আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

হাসিনা- এ ডটার’স টেল: প্রতিহিংসাহীন পরিমিতিবোধের স্মারক

ড. কাবেরী গায়েন  

Hasina: A daughter's tale দেখলাম। সত্যি বলতে কী আমি একটু ভয়ে ভয়েই গিয়েছিলাম। নির্বাচনের আগে আগে মুক্তি পাওয়া তথ্যনাট্য (ডকুড্রামার বাংলা করার চেষ্টা), তাও প্রধানমন্ত্রীর নামে, প্রোপাগান্ডা ধরণের হবে এমন ধারণাই ছিলো। কিন্তু ছবি দেখা শেষে খুব অবাক হয়েছি পরিমিতিবোধ দেখে। বাংলাদেশের কোন চলচ্চিত্রে, বিশেষত সরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে নির্মিত, এই পরিমিতিবোধ আমাকে সানন্দ বিস্ময় যুগিয়েছে।

সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে তাঁর বেঁচে থাকা দুই মেয়ের জীবনের কাহিনী। রাজনীতি এসেছে তো বটেই, তবে একেবারেই উচ্চকিত নয়। ১৫ আগস্ট আর ২১ আগস্টের ঘটনা প্রাধান্য পেয়েছে। ১৫ আগস্টের পরে বঙ্গবন্ধু কন্যা হাসিনার আজকের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠবার কাহিনী এই তথ্যনাট্য।

নির্মাণের দিক থেকে দেখতে গেলে সিনেমাটোগ্রাফি অসাধারণ। টুঙ্গিপাড়ার শ্রাবণকে ধরা হয়েছে অসম্ভব মমতায়। মধুমতি নদীর কিনার ঘেঁষে বর্ষার রূপ, পাটক্ষেত, কচুরিপানার ব্যবহার ছিলো খুব নান্দনিক। বাংলার রূপ দেখা গেল ফের। আবার ব্রাসেলস থেকে যখন তাঁদের বের করে দেয়া হল, তখন একটা পথ দেখে বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠেছে। পেছনে ফেলে আসার ঠিক আগে আগে পাতায় রঙ ধরা ভ্যালি, সামনে একমুখী এক পথ, সেখানে একটা মাত্র গাড়ি। নিউ ইংল্যান্ডের হেমন্তে একাকী বসবাস করার সুবাদে ঠিক এমন একটা পথের হদিস আমার বুকের ভেতরেও আছে। আমার এক বন্ধু বলছিলেন আলো তাঁর কাছে কম মনে হয়েছে। আমার কিন্তু এই খানিক অনুজ্জ্বল আলোর ব্যবহারটা থিম অনুযায়ী যথার্থ মনে হয়েছে।
আরও এক দৃশ্যের নির্মাণের কথা না বললেই নয়। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনের বর্ণনা দিচ্ছেন তাঁর দুই মেয়ে। বঙ্গবন্ধু ঘরে ঢুকে তাঁর সব সন্তানকে আদর করে স্ত্রীকে আলিঙ্গন করার কথা যখন বলছেন শেখ রেহানা, কথাটা অনেকটা এমন যে তাঁদের মা তাঁদের বাবাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছেন যে মনে হয়েছে জীবনের যত চাওয়া তাঁদের মায়ের, সব তিনি পেয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনে। এই বর্ণনার সময় একটা অস্পষ্ট ছবি পর্দাজুড়ে। অসাধারণ এই দৃশ্যটি নির্মাণে শুধু চলচ্চিত্রকার হলে বুঝি হয় না, পেইন্টিংটা বুঝতে হয়, একটা কল্পনা থাকতে হয়। আরও দরকার সম্পাদনাজ্ঞান। সবটাই ছিলো সেখানে।

এই কাহিনীর প্রটাগনিস্ট অবশ্যই শেখ হাসিনা। তবে শুরুর দিকে বঙ্গবন্ধু যখন বিদেশী সাংবাদিককে তাঁর বাড়িতে কীভাবে ২৫ মার্চের রাত সংঘটিত হয়েছিলো, কীভাবে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো, এইসব বর্ণনা করছিলেন, তখন সেই ফুটেজে বঙ্গবন্ধু যেনো কেমন আমাদের সাধারণ বাঙালিকে ছাড়িয়ে এমন এক উচ্চতায় দাঁড়িয়ে যান যে পরিপার্শ্বের আর সব তাঁর কাছে ম্লান হয়ে যায়। বেশ কিছু ফুটেজের ব্যবহার আছে, যা এর আগে দেখিনি।

পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে দুই বোনের জীবন যখন এতো বছর পরে তাঁদের মুখেই আমরা শুনি, তখন সেই জীবনের সাথে সাথে বেশ কিছু দেশী-আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক তথ্যও আমরা জানতে পারি। তবে সেসব তথ্য আমাদের ভারাক্রান্ত করে না। কোন প্রতিহিংসার আক্রোশ ছিলো না এই তথ্যনাট্যে। বরং দুই মেয়ের খুব সরল স্মরণের কাহিনী হয়ে উঠেছে। এমনকি খুনিদের ব্যাপারে একবার তাদের সবার ছবি দেখানো হয় তাদের পুনর্বাসিত অবস্থানের সাথে, ওই পর্যন্তই। আর শেখ হাসিনার মুখে একবার শুনি মোশতাক আহমেদের কথা যেখানে জানতে পারি বঙ্গবন্ধু তাকে বিশ্বাস করতেন না। দু'বার জিয়াউর রহমানের নাম এসেছে। কিন্তু খুব স্বাভাবিকভাবে। এই ক্রোধহীন আত্মস্থ বয়ানের জন্য বিপুল ম্যাচুরিটি এই দুই বোনকে অর্জন করতে হয়েছে সন্দেহ নেই।

তবে শেখ হাসিনার মুখ থেকে এই প্রসঙ্গ অবতারণার বাক্যটি শুরু হয়েছে এভাবে, 'তাজউদ্দিন চাচা চলে গেলেন (ইংরেজি সাব-টাইটেলে উঠছে Tajuddin left...)...'. খুব সাধারণ একটি বাক্য, তবে কানে লাগলো। তাজউদ্দিনকে পদত্যাগ করতেই তো বলা হয়েছিলো। তিনি নিজে ছেড়ে যাননি মর্মেই পড়েছি এতকাল। একটা বাক্যের প্রথম তিন শব্দ মাত্র। ছেড়ে দেয়া যায়।

এই তথ্যনাট্যের এক বাড়তি পাওনা হল বঙ্গবন্ধুর জীবনের বেশ কিছু দুর্লভ ফুটেজ এবং তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কিছু তথ্য। যেমন তাঁর দাম্পত্য জীবন। বেগম মুজিবের দৃঢ় চরিত্র। রামপ্রসাদী গান 'আমার সাধ না মিটিলো, আশা না পুরিলো'র দুর্দান্ত ব্যবহার, পারিবারিক অ্যালবাম দেখানোর সময় 'পুরানো সেই দিনের কথা' গানের খুব মৃদু ব্যবহার এই তথ্যনাট্যের টেকচারকে স্তর দিয়েছে।

কিছু অসম্পূর্ণতার কথাও বলা যায় বোধহয়। হঠাৎ-ই যেনো শেষ হয়ে গেল। অবশ্য আমি পরিচালককে দোষ দেই না। আমার মাথার ভেতরেই হয়তো অন্যরকমের ধারণা ছিলো। তবুও মনে হয়, বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনের রাজনীতিটা বোধহয় আরেকটু মনোযোগের সাথে মোকাবেলা করার দরকার ছিলো। যাঁরা জানেন না, তাঁদের কারো কারো মনে হতেও পারে যে, এই হত্যাকাণ্ড বুঝি শুধু মোশতাকসহ কিছু সামরিক সদস্যের কাজ।

যা দেখেছি, যতোটুকু পেলাম, সেজন্যই পরিচালক এবং সিআরআই টিমকে অভিনন্দন। তাঁরা প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর বোনের মুখ থেকেই তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছেন। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু ছবির পরিচালক এবং প্রচারণা টিমের অনেক উঁচু দাবির মুখে ছবি দেখতে গিয়ে হতাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে। মনে হয়েছে, সিনেমার ভাষা তাঁদের আয়ত্তে আসেনি। সেই খেদ মিটেছে এই ছবি দেখে। পরিচালকের সম্ভবত প্রথম ছবি। কিন্তু নির্মাণশৈলী আন্তর্জাতিক মানের। দর্শকরা হলে গিয়ে দেখছেন।

রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে যে কেউ এই ছবি দেখতে পারেন। আমাদের দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক বড় পর্ব নিয়ে বানানো এই ছবিটি যে প্রতিহিংসাহীন পরিমিতিবোধের স্বাক্ষর রেখেছে, সেখান থেকে আশাবাদী হতে ইচ্ছে করে যে এই পরিমিতি আমাদের জাতীয় রাজনীতিতেও ব্যাপ্ত হোক।

পরিচালক, সম্পাদক এবং সংগীত পরিচালককে বিশেষভাবে থ্রি চিয়ার্স!

ড. কাবেরী গায়েন, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ