আজ বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

বাংলাদেশ তুমি ফুটবল হও

জুয়েল রাজ  

ফুটবল বিশ্বকাপ জ্বরে ভুগছে পুরো বিশ্ব।
কিন্তু সেই জ্বরের প্রকোপ, হাজার হাজার মাইল দূর বাংলাদেশে যেন একটু বেশী। অধিক জ্বর হলে মানুষ যেমন আবোল তাবোল প্রলাপ বকে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা প্রযোজ্য। ফুটবল জ্বর এমন মাত্রায় পৌঁছেছে, যার প্রকোপে এর দর্শক সমর্থকরা শুধু আবোল তাবোল প্রলাপই বকছে না। আবোল তাবোল কাণ্ডও ঘটাচ্ছেন।

বাংলাদেশে সমর্থক গোষ্ঠীর ৯৫ ভাগই আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল শিবিরে বিভক্ত।

একমাত্র ফুটবলেই দেখলাম নীতি, এবং বিশ্বাসে বাঙালি অটল। পিতার সাথে পুত্রের, মায়ের সাথে কন্যার। ভাইয়ের সাথে বোনের স্বামীর সাথে স্ত্রীর নিজস্ব মতামতের কোন মিল নেই। একজন ব্রাজিল তো আরেকজন আর্জেন্টিনা। মাঝেমধ্যে কেউ আবার অন্যান্য দেশের ও সাপোর্টার আছেন। কিন্তু দিব্যি একসাথে বসে খেলা দেখছেন। প্রচণ্ড বিরোধীতা থাকা স্বত্বেও মেনে নেয়ার একটা মানসিকতা আছে। কিন্তু এছাড়া বাংলাদেশে, আর কোন ক্ষেত্রে এই মেনে নেয়ার মানসিকতা নেই।

গ্রুপ পর্যায়ের খেলায়, নাইজেরিয়ার সাথে আর্জেন্টিনার বিজয়ের সাথে সাথে, গভীর রাতে সিলেট শহরে বিজয় মিছিল হয়েছে। শরীয়তপুরে খেলার দিন আর্জেন্টিনার সমর্থনে গাড়ি বহর নিয়ে মিছিল হয়েছে।

আকাশে, বাতাসে পতাকা, বাড়ির ছাদে, বাড়ির দেয়ালে শুধু পতাকা আর পতাকা, কোথাও বাংলাদেশের পতাকা নেই। এমন উন্মাদনা, বিদেশী পতাকা উত্তোলন নিয়ে কোর্টে রিট করতে হয়। অনেকেই বলেন, খেলার সাথে রাজনীতি মিশাবেন না। কিছুই তো রাজনীতি, দেশপ্রেমের বাইরে নয়।

গোলের পর 'রাজনৈতিক উদযাপন' করায় সুইজারল্যান্ডের জেরদান শাকিরি আর গ্রানিথ শাকার নিষেধাজ্ঞা চেয়েছে সার্বিয়া। তাদের দুজনের গোলেই সার্বিয়াকে হারায় সুইজারল্যান্ড। গোলের পর তারা বিশেষ উদযাপন করেছেন, শাকিরি এক বুটে কসোভোর পতাকা, আরেক বুটে সুইজারল্যান্ডের পতাকা লাগিয়ে নেমেছিলেন। এতেই ক্ষেপেছে সার্বিয়া, নালিশ গেছে ফিফার কাছে। শাকিরি-শাকা দুজনেই আসলে কসোভোর মানুষ। শাকিরির জন্মই হয়েছে কসোভোতে। সার্বিয়ার গণহত্যার, নির্যাতনের শিকার হয়ে তাদের পরিবারকে শরণার্থী হতে হয় সুইজারল্যান্ডে। শাকার বাবা কসোভোর স্বাধীনতার আন্দোলন করতে গিয়ে বন্দিও হয়েছিলেন। যারা খেলার সাথে দেশপ্রেম আর রাজনীতির মিল খুঁজে পান না, তাদের বোধদোয় হবে না।

বাংলাদেশে ফুটবল ধুঁকে ধুঁকে মৃতপ্রায়। আমি নিজে জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের নাম জানি না। আবাহনী, মোহামেডান, শেখ রাসেল, আরামবাগ এইসব ক্লাবের নামই জানি শুধু এর বেশী কিছু নয়। আমি জানি এই অবস্থা বাংলাদেশের ৯৯ ভাগ আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল সমর্থকদের। অথচ ইংল্যান্ডের প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রটি ও বিভিন্ন ক্লাবের কোচ, মালিক, খেলোয়াড়দের নাম মুখস্থ বলে দিতে পারবে। শুধু লীগ পর্যায়ে নয়, সারা বছর সংবাদপত্র গুলো পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ফুটবলের সংবাদ করে।

বাংলাদেশে ঠিক তার বিপরীত। বিশ্বকাপে পত্রিকার প্রথম পাতার লিড নিউজ হচ্ছে ফুটবল। টেলিভিশন নাটকে ফুটবল, বিজ্ঞাপনে ফুটবল। খালি ফুটবল আর ফুটবল। বাকী চার বছর আর কোন খবরই থাকেনা।

ক্রিকেট কিংবা ফুটবল শুধুমাত্র শৌখিনতা নয়। বিশাল কর্পোরেট বাণিজ্য আছে এইসব খেলা ঘিরে। ক্লাবগুলো মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ড দিয়ে একেকজন খেলোয়াড়কে ক্লাবে নিয়ে আসে। এবং বিভিন্ন লীগে টিকেট, স্পন্সর, বা ব্রান্ডিং মিলিয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন পাউন্ডের বাজার এই খেলাগুলোর।  ইংল্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের তারকা খেলোয়াড়গণ ইংল্যান্ডের বিভিন্ন ক্লাবে খেলে থাকেন।

কিন্তু অবাক করার বিষয় লন্ডন শহরের আকাশে কোন পতাকা দেখিনা। এমন কি ইংল্যান্ডের পতাকাও না। খুব বেশী হলে কেউ কেউ বাসার জানালায় ছোট পতাকা লাগিয়ে রাখেন। আরো খুব বেশী হলে গাড়ীতে ইংল্যান্ডের ছোট পতাকা টাঙিয়ে রাখেন। সেটা কয়েকশো বা হাজারে এক দুইটা দেখা যায়। পানামার সাথে খেলায় ৬ গোলে বিজয়ী হয়েছিল ইংল্যান্ড, গ্রুপ পর্যায়ে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড এটি। কিন্তু কোথাও একটু উচ্ছ্বাস বা আবেগের অতিশায্য নেই।  
মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপনে  বিন্দুমাত্র কোন লক্ষণ নেই। লন্ডনের বিভিন্ন জায়গায় খোলা ময়দানে, শপিং মলে বড় পর্দায় লোকজন খেলা দেখেছে, হৈ হুল্লোড় করেছে এই পর্যন্তই। বাজির ঘরে, মিলিয়ন পাউন্ডের বাণিজ্য হচ্ছে। পাবগুলো ছুটিয়ে ব্যবসা করছে।

ইংল্যান্ডের খেলার ফলাফল যদি ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনা কেউ করতো, বাংলাদেশের অবস্থা কি হতো, সেটি চিন্তা করে আমার গাঁ শিউরে উঠে।

নিশ্চিত রাস্তায় বিজয়  মিছিল হতো, মোটরসাইকেল মহড়া হতো, রঙ ছিটানো হতো, পক্ষ বিপক্ষ শিবিরে মারামারি হাতাহাতি খুনোখুনি ঘটতো। কারণ কুপিয়ে আহত করা, বাড়ি ঘরে হামলা এই জাতীয় বহু সংবাদ পত্র-পত্রিকায় পড়েছি।

ক্রিকেটে এশিয়া কাপে প্রথমবার বিজয়ী হয়েছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। কোথাও একটু উচ্ছ্বাস চোখে পড়লো না। নারী ক্রিকেটের বিজয়কে যদি এইভাবে ছড়িয়ে দেয়া যেতো। আকাশে বাতাসে পতাকা, টেলিভিশনে ক্রিকেট, পত্রিকায় ক্রিকেট, গানে ক্রিকেট, নাটকে ক্রিকেট, বাংলাদেশের নারী  ক্রিকেটের চেহারাই বদলে যেতো।

মাত্র সাড়ে তিন লাখ জনসংখ্যার দেশ আইসল্যান্ড, বিশ্বকাপ খেলতে এসেছে। এতো কম জনসংখ্যার দেশ হয়েও দেশটি পৃথিবীর সব চাইতে ধনী দেশ গুলোর একটি। সব চাইতে মানবিক দেশ গুলোর একটি। দেশটির একটা বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর সেরা পাঁচশো বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে অবস্থান করছে। দেশটির প্রতি দশজনের মাঝে একজন কোন না কোন বই লেখক! আইসল্যান্ডের গোলকিপার নাকি পেশায় একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা। বুঝোন তাহলে অবস্থাটা। বাংলাদেশে ১৭ কোটির অধিক মানুষ, স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখলেই বাংলাদেশের ফুটবল থেকে বের হয়ে আসবে, মেসি, রোনালদো, নেইমার মানের খেলোয়াড়।  

বাংলাদেশে দর্শক তৈরি করতে হবে, আর সেই দায়িত্ব আপনার আমার সবার। বিশেষ ভূমিকা    রাখতে হবে মিডিয়াকে। কারণ, বর্তমান সময়ে  গণমাধ্যম  সবচেয়ে বেশী শক্তিশালী। সাথে যোগ হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এই শক্তিকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।  

আর্জেন্টিনা ব্রাজিল নিয়ে যে উন্মাদনা বাংলাদেশ সেই উন্মাদনার বিন্দু পরিমাণ যদি বাংলাদেশ নিয়ে থাকতো, তাহলে বাংলাদেশের চেহারাই বদলে যেত।

১৯৯৮ সালে প্রথম বিশ্বকাপ খেলেছিল জাপান । তিন ম্যাচের তিনটাতেই হার, গোল করেছিল একটা। সেই জাপান যখন পরের বিশ্বকাপের সহ-আয়োজক হয়ে গেল, স্বাগতিক হবার দৌড়ে থাকা ফুটবল পরাশক্তিগুলো কথা শোনাতে বাদ রাখেনি ওদের। কিন্তু জাপান বারবার তাদের সক্ষমতার প্রমাণ দিচ্ছে।

বাংলাদেশ নয় কেন? অবশ্যই বাংলাদেশ ও পারবে। বাংলাদেশ ক্রিকেটে পেরেছে, ফুটবলে ও পারবে। সব দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়। দেশের মানুষ হিসাবে আমাদের ও দায়িত্ব আছে। ফুটবলকে ভালোবাসতে হবে। এবং শুধু আর্জেন্টিনা ব্রাজিল নয়, বাংলাদেশের ফুটবল কে ভালবাসুন। পৃষ্ঠপোষকতা করুণ। লাল সবুজের পতাকা উড়বে বিশ্বমঞ্চে। পৃথিবী গাইবে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’।

শুধুমাত্রে বাংলাদেশই, পরের বাড়ির সাদি নাইচ্চা মরে হারামজাদী টাইপের অবস্থা। (মানে হলো অন্যের বাড়ির বিয়েতে আনন্দে নাচা)

ফুটবলের এই উন্মাদনা দেখে আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আহা! বাংলাদেশ তুমি যদি ফুটবল হয়ে যেতে তাহলে হয়তো তোমাতে বুঁদ থাকতো প্রজন্মের পর প্রজন্ম। নিজের বিশ্বাস, নীতি,  প্রেম দিয়ে গড়ে তুলতো হয়তো একটি অসাধারণ বাংলাদেশ।  

প্রিয় বাংলাদেশ তুমি ফুটবল হয়ে যাও।



জুয়েল রাজ, সম্পাদক, ব্রিকলেন; যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি, দৈনিক কালেরকন্ঠ

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ