আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

মাহি বি’র জামাতি প্ল্যান-বি!

এমদাদুল হক তুহিন  

সাবেক এক রাষ্ট্রপতির ছেলে মাহি বি। পুরষ্কারপ্রাপ্ত টিভি ব্যক্তিত্ব। সুন্দর বক্তৃতা তার। কথা বলে মানুষকে বশে আনার ক্ষমতাও কম নয়। উদ্যোক্তা হয়েও পূর্বাপর সময়ে দেখিয়েছেন তা। সম্প্রতি এই গুণধর নিজের অন্য একটি গুণের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ‘প্ল্যান বি’ নিয়ে সামনে এগুচ্ছেন। বেশ ভালো কথা। অঢেল টাকা খরচ করে, ফেসবুকে স্পন্সর করে সমাজকে বদলে দেয়ার যে স্বপ্ন তার, আপাতদৃষ্টিতে সেই স্বপ্নকে শ্রদ্ধা জানাতেই হয়। মাহি বলেছেন, হানাহানি চলবে না। রক্তের হোলি খেলা বন্ধ হবে। তা অবশ্যই প্রশংসার।

তবে এই প্রশংসনীয় কাজটি করতে গিয়ে মাহি প্রকারান্তরে একাত্তরের চেতনাকে অপমান করেছেন। হীন এক উদ্দেশ্যে সুবক্তৃতার আড়ালে বিনষ্ট করে দিতে চেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির লক্ষ্যকে। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে যেসব স্লোগান উঠেছিল, সেইসব স্লোগানকে কটাক্ষ করে প্রকারান্তরে তিনি জামাতের পক্ষ নিয়েছেন। সময় বুঝে মুছে দিতে চেয়েছেন তরুণ প্রজন্মের অন্যতম আন্দোলন তথা স্মৃতিকে। বুঝাতে চেয়েছেন রক্ত আগুন করা সেইসব স্লোগান ছিল ভুল!

প্ল্যান বি মাহির নতুন প্রকল্প। সেই প্রকল্পের নতুন স্লোগান ‘লড়াই করার দিন শেষ, শান্তি সুখের বাংলাদেশ।’ তবে সুখের বাংলাদেশ বিনির্মাণের আগে তিনি কটাক্ষ করেছেন একাত্তরের চেতনাকে। বাধা আসবে যেখানে লড়াই হবে সেখানে সেই মর্মে বিশ্বাসী নন তিনি, বলেছেন তাও। দেশে কোন বাধা নেই এমনটাকে ভাবনা করেই তিনি এগিয়ে যেতে চান। কোন বাধা না থাকলে দেশ অবশ্যই অতি সুখ ও সমৃদ্ধির। থাকার কথা নয় সেখানে হানাহানিও। অবশ্য সেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কটাক্ষ করারও কথা নয়। সে অবশ্য ভিন্ন কথা।

মাহির প্রসঙ্গেই আসি। ‘একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠো আরেকবার’ স্লোগানটি উল্লেখ করে মাহি বি প্রশ্ন করেছেন স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর স্বাধীন দেশেই বাঙালিরা কার বিরুদ্ধে গর্জে উঠবে। নিশ্চিতভাবে এর উত্তর, ওই পাকি প্রেতাত্মার। আরও নিশ্চিতভাবে বলা যায়, যতদিন পর্যন্ত এ দেশে কোন পাকি প্রেতাত্মারও প্রভাব থাকবে ততদিন পর্যন্তই এ স্লোগান প্রতিধ্বনিত হবে। আকাশ বাতাস কাপিয়ে উচ্চারিত হবে। উচ্চারিত হবে ওই ২০১৩ সালের মতো। তবে মনে রাখতে হবে স্লোগানটি আওয়ামী লীগের নয়। আরও বাস্তবতা বর্তমান সময়ে এ স্লোগান প্রাসঙ্গিকও নয়। তেমনি এই স্লোগানের ভুল ত্রুটি ধরতে যাওয়াও অপ্রাসঙ্গিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

আর এই স্লোগানটি তখনওই প্রাসঙ্গিক ছিল, যে সময়কালে আঘাত করা হয়েছিল বাংলাদেশের মেরুদণ্ডে। আঘাত এসেছিল আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উপর। যুদ্ধাপরাধীরা দেখিয়েছিল ভি-চিহ্ন। আর তখনই এ স্লোগানে কেঁপে উঠে শাহবাগ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে জেগে উঠেছিল প্রতিটি বাঙালি। সেই সময়ে এরচেয়ে কোন বিকল্প ছিল বলে আমাদের জানা নেই। ঠিক পাঁচ বছর পরে এই স্লোগানকে কটাক্ষ করার মানে অবশ্যই অন্য একটি পক্ষকে সমর্থন। আপাত দৃষ্টিতে অবশ্যই বলা যায় - সেই শক্তিটি জামাত শিবিরের।

বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় তার আরও কিছু বক্তব্যে। ‘দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেবো রক্ত’ স্লোগানটি উল্লেখ করে মাহি বি ২০১৮ সালে এসে মহাবিস্ময়ে বলছেন, ‘বলে কী!’ প্রশ্ন হচ্ছে, পাঁচ বছর পর তার কেন এই বিস্ময়? ২০১৩ সালে কোথায় ছিলেন তিনি? কী করেছিলেন তখন? কতোটুকু উদ্যোগ নিয়েছিলেন তরুণদের পাশে থাকার? অবশ্য তরুণরা বলে, গণজাগরণের মতো দেশ মাতৃকার আন্দোলনে মাহি উচ্ছিষ্টই বটে। তারপরও প্রশ্ন হচ্ছে, রাস্তায় পড়ে থাকা রক্ত কি চোখে পড়েনি তার? কোন সে রক্তে ভেসে গিয়েছিল বাংলাদেশ-জানা নেই? কী কারণে এই স্লোগান উঠেছিল তাও কি অজানা মাহি বি’র?

ইতিহাস বলছে, ২০১৩ সালে তখনই এই স্লোগান উঠেছিল ঠিক তখনই-যখন একের পর এক রক্ত ঝরেছে। রাজীব হত্যার পর থেকেই এই স্লোগান। যখন পাতা পড়ার শব্দকেও সন্দেহ হয়েছে, তখন থেকেই। যখন নির্ঘুম রাত কেটেছে- সকাল হবে কী? ঠিকঠাক যাবো তো বাড়ি? নাকি গলা কাটা লাশ! এখন প্রশ্ন হচ্ছে- হে উচ্ছিষ্ট মাহি বি, তখন এই স্লোগান কি সত্যিই প্রাসঙ্গিক ছিল না? আরও প্রশ্ন, হে তথাকথিত তারুণ্যের নেতা যদি তোমার পরিবারের কারো রক্ত ঝরে, তোমার কোন বন্ধুর, কোন সহযোদ্ধার- কোন স্লোগান উঠবে তোমার স্বরে?

মাহি বি আরও বলেছেন, বর্তমানে তরুণ প্রজন্ম রক্ত দিতে চায় না। আমারও তাই মনে হয়। সত্যিকার অর্থেই ২০১৮ কারো রক্ত দেয়ার প্রয়োজন নেই। নেই সেই পরিবেশও। পুলিশ বাহিনী এখন চাঙ্গা। যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছে। তরুণ প্রজন্ম মনে করে তাদের স্বপ্ন কিছুটা হলেও বাস্তব। এছাড়াও দেশ থেকে ব্লগার বিচ্যুত। এখন এক্টিভিস্ট সব আওয়ামী লীগের। অথবা এন্টি আওয়ামী লীগ। যারা এক সময় মন খুলে আওয়ামী লীগের সমালোচনা করতো তারাও এখন আর লিখে না। যে আওয়ামী লীগে জামাতের অনুপ্রবেশ, যে ছাত্রলীগে শিবির, যেখানে এমপির প্রিয়ভাজন ইনকিলাবের সাংবাদিক, যেখানে এনটিভি আর একাত্তরের পার্থক্য নেই- সেখানে বাংলাদেশ এক চরম সুখ আর শান্তিতে সমৃদ্ধ। আমার তাই মনে হয়। আর সময়টিতে মাহিদের চরম সুখে আর শান্তিতেই থাকার কথা। তাই মাহি বলতে পারে, আর কোন রক্ত নয়। নয় হোলি খেলাও। অথচ তিনি স্পষ্টত ভুলে গেছেন ২০১৩ সালের রক্ত লাল বাংলাদেশের কথা। যেমন ভুলে গেছে বর্তমান সরকারও।

মাহির বাবা বলেন, তিনি জামাতের সঙ্গে নেই। প্রায়শই এনিয়ে বিনিয়ে বলেন, রাস্তায় ছুড়ে ফেলার অপমানও ভুলেননি একেবারে। তিনি এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে নিজের নেতৃত্বের দোহাই দেন। ড. কামালের কথা বলেন। তাদের ধারণা এতোটাই পোক্ত যে নিজেরা একসঙ্গে থাকলেই তারা দেশ উদ্ধারে সম্ভব। দেশের ক্রান্তিকালে তারাই জাহাজের উত্তম নাবিক। আর জামাতকে তারা মুখে মুখে ঘৃণিতই মনে করে। অথচ এই বি চৌধুরীর ছেলে মাহি কী অবলীলায় জামাতের পূজায় মত্ত! একাত্তরের চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিটি স্লোগানেই তার প্রবল আপত্তি। কিন্তু আপত্তি নেই বিএনপি কিংবা জামাত শিবিরে! নেই তাদের স্লোগানেও।

মাহির মুখে তাই কখনও শোনা যায় না ‘গণতন্ত্র বিষাক্ত দুধের মাখনের মতো’ এই স্লোগানটি ভুল। যে স্লোগানের প্রবক্তা জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মওদুদি। ‘গণতন্ত্র হারাম’ জামাতের পূর্বাপর এমন তত্ত্বের সমালোচনাও নেই মাহির মুখে। এমনকি ‘দিয়েছি তো রক্ত/ এবার খাবো রক্ত’ শিবিরের এই ভয়ঙ্কর স্লোগান নিয়েও নিশ্চুপ ওই সুবক্তা! ফলে শাহবাগকেন্দ্রিক স্লোগানের তার একপেশে একপেশে সমালোচনাই প্রমাণ করে তিনি এখনও ওই আন্দোলনের ভুল দেখছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাওয়ার বিরুদ্ধাচরণ করছেন। প্রকৃতপক্ষে যা সরাসরি জামাত-শিবির তথা যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সাফাই গাওয়ার শামিল।

তবে, শাহবাগ আন্দোলনের কর্মীরা মনে করেন তারুণ্য উদ্দীপ্ত ওই আন্দোলনের সামনে মাহি বি ছিল নিতান্তই খড়কুটো। অথচ সেই খড়কুটো যখন প্ল্যান বি সাজানোর নামে একাত্তরের চেতনাকে কটাক্ষ করার চেষ্টা করেন, সময়টিতে এসে যখন প্রকাশ্যে জামাত শিবিরের পক্ষ নেন তখন অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের তারুণ্যকে জাগ্রত হওয়ার সময় এসেছে বলেই আমার মনে হয়। এবং সেই লক্ষ্য হওয়া উচিৎ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের সকল শক্তিকে রুখে দেয়ার। কিংবা ওই প্রেতাত্মার সঙ্গে যারা আঁতাতে মত্ত হতে চায় তাদেরও।

এমদাদুল হক তুহিন, ব্লগার, কবি ও সংবাদকর্মী। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ