আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

রাজনীতিবিদদের প্রতিশোধ স্পৃহা ও কাউন্সেলিং

মাসকাওয়াথ আহসান  

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি যে প্রতিশোধ স্পৃহা লক্ষ্য করা যায় এটা অত্যন্ত আদিম গোত্রদ্বন্দ্ব প্রকৃতির। শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক দৈন্যের কারণে এই হিংস্রতার উপশম হওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।

নব্বইয়ের পরে কেবলমাত্র উভয়দলের শীর্ষ নেতাদের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক মানের ভিত্তিতে নেতা-কর্মী তৈরি হওয়ায়; অহিংসা-সহিষ্ণুতা-সংলাপ-সুরুচি-পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের মতো বিষয়গুলো দলীয় সংস্কৃতিতে চর্চিত হতে পারেনি। ফলে দলগুলো বিকশিত হয়েছে নিম্নমানের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বোধের অস্থিধারণ করে। বাংলাদেশের গড় শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক মানের নীচে অবস্থান করছে এই দলদুটি। কারণ বাংলাদেশের নানা জায়গায় নানা মত ও পথের মানুষ বসবাস ও মেলামেশা করে। ভিন্নমত জীবনের সৌন্দর্য এটি মেনে নিয়েই এই সম্পর্কগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয়।

মানুষ সামাজিক জীব এই মৌলিক জ্ঞানটি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরের বাকি মানুষের রয়েছে। আওয়ামী লীগ আর বিএনপির মনোজগৎ "পীর-সাহেবের সঙ্গে সব ব্যাপারে একমত পোষণের" অত্যন্ত প্রাচীন বৃত্তে মাথা ঠুকে চলেছে। তাদের সঙ্গে ইঞ্চি ইঞ্চি মিলিয়ে ১৬ কোটি মানুষ 'সহমত' পোষণ করবে; এই ভুল আর একগুঁয়ে চিন্তা নিয়ে দলদুটি রয়ে গেছে বিজন মধ্যযুগে।

ফলে কেবল সহমত পোষণ করবে কোন ভিন্নমত নয়; এই যোগ্যতার ভিত্তিতে নেতা-কর্মী খুঁজতে গিয়ে; দুটি প্রায় চিন্তার জগতে বনসাই গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। দলদুটি যে তরুণদের দলে যুক্ত করেছে; তাদের জীবন বিকাশের দিকে কোন মনোযোগ দেয়নি। নেতারা নিজেদের ছেলেমেয়েদের দেশ-বিদেশের ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়িয়ে তাদের পরিবারতন্ত্রের পীরালী পরিচালনা ও গদিনশীন হবার মতো করে তৈরি করেছে। কিন্তু অন্যের যে সন্তানদের ফুসলিয়ে দলে নিয়েছে, তাদের শিক্ষা-পেশাগত দক্ষতা অর্জনের দিকে বিন্দুমাত্র নজর দেয়নি। এরাও তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ জমিদারির লেঠেল হবে; ফলে বেশি যোগ্যতা অর্জনের প্রয়োজন নেই; এই চিন্তায় তাদের ছেড়ে রেখেছে, যা করে খা। এই করে খাওয়া হচ্ছে পার্টির পেশি দেখিয়ে চাঁদা তুলে খাওয়া আর তৃতীয় শ্রেণির ঠিকাদার হয়ে টেন্ডার সন্ত্রাস। অথচ এই তরুণদের প্রত্যেকের মাঝে বিকাশের সম্ভাবনা ছিলো; যে সুযোগ তারা পায়নি দ্বিদলীয় গ্যাং কালচারের ধারাবাহিক প্রতিশোধ-প্রতিহিংসার শেকলে জড়িয়ে গিয়ে।

আবার দীর্ঘদিন ধরে চোখের বদলে চোখ-সন্তানের বদলে সন্তানের লাশ প্রকৃতির ক্রোধ ও হিংস্রতার চর্চায় মানসিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়েছে এই দুটি গোত্র।

সংলাপের মাধ্যমে এটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন; এদের এই প্রাণঘাতী প্রতিশোধ খেলা বন্ধ রাখবে উভয় পক্ষ।

এইসব প্রতিশোধমূলক হত্যা-নির্যাতনে মানসিক পীড়নের মাঝ দিয়ে যাওয়াতে মানসিক স্থিতি ও ভারসাম্য হারিয়েছে অনেক নেতাই। কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে তাদের মানসিক সুস্থতা ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত জরুরি।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদেরকে অনুধাবন করতে হবে; এই দক্ষিণ এশিয়া অন্য সব দেশে প্রতিশোধ-প্রতিহিংসার রাজনীতির পরিবর্তে সংলাপ ও জনগণের রায়ের প্রতি আস্থার আধুনিক রাজনীতির প্রচলন হয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর চেয়ে এগিয়ে গেছে। কিন্তু পিছিয়ে পড়েছে রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচকে। এ অবস্থার উত্তরণ জরুরি। প্রয়োজন সভ্যতার রাজনীতিতে পদার্পণ। অবশ্য ব্যতিক্রমী রাজনীতিক দুটি দলেই রয়েছেন। কিন্তু প্রতিশোধের উত্তাপে তাদের বোধের উষ্ণতা আদৃত ও অনুসৃত নয় দলীয় সংস্কৃতিতে।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে দল দুটির ভি আইপি সংস্কৃতি আঁকড়ে ধরে পুরোনো চিন্তার ঘেরাটোপে বন্দি থেকে যাওয়া। রাজনীতিকরা হচ্ছেন জনসেবক; কাজেই জনগণের সামনে ভি আই পি হিসেবে আবির্ভূত হওয়া একেবারেই সমসাময়িক নয়। ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলংকার মতো দেশে এই ভি আই পি কালচার প্রায় বিদায়ের পথে। দেশগুলোর নাগরিক সমাজ রাজনীতিকদের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়না। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী ও সামরিক কর্মচারীদেরকেও বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, তারা সেবক; শাসক নয়।

বাংলাদেশের মানুষ সতত নদী মানুষ-গানের মানুষ-মিস্টিক কোমলতার মানুষ হওয়ায় আর "পীর প্রথা"র- শেকড় সমাজের গভীরে থাকায় "ভি আইপি কালচার"কে নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছে যেন। একারণেই বিজন গ্রামের ছেলেটি রাজনীতি-সরকারি চাকরিকেই সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সামর্থ্য অর্জন এবং অবশেষে ভি আইপি হবার একমাত্র পথ বলে মনে করে। এই মধ্যযুগীয় ভ্রান্ত স্বপ্নের কারাগার থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মুক্তি দিতে নাগরিক সমাজকে সক্রিয় হতে হবে নাগরিক সমাজকে। রাজনীতিক ও সরকারি চাকুরেদের প্রয়োজনের অধিক সম্মান ও মর্যাদা লাভের আকাঙ্ক্ষাকে না বলতে হবে।

রাজনৈতিক দলদুটির প্রতিশোধের খেলা বন্ধে তাদেরকে বাধ্য করতে হবে। তাদেরকে মনে করিয়ে দিতে হবে, কেবল "রাজনীতির ছক্কা-পাঞ্জা" একটি জাতির জীবনের প্রধান বিষয় নয়। প্রধান বিষয়; দেশটিকে সাধারণ মানুষের জন্য নির্ভয়ে বসবাসের উপযোগী করা; শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুশিক্ষা , হাসপাতালে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা; বৈষম্যহীন কর্মসংস্থান; সর্বোপরি আইনের শাসন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা।

রাজনীতি আর এর লেজুড়বৃত্তি করে দুর্নীতির যে বুলবুলি আখড়ায় দশকের পর দশক চলেছে; এটা আর চলতে পারে না। পাড়ার পার্টি অফিসে বা সরকারি অফিসে গোল হয়ে বসে থাকা লুণ্ঠক মাস্তানতন্ত্র আর এভাবে চলতে পারে না। তাই আসন্ন নির্বাচনে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর এসব বিষয়ে ইতিবাচক সংস্কারের অঙ্গীকার প্রত্যাশা করি। এরপর যেহেতু জনগণের এখতিয়ার; তাই তারাই সিদ্ধান্ত নিক; আগামি পাঁচ বছরের জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার চাকরি তারা কাকে দিতে চায়।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ