শোন যা শুনে আমার হাসি পায়। তোমার পছন্দের সঙ্গে আমার পছন্দ ঠিক মেলে না। ওর দিকে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবি এটাই মনে হয় জেনারেশন গ্যাপ। ভেবে রীতিমতো আমি আঁতকে উঠি। আমার বোনের সঙ্গেও তাহলে আমার একটা জেনারেশন গ্যাপ তৈরি হয়ে গেছে! ও জানে, তবু ফের ওকে বললাম দেখ বাউল, পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, মারফতি গান এদেশের মাটি ও মানুষের আত্মার সঙ্গে মিশে আছে। এ গানের দরদ, আবেগ আর আবেদন আমি আর অন্য কোথাও পাইনা। ওকে আরও বলি, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী নিশ্চয়ই পড়েছিস। একবার বঙ্গবন্ধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি অনুষ্ঠান শেষে নদী পথে ঢাকা ফিরছেন। নৌকায় আরও অন্যান্যদের সঙ্গে আছেন অনুষ্ঠানের আমন্ত্রিত সংগীতশিল্পী আব্বাসউদ্দিন। নদীপথে আব্বাসউদ্দিনের গান শুনে বঙ্গবন্ধু তাঁর স্মৃতিকথায় লিখছেন, "নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে।" এই হলো এই দেশ ও মাটির গান। যে মাটির পরে কবি ঠেকিয়েছেন মাথা।

দূরদেশের নীলনয়না রূপসী বা উর্বশী না, কাজল চোখের শ্যামলা আর কালো মেয়েকে গভীর ভালোবেসে হাহাকার করে এদেশের বাউলই গান লিখেছেন, "শ্যামকালিয়া সোনা বন্ধু রে নিরলে তোমারে পাইলাম না....।" কিংবা "ভ্রমর কইয়ো গিয়া শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে অঙ্গ যায় জ্বলিয়া রে ...." --- আহা রাধারমণই তো, কিংবা উদ্দাম, বাঁধা-বন্ধনহীন, উৎসবমুখর এক জীবন কাটিয়ে পরকালের চিন্তায় আচ্ছন্ন হাসন উদাস গাইছেন "আমি না লইলাম আল্লাজির নাম রে, না করলাম তার কাম" মরমি মৃত্তিকার ফসল হাসন, দুর্বীন শাহ, উকিল মুন্সি, গিয়াসউদ্দিন, ক্বারি আমির উদ্দিন - এ মাটির উষ্ণতায়, বয়ে চলা নদীর কুলকুল ধ্বনি আর পাখির মুখর কলতানে ভরে আছে তাদের হৃদয়। তাই নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ অসিয়ত করে যান, আমার শবাধারের পাশে সূরা ইয়াসিনের পাশাপাশি কেউ যেন গায় গিয়াসউদ্দীনের গান, "মরিলে কান্দিস না আমার দায় যাদুধন রে...।"

সদ্য লাইব্রেরি থেকে ইস্যু করা বিছানায় উল্টে রাখা বইটি খুলি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই "ছবির দেশে কবিতার দেশে" খুলে ছোট বোনকে দেখাই। সুনীল আমেরিকার আইওয়া থেকে নিউইয়র্ক শহরে পৌঁছে অবাক বিস্ময়ে দেখেন জগৎবিখ্যাত কবি অ্যালেন গিনসবার্গ শুনছেন আব্বাসউদ্দিনের গান, "ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে/ ফাঁদ বসাইছে ফান্দি রে ভাই পুঁটি মাছো দিয়া/ ওরে মাছের লোভে বোকা বগা পড়ে উড়াল দিয়া রে।"

গানের বোকা বগার করুণ গল্পের মতই যেন কোথায় প্রজন্মের ‘ক্রাশ’ খাওয়া গল্পের মিল খুঁজে পাই। তারা কী কেবলই উন্নাসিক ও অলীক ফান্দে পড়া!মাটিতে পা পড়ে না, আকাশে উড়ে বেড়ায় তারা। হয়ত সময়টাই এমন।

শেষ করি আজিমপুর কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত আব্বাসউদ্দিনের কবরের এপিটাফ দিয়ে। পল্লিকবি জসীম উদদীনের গানের কথা খোদাই করা আছে সেখানে, "ও কী ও বন্ধু কাজল ভ্রমরারে/ কোনদিন আসিবেন বন্ধু কয়া যাও কয়া যাও রে।" এতো সুন্দর ভগ্ন বিরহী হৃদয়ের কথা, মিনতি কোন নির্জন কবরের কোথাও লেখা আছে জেনে চমকে উঠেছিলাম। যে জীবন মহাকালের যাত্রায় চলে যায় সেকি আর ফিরে আসে। তবু তো স্বজনেরা অপেক্ষা করে দূরাকাশে হারিয়ে যাওয়া নক্ষত্রের মত।

আহা, আব্বাসউদ্দিনের কণ্ঠে নিদেন পক্ষে মোস্তফা জামান আব্বাসীর কণ্ঠে যে ভাওয়াইয়া গান শুনে নাই সে বুঝবে কিভাবে এ মাটির মরমিয়া সব গান, সংগীত মানুষ আর ঈশ্বরের একীভূত অন্তরের অবিচ্ছেদ্য এক ভাষা।

আলমগীর শাহরিয়ার, কবি ও প্রাবন্ধিক। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ