আজ বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

নির্বাচন ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শঙ্কা

রাজেশ পাল  

‘বাবারা, আমার মেয়েটা খুব ছোট। ভগবানের দোহাই লাগে, তোমরা একজন একজন করে এসো। সবাই একসাথে এলে মেয়েটা আমার বাঁচবে না’

এটা ছিলো সদ্য শৈশব পেরোনো কিশোরী পূর্ণিমা রাণী শীলের মায়ের করুণ নিবেদন। আর এই নিবেদন একদল আনন্দের আতিশয্যে বিবেক, বুদ্ধি, বিবেচনা, সর্বোপরি মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলা কিছু অমানুষের কাছে, যারা নির্বাচনের জয় উদযাপন করেছিল একটি দরিদ্র অসহায় নিরীহ সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবারের কিশোরী মেয়েটির উপরে তার পিতামাতার সামনেই পৈশাচিক উল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নির্যাতিতা কিশোরী পূর্ণিমা আর তার বাবামায়ের আর্তনাদে আকাশে বাতাসে চরম আলোড়ন তৈরি হয়তো হয়েছিলো। কিন্তু ধর্ষণের মতো একটি চরমতম ভয়াবহ অপরাধ, আইনে যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, এহেন অপরাধ করেও বিন্দুমাত্র ভয় বা অনুশোচনাবোধ কাজ করেনি হামলাকারীদের মধ্যে। কারণ, তাদের কাছে শতভাগ নিশ্চয়তা ছিলো যে, "তাদের পার্টি এখন রাষ্ট্রক্ষমতায়। পুলিশ, প্রশাসন সব এখন তাদের হুকুমের গোলাম মাত্র। কাজেই যাই করিনা কেন, আমাদের আসলে কিছুই হবেনা।"

সেসময়ে মাত্র ক্লাস সেভেনে পড়া সবে শৈশব পেরোনো তের বছরের কিশোরী পূর্ণিমা আর তার মায়ের আর্তনাদ যেন উল্লাসের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় ধর্ষকদের। এমনকি ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিতে পর্যন্ত বাধা দেয়া হয়। প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। থানায় মামলা পর্যন্ত করতে দেয়া হয়নি। সকল হুমকি আর বাধাকে উপেক্ষা করে কিশোরী পূর্ণিমা শুধুমাত্র মনের জোরে অসীম সাহসিকতার সাথে ১৪ অক্টোবর ২০০১ তারিখ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জবানবন্দি দেওয়া পূর্বক মামলা করেন। কিশোরী শরীরের হায়েনাদের নির্মম অত্যাচার এর ক্ষত থেকে তখনও ঝরছিল রক্ত। আজো সে ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে শরীর ও মনে।

এতো শুধু শুরুই মাত্র। ২০০১ সালে নির্বাচনে জিতেই বিএনপি জামায়াত ঐক্যজোট ঘোষণা করে সেই "১০০ দিনের বিশেষ কর্মসূচি", বিশেষ কর্মসূচি হিসেবে নানা ধরণের প্রশাসনিক সংস্কারের কথা মুখে বললেও কার্যত ওই ১০০ দিন ছিলো নিজেদের দলীয় কর্মীদের "যা ইচ্ছে তাই করো, কেউ কিছুই বলবেনা" করার ওপেন লাইসেন্স। এধরণের ক্লিনচিট পাওয়ার পরে কটা মানুষেরই বা বা মাথা ঠিক থাকে? বিশেষত সদ্য ৫ বছর বিরোধী দলে থেকে এদেশের রাজনীতির অসুস্থ কালচার হামলা মামলা ঝামেলা কমবেশি ঝড়ঝাপটা তো গেছেই। সেটার বদলা নিতে হবেনা? আর তাই তারা দাবানলের মতো হিংস্র উন্মত্ততায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী আর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপরে। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, এবং ৯০ এর বাবরি মসজিদ কেন্দ্রিক উন্মত্তার পরে এধরণের চরম সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা আর নির্যাতন একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসাবেই যুগ যুগান্তর ধরে চিহ্নিত হয়ে রইবে ইতিহাসের পাতায় পাতায়।

২০০১ সালে নির্বাচনে জিতে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসে অক্টোবরের ১ তারিখে। সাথে সাথেই যেন ধ্বংসের প্রলয় নাচন শুরু করে তাদের নেতাকর্মীরা ৫৬ হাজার বর্গ মাইল জুড়ে। আজ ১৮ বছর পেরিয়ে গেলেও সে ত্রাসের রাজত্বের দুঃসহ স্মৃতিগুলো আজো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে। ২০০১ সালের অক্টোবরের ১ তারিখ নির্বাচনে শতকরা ৪১ ভাগ ভোট পেয়েও মাত্র ৫৬ টি আসন নিয়ে বিরোধী দলের আসনে বসে আওয়ামী লীগ। স্পষ্ট মনে পড়ে আওয়ামী লীগের নেতারা সেবার ও এইবারের মতোই জয় এর ব্যাপারে "শতভাগ নিশ্চিত" ছিলেন।

আহমদ ছফা বলেছিলেন, "আওয়ামী লীগ যখন জেতে তখন একা জেতে। কিন্তু হারার সময়ে সবাইকে নিয়েই হারে"। কথাটি যে কী পরিমাণ নির্মম সত্য সেটা ৭৫ এর পরে পুনরায় মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে সারা দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষেরা। এমনকি বিজয়ী দলের উদারপন্থী অনেকে মানুষেরাও প্রকাশ্যই ব্যক্ত করেন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া। প্রফেসর হুমায়ূন আজাদ স্যার সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলোর কথাই তুলে আনেন তাঁর "পাক সার জমিন সাদ বাদ" উপন্যাসে। যেটি লেখার কারণে তাঁর উপরে চরম ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি। বইমেলা থেকে ফেরার পথে নির্মমভাবে চাপাতি দিয়ে এলোপাথাড়িভাবে কোপানো হয় তাঁকে। যা পরবর্তীতে তাঁকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেয়।

অক্টোবরের ১ তারিখ দিনের বেলাটি কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া মোটামুটি শান্তিপূর্ণ ভাবেই কাটে। কিন্তু সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসতে না আসতেই সম্পূর্ণ বদলে যায় দৃশ্যপট। দেশের প্রতিটি শহর বন্দর গ্রামের আনাচে কানাচে দলবেঁধে শুরু হয়ে যান খুন, ধর্ষণ, আর লুটপাটের এক নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ। উপরের নির্দেশে অসহায় ভাবে স্থাণুর মতো দাড়িয়ে থাকে পুলিশবাহিনী। আর তাদের চোখের সামনেই ঘটে চলে একের পর এক তাণ্ডবলীলা, স্টালিন ও এতটা মারমুখী ছিলেন কিনা সন্দেহ। আরাকানী মগ জলদস্যুদের অত্যাচারের বীভৎসতার কারণে উদ্ভূত "মগের মুলুক" বাগধারাটি বর্তমানে বাংলাভাষার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেদিনের ঘটনাবলীর একজন নীরব সাক্ষী হিসেবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছিলো, হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম শব্দটির মর্মার্থ।

শত শত ঘটনার মাঝে কয়েকটি উল্লেখ করি।

*২০০১ সালের নির্বাচনের দিন ৩৮ জন প্রাণ হারান আর আহত হন ১,৬৭২ জন।

* নির্বাচনের পরদিন ২ অক্টোবর ভোলার চরফ্যাশনে ৮/১০ টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ধর্ষণের মেলা আয়োজন করে বিএনপি জামায়াতের ক্যাডাররা। জীবনের ভয়ে পুরুষেরা আগেই পালিয়ে গিয়েছিলেন। তাই মহিলাদের উপরই পাশবিক উল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। এক রাতেই গণধর্ষণের শিকার হন ২০০ নারী! আইয়ামে জাহেলিয়াত!!

* চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানার দক্ষিণ সাধনপুর গ্রামে শীল পাড়ায় একই পরিবারের ১১ জনকে জ্যান্ত পুড়িয়ে খুন করা হয়।

* বাগেরহাটের যাত্রাপুরের ঠাকুরবাড়িতে এক রাতে এক গ্রামের ২৩ জন হিন্দু গৃহবধূকে ধর্ষণ করেছিলো জামায়াত-বিএনপির ক্যাডারেরা। ধর্ষিতাদের মধ্যে দু’জনকে খুনও করা হয়েছিলো।

* ২০০২ সালের ২১ আগস্ট প্রকাশ্য দিনের বেলায় বাস-স্ট্যান্ডে আওয়ামী লীগ নেত্রী ছবি রানীর উপর হামলে পড়ে বিএনপির ক্যাডারেরা। প্রকাশ্য দিবালোকে বাস-স্ট্যান্ডে নগ্ন করে থেকে নিয়ে যাওয়া হয় বিএনপি অফিসে। সেখানে গণ-ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণ শেষে ধর্ষকেরা উনার উনার যৌনাঙ্গে কাঁচ, বালি ও মরিচের গুড়া ঢুকিয়ে দেয়।

* ছাত্রশিবিরের রাজনীতির বিরোধিতা করায় শিবিরের নাছির বাহিনীর ক্যাডাররা বাসায় ঢুকে গুলি করে হত্যা করে বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রিন্সিপাল গোপাল কৃষ্ণ মুহুরিকে

*প্যাগোডার জমি দখলে বাধা দেয়ায় রাউজানের বৌদ্ধ ভিক্ষু জ্ঞানজ্যোতি মহাথেরোকে জবাই করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় মঠে ঢুকেই

এরকম শত শত নির্যাতনের ঘটনা ঘটায় তারা। আক্ষরিক অর্থেই কায়েম হয় আরেকটি "মগের মুলুক"! যদিও এতটা নির্যাতন সম্ভবত মগেরাও করেনি কোনোদিন!

২. নির্বাচনের পরপরই আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাকর্মীরা অধিকাংশই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আশঙ্কায় আত্মগোপনে চলে যান। শামীম ওসমানদের মতো সরকার দলীয় অনেক রাঘব বোয়াল বিরোধী দলে গিয়েই রাতারাতি উড়াল দেন দেশ ছেড়ে বিএনপির হারিছ চৌধুরীর মতোই। ফলে বিএনপি জামায়াতের ক্যাডারদের যাবতীয় রাগের লক্ষ্যবিন্দু হয়ে দাড়ায় সংখ্যালঘু বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায় ৭১ এর মতোই। তবে পাকবাহিনীর ক্ষোভ ছিলো পুরোপুরি ধর্মীয় বিদ্বেষ প্রসূত। কিন্তু এই ক্ষেত্রে পার্থক্য হলো ধর্মীয় বিদ্বেষের চেয়েও বেশী ফ্যাক্টর হয়ে দাড়ায় "ভোট ব্যাংক" ইস্যু। চরম সাম্প্রদায়িক অপরাষ্ট্র পাকিস্তানে ক্রমাগত নিষ্পেষণের অন্ধকারে দিশেহারা রিলেজিয়াস মাইনরিটি গোষ্ঠী আশার আলো খুঁজে পেয়েছিলো "অসম্প্রদায়িকতার স্লোগান" দিয়ে মুসলিম লীগের সাথে বন্ধন ছিন্ন করে আসা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের মাঝে। দলে "স্যাকুলারিজমের মতাদর্শ"-কে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবে "আওয়ামী মুসলিম লীগ" রূপান্তরিত হয় "আওয়ামী লীগে", সব ধর্মীয় মানুষের জন্য খুলে যায় এর দরজা। ফণীভূষণ মজুমদার, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমারা এসে জড়ো হন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রূপান্তরিত আওয়ামী লীগের পতাকাতলে। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপারটি হলো আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা ভাসানী এই নাম পরিবর্তনের প্রতিবাদে নিজের অনুসারীদের সহ দল ছেড়ে বেরিয়ে যান। ভাবতে অবাক লাগে এই মওলানা ভাসানীই আমার সাম্যবাদে বিশ্বাসী বন্ধুদের কাছে আবার "কমরেড রেড মওলানা"!

এরপর দ্বিতীয় বার আবারো নিজেদের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের প্রমাণ দেয় দলটি ৬৫ সালের পাক ভারত যুদ্ধের সময়। যখন আইয়ুব মোনায়েম এর মুসলিম লীগের পেটোয়া বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানকে "চিরতরে হিন্দুশূন্য" করার প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সর্বশক্তি নিয়ে। সেসময় বঙ্গবন্ধুর আদেশে আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগের কর্মীরা গঠন করে প্রতিরোধ বাহিনী। রাত জেগে পাহারা বসায় হিন্দু পাড়াগুলোতে। লাঠি হাতে প্রতিরোধ করেন হামলাকারী আইয়ুব বাহিনীকে। চিরকালই সঠিক সময়ে সিদ্ধান্তহীনতার বিভ্রান্তিতে ভোগা কমিউনিস্টরা সেবারও ব্যর্থ হন নিজ কর্তব্য স্থির করতে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সেই চরম দুর্যোগে তাদের পাশে দাঁড়ানোর বদলে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েন চীন রাশিয়ান তাত্ত্বিক বিতর্ক নিয়ে। অথচ সিংহভাগ কমিউনিস্ট নেতাকর্মীরাই এসেছিলেন পারিবারিকভাবে হিন্দু ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে। ফলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় মাইনরিটি সম্প্রদায়ের মাঝে। তারা মুখ ফিরিয়ে নেন বামদের থেকে। বুকে টেনে নেন দুঃসময়ের বন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর অসম্প্রদায়িকতার স্লোগান দেয়া আওয়ামী লীগকে। অসংখ্য চড়াই উতরাই, আদর্শিক বিচ্যুতি, প্রচার বা অপপ্রচার সেই বন্ধনকে শিথিল করতে পারেনি আজ অর্ধশতাব্দী পরেও। ফলে এন্টি লীগাররা ঠিক একই সমান্তরালে এন্টি হিন্দুও হওয়ার চর্চাটাও করেন কোনো প্রকার রাখঢাক ছাড়াই। পরিস্থিতি ঠিক কোন পর্যায়ে গেছে সেটা বেশ বোঝা যায় যখন সারাজীবন বিএনপি করার পরেও পরেও স্ট্যান্ডিং কমিটির মিটিংয়ে গয়েশ্বর রায়কে রিজভীর মুখে শুনতে হয় "মালাউন" গালি। ভেতরের কথা মাঝে মাঝে এভাবেই মুখ ফসকে বেরিয়ে পড়ে আর কি!

এখানে আরও একটি ব্যাপার লক্ষণীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় থেকে আসা রাজনৈতিক কিছু কিছু কর্মীরা আত্মীয়তাজনিত কারণে কিছুটা হলেও বিরূপ পরিস্থিতিতে প্রটেকশন পাওয়ার সুযোগ পান। এমনও অনেক পরিবার দেখেছি যাদের তিন ভাই একজন ছাত্রলীগ, একজন ছাত্রদল, আরেকজন জড়িত ছাত্রশিবিরের সাথে। মামাতো, চাচাতো ভাইরাতো আছেনই। শ্বশুর, শ্যালকদের কথা বলাই বাহুল্য। কেউ কেউ আবার সেই উদ্দেশ্যেই আত্মীয়তা করেন মুসা বিন শমসের এর মতো, যাতে ক্ষমতার মসনদে যতই উত্থানপতনই হউকনা কেন? তার উত্তাপের আঁচ যেন গায়ে এসে না লাগে। কিন্তু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ঘরগুলোতে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নের বাইরে ছাত্রদল করা ছেলেই আছে হাতেগোনা। এই কারণে স্বদেশ রায়দের অভাব নাহলেও গয়েশ্বর রায় খুঁজে পেতে গলদঘর্ম হতে হয়। ফলে আগুনের তাপ রাজনীতির মাঠ পেরিয়ে সাজানো বৈঠকখানাও ছারখার করে ফেলে নিমিষেই। কিন্তু দমকলে খবর দেয়ার কেউ থাকেনা।

অন্যদিকে বিএনপি জামায়াত তথা ডানপন্থী শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে দেশজুড়ে তাদের কর্মীদের চালানো এই ভয়াবহ তাণ্ডবলীলার প্রতিকার করে তাদের প্রতি সমবেদনা জানানোর মৌখিক ভদ্রতাটুকুও করেনি। উপরন্তু দেশবিদেশের পত্রপত্রিকায় এইসব নিয়ে তুমুল সমালোচনা শুরু হলে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেছিলেন,  "এইসব আসলে অতিরঞ্জিত!" এই উক্তির ব্যাপারে প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন, "আমার নাম সুরঞ্জিত, আর উনার নাম অতিরঞ্জিত"।

অথচ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা অবস্থায় প্রতিটি দলেরই স্মরণে রাখা বাধ্যতামূলক যে, সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু নির্বিশেষে প্রত্যেকেই রাষ্ট্রের নাগরিক আর সমান নীতিই প্রযোজ্য। সেই চেষ্টা বিএনপি জামায়াত করেনি। করার চেষ্টাও করে দেখেনি।

উপরন্তু নির্যাতনকারীদেরই পক্ষাবলম্বন করে নির্লজ্জভাবে।

২০০১ সালে নির্বাচনোত্তর সহিংসতায় যেসব ব্যক্তির ওপর হামলা, লুটপাট, গণধর্ষণ করা হয়েছিল, তারা থানায় বা আদালতে অভিযোগ দায়ের পর্যন্ত করতে পারেননি। কেউ অভিযোগ করতে পারলেও রাজনৈতিক কারণে তদন্ত হয়নি। রাষ্ট্রীয় আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে সংখ্যালঘুর ওপর বর্বরোচিত নির্যাতন-সন্ত্রাস চালিয়েই ক্ষান্ত ছিলেন না সংশ্লিষ্টরা। জোট সরকারের আমলে হামলা সন্ত্রাস লুটতরাজসহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাবলিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়ে ৫ হাজার ৮৯০টি মামলা প্রত্যাহারও করা হয়। ফলে এসব মামলার ১২ হাজার অপরাধী শাস্তি ছাড়াই বীরদর্পে ঘুরে বেড়াতে থাকে। ২০০১ সাল থেকে শুরু করে যুদ্ধাপরাধ বিচারবিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত হামলার শিকার হয়েছেন সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়সহ পাহাড়ি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মানুষ।

আওয়ামী লীগ জয়লাভ করলেও তাদের ওপর হামলা ও নির্যাতন চলে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করলেও নেমে আসে নির্যাতনের বিভীষিকা। এটাই যেন তাদের নিয়তি। যুদ্ধাপরাধ বিচারে কাদের মোল্লার ফাঁসি হওয়ার পর জামায়াত শিবির নৃশংসতা চালিয়ে তাদের হত্যা করে, যেন তারাই ফাঁসি দিয়েছে। একাত্তর পরবর্তী অন্তত ১০ দফা হামলার শিকার গহিরার নির্মল চন্দ্র দাস। কক্সবাজারের রামুতে ১২টি বৌদ্ধ মন্দির, মঠ পুড়িয়ে দেয়, চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু জনগোষ্ঠী ও তাদের উপাসনালয়ের ওপর তাণ্ডব চালানো হয়। বান্দরবানে বৌদ্ধ মন্দির ও সংলগ্ন বৌদ্ধপল্লী হামলার শিকার হয়।

সংখ্যালঘুদের উপর হামলায় চট্টগ্রামের বাঁশখালীর বৃদ্ধ দয়াল হরি শীল, সিলেটের জগৎ জ্যোতি তালুকদার, মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার দাসের বাজার ইউনিয়নের সুশীল বিশ্বাস এবং নোয়াখালীর প্রকৌশলী সুমন ভৌমিক নিহত হন। এ ছাড়া মুন্সীগঞ্জ, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও গফরগাঁওয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলায় প্রায় ৪০০ নারী-পুরুষ আহত হয়।

বিএনপি জামায়াতের এই সব বর্বরোচিত নৃশংসতা তদন্তের জন্য হাই কোর্টের নির্দেশে একাধিক কমিশন গঠিত হয়। তদন্ত কমিশন ৫ হাজার ৫৭১টি অভিযোগ পায়। ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে ২০০২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাওয়া অভিযোগের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৬২৫টি। এর মধ্যে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ৩৫৫টি এবং লুটপাট, অগ্নি সংযোগ, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, গুরুতর আঘাত, চিরতরে পঙ্গু করা, সম্পত্তি দখল ও অন্যান্য গুরুতর অভিযোগ ৩ হাজার ২৭০টি। ধর্তব্য নয় উল্লেখ করে ১ হাজার ৯৪৬টি অভিযোগ বাতিল করারও ঘটনা ঘটে। তদন্ত করা ৩ হাজার ৬২৫টি ঘটনায় ১৮ হাজারেরও বেশি লোক জড়িত বলে চিহ্নিত হয়।

সংখ্যালঘু নির্যাতনের বাইরে রাষ্ট্রীয়ভাবে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, রাজশাহীতে বাংলা ভাই বাহিনীর মধ্যযুগীয় বর্বরতা, একসাথে ৬৪ জেলায় জঙ্গি বাহিনীর বোমা বিস্ফোরণ, দেশের মধ্যেই ১০ ট্রাক অস্ত্র খোদ সাবেক শিল্পমন্ত্রী নিজামী আর সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরের মাধ্যমে পাচারের চেষ্টা, পহেলা বৈশাখে বোমা হামলা, উদীচীর জনসভায় বোমা হামলা, তারেক রহমানের দোসর গিয়াস মামুনের নির্দেশে সাংসদ আহসানউল্লাহ মাস্টার খুন, সাবেক এমপি মোনাজাত উদ্দিনকে রাস্তায় কুপিয়ে হত্যা, বিচারকদের গাড়িতে বোমা হামলা করে দুজন বিচারক খুন, বিএনপি জামায়াতের এরকম শত শত কুকীর্তির রেকর্ড মনে পড়লে আজো অজানা শঙ্কা দেখা দেয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ দেশের প্রতিটি বিবেকবান মানুষের মনে।

কারণ কয়লা ধুলে যেমন ময়লা যায়না, বিএনপি জামায়াতের রাজনৈতিক চরিত্রের যে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়েছে, সেটা যে কেউই বিশ্বাস করতে পারছেন না!

ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাওয়াটাই তো স্বাভাবিক!

রাজেশ পাল, আইনজীবী, ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কর্মী

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ