আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

অনন্ত বিজয় দাশ: মৃত্যুই যেখানে শেষ কথা নয়

পাপলু বাঙ্গালী  

দার্শনিক সরদার ফজলুল করিম বলতেন, 'আমি বলি যে মানুষের জন্ম কবে হয়। আমি কবে জন্মাব? মৃত্যুর মধ্য দিয়েই আমি জন্মাব।' মানুষ সময়ে-অসময়ে নিরন্তর চলা এক ঐতিহাসিক নদীর নাম। নদীর জল ঋতু চক্রে পড়ে শুকিয়ে যেতে পারে কিন্তু নদীর নিরন্তর ছুঁটে চলা থামে না। মানুষও সেরকম তাঁর মৃত্যু নেই। কিন্তু অবশ্যই জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ হতে হবে।



মানুষ তাঁর চিন্তা-চেতনা নিয়ে অবিরত ছুটে চলা এক একটা স্রোতস্বীনি। শুদ্ধ কবি জীবনানন্দ দাশ তাই লিখেছিলেন, 'মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়; অনন্ত বিজয় দাশ। এক অপার সম্ভাবনাময় তরুণ ছিলেন। আমার কাছে শহরের এক খসে পড়া নক্ষত্র অনন্ত বিজয়। যাকে এক অন্ধকার সমাজ প্রকাশ্য ভোরের হাওয়া মিলিয়ে যাওয়ার পূর্বেই চাপাতি দিয়ে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে।



কী তাঁর অপরাধ ছিল নিজেরাই নিজেদের জিজ্ঞেস করুন। আমাদের কাছে অনন্ত বর্বর আদিম সমাজে জন্ম নেয়া এক ফিনিক্স। যে তাঁর চিন্তা নিয়ে বারবার ফিরে আসবে তাঁকে পরাজিত করা যাবে না। তাকে ধ্বংস করা যায় না। শহরের নতুন রোদ্দূরে তাঁর দেখা মিলবে, ভোরের চমৎকার বাতায়নে অনন্ত এসে দাঁড়াবে। অনন্তদের মৃত্যু নেই মৃত্যু হতে পারে না। যার বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা চেতনায় এবং নতুন ভাবনায় অনেকেই স্বস্তি পাচ্ছিলো না। হাজার বছরের সমাজের ভাবনায় গেঁথে যাওয়া শৈবাল পরিষ্কারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তরুণ অনন্ত। যা কূপমণ্ডুকদের অন্ধকার চাষাবাদের এবং আদিম রুটি-রুজির দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল এক শহুরে হাতে কলম ধরা তরুণ।



যিনি মানুষের অতি প্রাকৃতিক শক্তির চিন্তার জায়গায় প্রাকৃতিক ব্যাখ্যার পরিমণ্ডল তৈরির চেষ্টা করেছিলেন। অদম্য চেষ্টা আর চর্চায় যিনি হয়ে উঠেছিলেন যুক্তিবাদী তরুণ। গড়তে চেয়েছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ, ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন যুক্তিবাদী চিন্তা-চেতনা। শহরের অন্যান্য বিজ্ঞানমনস্ক তরুণদের নিয়ে তাই গড়ে তুলেছিলেন 'বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিল।' যার মাধ্যমে কুসংস্কার আর অজ্ঞতাকে সরিয়ে জায়গা দিতে চেয়েছিলেন গবেষণালব্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞানকে। শুধু বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিলই গড়ে তুললেন না। মানুষের কাছে বিজ্ঞানের গবেষণালব্ধ জ্ঞান আর যুক্তিবাদী চিন্তা ছড়িয়ে দিতে নিজের সম্পাদনায় বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতার ছোট কাগজ 'যুক্তি' দিয়ে বিজ্ঞান আন্দোলনের নিবিড়ভাবে সক্রিয় থাকার চেষ্টায় থাকলেন।



চিন্তায়, শ্রমে আর ঘামে এই সমাজকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ হিসেবে। মানুষগুলো তাঁর সঙ্গে নতুন দিনের সারথি হবে। কিন্তু পুরাতন সমাজের আবর্জনা থেকে জন্ম নেয়া মস্তিষ্ক তাঁকে হত্যা করলো নির্মমভাবে। কিন্তু ধ্বংস করতে পারলো না। অতীতে যেমন থামানো সম্ভব হয়নি নতুন চিন্তার জয়রথকে।



ষোল শতাব্দিতে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে এই কথাটা বলাও বিপজ্জনক ছিল। কিন্তু সেই সময় কোপার্নিকাস তত্ত্বটা সামনে নিয়ে এসেছিলেন। কোপার্নিকাস এক ধাক্কা দিয়ে পৃথিবীকে সরিয়ে দিয়েছিলেন মহাবিশ্বের কেন্দ্র থেকে। মনে হতে পারে এটা তো স্বাভাবিক ঘটনা-পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে- এটা আমরা অহরহ বলছি। কিন্তু সেই সময় এই কথাটা বলা বিপজ্জনকই ছিল না-প্রাণঘাতীও ছিল। আজকের অহরহ চিন্তার জায়গায় আসতে ধর্মান্ধদের ভীড়ে কয়েক'শ বছর লেগেছিল বিজ্ঞানের। তবুও লড়াই থেমে থাকে নি।



প্রকৃতিকে যুক্তি দিয়ে বিচারের জায়গা থেকে যুক্তিবাদী মানুষ সরে আসে নাই। তাই মধ্যযুগীয় চার্চের নির্দেশ ব্রুনোকে পুড়ে মরতে হয়েছিল, গ্যালিলিওকে সইতে হয়েছিল অসহ্য যন্ত্রণা। সবচেয়ে বেদনাদায়ক এবং নৃশংস পরিণতি বরণ করতে হয়েছিল জ্যোর্তিবিজ্ঞানী হাইপেসিয়াকে। চার্চের এক রিডারের নেতত্বে আলেকজান্দ্রিয়ার রাস্তায় জ্যোর্তিবিজ্ঞানী হাইপেসিয়াকে ঝিনুকের খোল দিয়ে ঘষে ঘষে তার শরীরের চামড়া আর মাংস ছড়িয়ে নেয়া হয়েছিল। তারপর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হল।



ভয়-ভীতি অত্যাচারের অবজ্ঞা করে অতীতের মতো সেবারও আস্তে আস্তে বিজ্ঞান এগিয়ে গিয়েছিল। হাইপেশিয়াকে, ব্রুনোকে,গ্যালিলিওকে কিংবা যখন ডারউইনকে 'শয়তানের সঙ্গী' আখ্যায়িত করা হয় তখন খুবই অল্প মানুষকে পাওয়া যাবে হয়তো প্রতিবাদ করেছিল, কিন্তু বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা থেমে থাকে নাই। বরং জ্ঞান আর অজ্ঞতাকে সরিয়ে প্রবল প্রতাপে বিজ্ঞানই জায়গা করে নিয়েছিল তার জায়গা।



অনন্ত বিজয় দাশকে যারা হত্যা করেছিল তারা তাঁর চিন্তার কাছে পরাজিত হয়ে, যুক্তির কাছে হেরে গিয়ে সেই আলেকজান্দ্রিয়ার রাস্তার ধর্মান্ধদের মতো ছুঁটে এসেছিল সুজলা-সুফলা এই অনন্তের প্রিয় শহরের চাপাতি নিয়ে। কিন্তু যে চারজন অনন্ত বিজয়ের সামনে এসেছিল চাপাতি হাতে তারা অনন্তের কাছে শুধু মানুষ হিসেবেই এসেছিল। তাঁর কাছে তাদের একটা পরিচয় ছিল,তারা মানুষ। চাপাতি হাতে সেই মানুষরূপি নরখাদকগুলো নিশ্চয়ই এখন হাঁটছে, ফিরছে, হাসছে। কিন্তু তাদের মনে শান্তি নেই, হৃদয়ে প্রচণ্ড ভয় ভর করেছে। তারা অস্থির সময় পার করছে। মানুষ হত্যার ঠুনকো মতাদর্শ নিয়ে তো ভালোভাবে বাঁচা যায় না। মানুষ অনন্তকে তারা হত্যা করতে পারে নাই। তারা শুধু তার ক্ষণজন্মের অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিতে পেরেছে। কিন্তু অনন্ত মাথা উঁচু করে তাঁর চিন্তা নিয়ে সারা দেশ, সারা বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াবেন। অথচ সেই অন্ধকার চাষাবাদ করা হিংস্র দাঁতাল শুকরগুলো পড়ে থাকবে পুরাতন দেয়ালের খুপড়িঘরে। যেখানে আলো নেই, ভালোবাসা নেই।



অনন্ত বিজয় দাশ হত্যার দিন গড়িয়ে, সপ্তাহ গড়িয়ে মাস চলে যাচ্ছে কিন্তু তাঁর খুনিদের গ্রেফতার করতে পারে নাই এই রাষ্ট্র নামের অথর্ব প্রশাসন। একই ঘটনা দেশের সম্ভাবনাময় তরুণ বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়ের ক্ষেত্রেও। হত্যার একশ’ দিন যাওয়ার পরও কাউকে গ্রেফতার করতে পারে নাই। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কথা আমরা বলি বারবার কিন্তু সেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি আবার সকল জায়গায় সক্রিয় নয়। যেমন প্রধানমন্ত্রীকে কটুক্তি করলে তাদের কয়েক ঘন্টার মধ্যে খুঁজে বের করে গ্রেফতার করা হয়। তথাকথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার কথা বলে অনেক ব্লগার, লেখককে কয়েক ঘন্টার ভেতর এই রাষ্ট্রে গ্রেফতার করার ইতিহাস আছে। কিন্তু মুক্তমনা লেখক কিংবা ব্লগার হত্যার পর সেই সক্রিয়তা খুঁজে পাওয়া যায় না। এইখানে ধিক্কার জানানো এবং ঘৃণা জানিয়ে দেয়া ছাড়া আপাতত আমাদের কোন সামর্থ্য নেই।



এই রাষ্ট্র হয়তো অভিজিৎ, অনন্ত বিজয় দাশের হত্যার বিচার করতে পারবে কিনা সেই ইচ্ছা তাদের আছে কিনা জানি না। কিন্তু আমরা বিচার প্রাপ্তির জন্য লড়ে যাবো, নৃশংস মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবো, মুক্ত মতামতের উপর পশুদের আক্রমণ প্রতিহত করতে রাজপথে থাকবো। একই সঙ্গে বিজ্ঞানভিত্তিক-একই ধারা শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য লড়ে যাবো। প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় তারা নিয়ে আসতে না পারলেও। অনন্ত বিজয় দাশ বেঁচে থাকবেন অন্ধকার দূর করা ভিষণ তেজোদ্বিপ্ত আলো হয়ে। সেই আলো তিনি আমাদের হাতে দিয়ে গেছেন। সেটা এখন আমাদের বয়ে নিয়ে যাবার পালা। সকল ভয়-ভীতি,অত্যাচার-অজ্ঞতাকে পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে যাবো।



শেষ করার আগে আবারও দার্শনিক সরদার ফজলুল করিমের আরেকটা কথা আমাদের সামনে চলে আসে, 'ব্যক্তিমানুষের মৃত্যু আছে, তার আদর্শ বা স্বপ্নের মৃত্যু নেই।' শহরের নক্ষত্র পতন হয়েছিল ১২ মে ২০১৫ সালে। আরো হাজার-হাজার, লক্ষ-লক্ষ নক্ষত্র তৈরি হয়ে আছে। পতনের শব্দ শুনার জন্য অপেক্ষায় আছে বিংশ শতাব্দি। তবুও হারা চলবে না। জীবন যেখানে দ্রোহের প্রতিশব্দ মৃত্যুই সেখানে শেষ কথা নয়।



অনন্ত বিজয় দাশ, আপনাকে লাল সালাম!

 

পাপলু বাঙ্গালী, প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কর্মী। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ