প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ২৯ নভেম্বর, ২০১৮
কেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিকৃষ্ট; সে প্রশ্নের উত্তর আসন্ন নির্বাচনে মারণঘাতি ইয়াবা ব্যবসার অভিযোগে ইমেজ সংকটের কারণে বদির বদলে বদির স্ত্রী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন লাভ; আর একুশে অগাস্ট গ্রেনেড হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বাবরের বদলে বাবরের স্ত্রী বিএনপির মনোনয়ন পাওয়ার সাম্প্রতিকতম দৃষ্টান্তে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পরিবারতন্ত্রের এই মিনিয়েচার উদাহরণে বদির স্ত্রী ও বাবরের স্ত্রী বাংলাদেশ রাজনীতির উপায়হীনতার প্রতীক।
পুরো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো সভ্যতায় পিছিয়ে পড়ার পেছনে কয়েকটি পরিবারের মাজার ভিত্তিক রাজনীতি সবচেয়ে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। ভারতে নেহেরু পরিবার; পাকিস্তানে ভুট্টো পরিবার, নওয়াজ শরিফ পরিবার এবং বাংলাদেশে শেখ পরিবার ও জিয়া পরিবার এই দেশগুলোকে পঙ্গু করে দিয়েছে। সর্বময় কর্তৃত্ব এক একটি পরিবারের হাতের মুঠোয় রেখে দেবার আদিম ও গ্রামীণ প্রবণতা ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিকে রেখে দিয়েছে ভিলেজ পলিটিক্সের মাতবরের ভিটায়।
ভারতে নির্বাচন কমিশন ও বিচার বিভাগের মতো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সার্বভৌম হওয়ায়; এই মাতবরের ভিটা থেকে গণতন্ত্রকে উদ্ধার করে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা গেছে। ভারতের নাগরিক সমাজের সতত সক্রিয়তা ও শিক্ষা বিকাশ থেকে অর্জিত মেরুদণ্ড; আধুনিক রাষ্ট্রের স্বপ্নটিকে জাগিয়ে রেখেছে। ভারতের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেউ-ভেউ ক্ষমতাসীন বন্দনার সুযোগ সীমিত। তীব্র নাগরিক সমালোচনার মুখে ক্ষমতাসীন সরকার।
ভারতের নাগরিক সমাজকে অনুসরণ করে; পাকিস্তানের নাগরিক সমাজ পরিবারতন্ত্র ও ভিআইপিতন্ত্র উচ্ছেদে খানিকটা সক্ষম হয়েছে। ভুট্টো পরিবার ও নওয়াজ শরিফ পরিবারের মাতবরি উঠোন থেকে মুক্তি পেয়ে পাকিস্তানের মতো ভঙুর গণতন্ত্রের দেশটিও আধুনিক রাষ্ট্রের স্বপ্নটুকু বাঁচিয়ে রেখেছে। পাকিস্তানের সামাজিক মাধ্যমে ভেউ-ভেউ সরকার বন্দনার সুযোগ সঙ্কুচিত। প্রতিদিন নাগরিকদের সমালোচনার মুখে কোণঠাসা ক্ষমতাসীন সরকার।
কিন্তু বাংলাদেশে শেখ পরিবার ও জিয়া পরিবারের মাতবরি উঠোনে আটকে গেছে আধুনিক রাষ্ট্র বিকাশের সমুদয় সম্ভাবনা। যে পরিবারই যখন ক্ষমতায় এসেছে; জোর করে ক্ষমতা আঁকড়ে পড়ে থাকতে চেষ্টা করেছে। সেই ধারাবাহিকতায় শেখ পরিবার গত দশটি বছর ক্ষমতা আঁকড়ে পড়ে আছে। আর এই ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে গণতন্ত্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে মাতবর বাড়ির আজ্ঞাবহ করে রেখেছে। একটা গ্রামে ঠিক যেমনটা ঘটে; মাতবরের কথায় সূর্য ওঠে-সূর্য অস্ত যায়; বাংলাদেশ ঠিক তেমনি এক মধ্যযুগীয় গ্রামে রূপান্তরিত হয়েছে। আধুনিক রাষ্ট্রের স্বপ্নের মৃত্যু ঘটেছে। স্বপ্ন না থাকলে যা হয়; জীবন্মৃত অবস্থায় রয়েছে নাগরিক সমাজ।
বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল অংশ সরকার বন্দনায় আলুথালু। আরেকটি অংশ বিরোধী দল বন্দনায় দিশেহারা। বদির স্ত্রীর মনোনয়ন জাস্টিফাই করা আর বাবরের স্ত্রীর মনোনয়ন জাস্টিফাই করার ফাঁকে ফাঁকে; মাতবরের ভিটা আঁকড়ে পড়ে থাকার এই যে অমেরুদণ্ডী উঞ্ছজীবন; এ-ও আবার বেঁচে থাকা!
দুটি পরিবারের রাজনীতির দোকানে অতীতে খানিকটা শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ থাকায় বদি-বাবরের নিয়মিত ঘরানার বাইরে কিছু যোগ্য লোক যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু দুটি পরিবারের শিক্ষা-সংস্কৃতির গজফিতাটি ক্রমশ ছোট হতে থাকায়; যোগ্য লোকেদের গলাধাক্কা জুটে যায় দুটি মাতবর বাড়ির উঠোন থেকে। স্যাঁতসেঁতে গ্রাম্য মাতবর সংস্কৃতিতে কপালে নানারকম "তকমা"-র ছ্যাঁকা আর খাদেমদের অশ্লীলতম কটূক্তি; হামলা; পোষা মানিকদের লেলিয়ে দেয়ার যে চল; সেখানে এক মাতবর বাড়ি থেকে আরেক মাতবর বাড়িতে যাওয়া বা উঠোন বদল অনেকটা 'ধর্মান্তরিত' হবার মতো ব্লাসফেমাস অপরাধ যেন।
বাংলাদেশের এই লোকজ রাজনৈতিক সংস্কৃতিটি অনেকটা ধর্মের রূপ নিয়েছে যেন। দুটি মাতবর মানে দুটি ধর্ম আর দুটি ঈশ্বর। প্রায় অপসৃয়মাণ নাগরিক সমাজ গ্রেনেড হামলা কিংবা গুমের ভয়ে প্রায় যেন ঘরের মধ্যে সিটিয়ে গেছে।
এই "মাতবরানুভূতি"-র জগতে দুটি মাতবর বাড়ির খাদেমদের দৃঢ় বিশ্বাস; মানুষ মানেই দুই মাতবর ঈশ্বরের একটির "খাদেম" হতে হবে। প্রায় উপমানব খাদেমেরা তাই উপযাচক হয়ে সামাজিক পুলিশি করার সময়, জনে জনে জিজ্ঞাসা করে বেড়ায়, আপনার অবস্থান স্পষ্ট করুন; আপনি কোন ঈশ্বরের ভিটায় সালাম ঠুকবেন। বেছে নিন বদির স্ত্রী অথবা বাবরের স্ত্রী।
এইরকম হীন সংস্কৃতি কোন আধুনিক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হতে পারে না। এই ভীতিপ্রদ জীবন্মৃত অবস্থায় কোন আশা জাগানিয়া ভবিষ্যতের দিশা নেই। এখানে উল্লেখ্য যে দুটি পরিবারের শাসনামলে যে ধারাবাহিক বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে; তা নজিরবিহীন মানবতা বিরোধী অপরাধ। ক্ষমতাসীন "মাতবরানুভূতি"-তে আঘাতের কথিত অভিযোগে পুলিশি রাষ্ট্রের কালো-পেশি যেভাবে একের পর এক নাগরিককে তুলে নিয়ে যায়; এটা মধ্যযুগীয় বর্বরতার দাম্ভিক অনুশীলন।
গত পাঁচবছর ধরে ভোটহীন সরকার চালিয়ে যাওয়ার পরেও; ক্ষমতাসীনের কোন বিকার নেই; আত্মগ্লানির বোধ নেই। ছলে-বলে-কৌশলে ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া ক্ষমতাসীন সরকার। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে একটিও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। গণতন্ত্রের জন্য মানসিকভাবে অপ্রস্তুত এই পরিবারতন্ত্র ছিনিয়ে নিয়েছে জনগণের ভোটাধিকার। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়; এ আঁধার থেকে ফেরার পথ নেই; এ এক আত্মঘাতি গোলকধাঁধা।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য