আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

বুদ্ধিজীবীদের অসম্মান ও প্রাসঙ্গিক প্রতিশোধ

মাসকাওয়াথ আহসান  

একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতা অবশ্যই থাকতে হবে। নইলে রাষ্ট্রটিকে আধুনিক বা গণতান্ত্রিক কোন কিছুই বলা যাবে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘৭১-এর গণহত্যা অস্বীকার ছাড়া আর এমন কোন বিষয় নেই যা আলোচিত হতে পারে না বা যা অস্বীকার করা যাবে না।



বাংলাদেশের সংবিধান যেখানে মত প্রকাশের অধিকারের রক্ষাকবচ; সেখানে কোন বিষয়ে মত প্রকাশ কেউ কেউ করলে সেখানে উপ-মনুষ্যসমাজের ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে যাবার সুযোগ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বিশ্লেষক নোয়াম চমস্কি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্র ব্যবস্থার নিরন্তর সমালোচনা করেন। সে সমালোচনা অত্যন্ত কটু; এইতো কদিন আগেই তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সুবিধাবাদী। ডেমোক্র্যাট নেত্রী হিলারীকে তিনি উগ্র সুবিধাবাদী বলেছেন। এরকম অসংখ্য বাক্যবাণে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেন তিনি। আমি দীর্ঘদিন ধরে চমস্কির ফেসবুক পেইজটি অনুসরণ করি। আমি সেখানে কখনো যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন দলের কর্মীকে বা অতিজাতীয়তাবাদীকে ঐ পেজে এসে চমস্কিকে গালি দিতে দেখিনি।



কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য আমাদের দেশে এই ভিন্নমত গ্রহণ করার মত আলোকায়ন এবং সহিষ্ণু সংস্কৃতি তৈরী হয়নি। অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় একটি ভুল মন্তব্য করেছেন; এরকম প্রতিক্রিয়া জানানোতে; জয়ের অজ্ঞাতে তাকে খুশী করতে ও নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য অধ্যাপক জাফর ইকবালকে কী অনায়াসে চাবুক মারার কথা বলে ফেললো সিলেটের এক সরকার দলীয় সাংসদ। এ নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়েছে; কিন্তু ‘চাবুক মারার কথা বললে কিছু এসে যায়না’ এমন মনোভঙ্গীতে বিষয়টির কোন সুরাহা হয়নি। এর কিছুদিন আগে একাত্তরের ঘাতক গোলাম আজমের ছেলে ফেসবুকে জাফর ইকবালকে ‘শেইমলেস’ বলে গালি দেয়। এতেও কিছু এসে যায়না। বুদ্ধিজীবী খুব নরম জিনিস; যে পারো যেদিক থেকে এসে জিভের বা আসল চাপাতি মেরে যাও; এমন একটি জনপ্রিয় ধারণা সমাজ কিনে ফেলেছে।



একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির শীর্ষ নেতা শাহরিয়ার কবির ২০১২ সাল থেকে কয়েকবার পাকিস্তান সফর করে তিনি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির একটি শাখা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন জোরদা্রের চেষ্টা করছেন। ভারত এবং নেপালেও শাখা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনটির যোগসূত্র নির্মাণের চেষ্টা করছেন তিনি একইসঙ্গে। কারণ পুরো দক্ষিণ এশিয়ার কট্টরপন্থার উত্থানের বিপরীতে এরকম সম্মিলিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তোলা খুবই জরুরী।



শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কাজ করে কট্টরপন্থার হাত থেকে দেশকে বাঁচানো অসম্ভব। পাকিস্তান সফরকালে শাহরিয়ার কবিরের নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রগুলো প্রদর্শিত হয়েছে। পাকিস্তানেও নতুন প্রামাণ্যচিত্রের জন্য বেশ কিছু সাক্ষাতকার গ্রহণ করেছেন তিনি। পাকিস্তানের নাগরিক সমাজকে সংগঠিত করে অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে জনমত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন তিনি। উনার নির্মিতব্য প্রামাণ্যচিত্রগুলোতে পাকিস্তানের নাগরিক সমাজের শীর্ষ ব্যক্তিরা সাক্ষাতকার দিয়েছেন। এ অত্যন্ত কষ্টসাধ্য কাজ; যেটি শাহরিয়ার কবির দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ঘুরে করার চেষ্টা করছেন।



ফেসবুকে একজন বিএনপি কর্মীকে দেখলাম, করাচীর একটি রেষ্টুরেন্টে উনার চা খাওয়ার ছবি আপলোড করে তাকে নিয়ে যা-তা ভাষায় কথা বলছে। ঐ পোস্টে জামাতের লোকেরা এসেও গালিগালাজের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে শাহরিয়ার কবির প্রো-পাকিস্তান হয়ে গেছেন। এরা যেটা বুঝতে পারেনা তা হলো; এরা পাকিস্তানে যায় জঙ্গীবাদের প্রশিক্ষণ নিতে; আর শাহরিয়ার কবির সেখানে যান জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে; জঙ্গীবাদের ভাইরাস প্রতিষেধক প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শনে। কাজটি তিনি নেপাল-ভারতেও করেন নিয়মিত। কিন্তু এই যে চিন্তার জগতে খর্ব মানুষগুলো এরা সুযোগ পেলেই বুদ্ধিজীবীদের গালাগাল করে। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের পশ্চাদপদ সমাজের ছবিই তুলে ধরে।



আমাদের সমাজ এখন অশ্লীল মাস্তানমুখী। যেহেতু মাস্তানেরা পড়ালেখা শেখেনি; বা কিছু সার্টিফিকেট থাকলেও শিক্ষার আলো ভেতরে ঢোকেনি, চট করে এরা শিক্ষিত ও সৃজনশীল মানুষদের গালি দিয়ে বসে। কারণ বুদ্ধিজীবী মানেই যেন নরম-অমেরুদন্ডী-পুতুপুতু তাকে যা খুশী বলা যায়। এই চিন্তার স্টেরিওটাইপ থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে সমাজ ক্রমশঃ শিক্ষিত ও সৃজনশীল মানুষ জন্ম দেয়া বন্ধ করে দেবে। বোধহীনতার ঊষর মরুর চোরাবালিতে হারিয়ে যাবে বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্ভাবনা।



বুদ্ধিজীবীরা এসব অপমানের প্রতিশোধ নিতে নিশ্চয়ই মাস্তানদের মত রিভলবার ব্যবহার করবে না। কিন্তু তারা যেটা পারবে; এইসব গালিবাজ উপমানবদের কীবোর্ড দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারতে। মাস্তান বা জঙ্গীরা রিভলবার বা চাপাতি দিয়ে যে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে; সে সব মৃত্যুদৃশ্য হারিয়ে যায় বিস্মৃতিতে। কিন্তু কী-বোর্ড দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মাস্তান বা জঙ্গীদের যেসব হত্যাদৃশ্য উপন্যাসে-গল্পে-স্যাটায়ারে-প্রবন্ধে-ক্যারিকেচারে-চলচ্চিত্রে তুলে ধরা হয়; সে প্রতিশোধের দৃশ্যগুলো পৃথিবীর ইতিহাসে রয়ে যায় এবং যাবে।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ