প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
আলমগীর শাহরিয়ার | ০২ ডিসেম্বর, ২০১৮
আশির দশকে বিটিভির এক অনুষ্ঠানে জনপ্রিয় উপস্থাপক আবু হেনা মোস্তফা কামাল একটা গল্প বলেছিলেন। ইউরোপে ক্লাসিক যুগে পিএইচডি ডিগ্রির ধুম লেগেছিল। প্যারিসের রাস্তায় এক লোক দেখলো ফেরিওয়ালা মাথায় ঝাঁকা নিয়ে কিছু একটা বিক্রির চেষ্টা করছে। লোকটা ঘোড়া ছুটিয়ে সেদিকে গেল। দেখলো, ফেরিওয়ালার ঝাঁকায় বড় বড় বইয়ের মতো কিছু। সে জিজ্ঞেস করলো, 'এগুলো কী?'
: এগুলো থিসিস।
: কী কাজে লাগে ?
: এগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিলে ড. হওয়া যায়।
লোকটা আগ্রহী হলো, 'দাম কত?'
: প্রতিটা থিসিস ২৫ ফ্রাঁ।
লোকটা সস্তায় পেয়ে একটা কিনলো। ভাবলো, মাত্র ২৫ ফ্রাঁয় ড. হলাম। আমার ঘোড়ার জন্য একটা কিনি না কেন? আবার ফিরে এলো, ভাই আমাকে আরেকটি দিন।
: কার জন্য?
লোকটি বললো, 'আমার ঘোড়ার জন্য। ড.-এর ঘোড়া হবে ড. ...।'
ফেরিওয়ালার সোজাসাপ্টা জবাব, 'এগুলো গাধার জন্য, ঘোড়ার জন্য না।'
আজকাল যত্রতত্র, যেনতেন পিএচডির ছড়াছড়ি দেখলে সেই কবেকার কৌতুকটা এখনও খুব প্রাসঙ্গিক বলেই মনে হয়। শুনেছি আমাদের নীলক্ষেতেও এমন অনেক থিসিস বিক্রি হয়। অনেকে নিজের জন্য কিনেন, ঘরের গিন্নির জন্যও ডিগ্রি কিনেন। নীলক্ষেত দিয়ে কত বছর ধরে হাঁটছি কিন্তু দুঃখ একখানা আজো কিনতে পারলাম না। তবুও ভাবছি ড. আলমগীর শাহরিয়ার লিখলে কেমন লাগত। খুব কুৎসিত, কদাকার, বেমানান? প্রচার প্রচারণার উদ্দেশ্যে বাড়ির মোটা নেমপ্লেটে ড. আলমগীর নাম দেখে নাড়ীপোতা গ্রামসহ আশেপাশের অনেকেই হয়ত ভাবত আমি আবার ডাক্তার হলাম কবে। বাড়ি গেলে দু'একজন না বুঝে সঙ্কটাপন্ন রোগী নিয়ে চলে আসলে চরম বিপাকে পড়া ছাড়া কিছু করার ছিল না। যেমন ছোটবেলা ভীষণ নিষ্ঠাবান ধার্মিক হিসেবে মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তাম সামনের কাতারে (আসলে শুক্রবার ছাড়া মসজিদে নামাজে তখন এক কাতারের বেশি মুসল্লি হত না, এখনও হয়না) এবং তা দেখে গ্রামের অনেকেই ভাবত আমি নিশ্চয়ই মাদ্রাসায় পড়ি। ফলে ইমামের অনুপস্থিতিতে অনেকবারই আমাকে সামনে ঠেলে দেওয়া হত ইমামতির দায়িত্ব পালন করতে। এক নাদান ছোকরা হিসেবে উপস্থিত অনেক বয়স্ক মুসল্লিদের ইমামের দায়িত্ব পালনের যুগপৎ শঙ্কা, বিপদ ও আনন্দ লাভ করেছি। কেঁদেকেটে আল্লাহর দরগায় নিজ গুনাহখাতাসহ জিন্দা-মুর্দা সকলের জন্য মাফ চেয়েছি। তখন পর্যন্ত শ্বশুরশাশুড়ি কেউ হননি। তাই তাদের জন্য দোয়া করতে পারিনি। মনে পড়ে, মাদ্রাসায় না পড়েও সেসব দৈবদুর্বিপাক থেকে সফলতার সহিত নিজেকে উদ্ধার করেছি।
যা হোক তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে(comparative religious studies) জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করা সৈয়দ মুজতবা আলীকে তাঁর এগারো খণ্ডের রচনায় কোথাও ড. আলী লিখে নিজেকে জাহির করতে দেখিনি। সহৃদয় পাঠক, কোথাকার কোন বনের ডিগ্রি মুজতবা আলী লোকালয়ে নিয়ে আসেননি বলে কেউ আবার ভুল বুঝবেন না। আমাদের কালের তুমুল নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদকে কখনো নামের আগে ড. লিখতে দেখিনি। তিনি তাঁর লেখক সত্ত্বার সর্বত্র দুই শব্দের নামই লিখেছেন- হুমায়ুন আহমেদ। ও হ্যাঁ, এক জায়গায় তাঁর নামের আগে ড. লেখা দেখে বেশ অবাক হয়েছিলাম। অনেকেই দেখেছেন সেন্টমার্টিন দ্বীপে উনার একটা বাড়ি আছে "সমুদ্রবিলাস।" ওইখানে। সে বাড়ির নাম ফলকে লেখা দেখলাম ড. হুমায়ূন আহমেদ। যা হোক, নামের আগে ড. লিখতে দেখিনি মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারকেও। নব্বই দশকের কবি সেতু ভাইও (জফির সেতু) অনেক খাটাখাটুনি করে একখান পিএইচডি করেছেন। কিন্তু তাকেও লিখতে দেখিনা।
কিন্তু ভীষণ উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে অনেকেই লিখেন। যেমন লিখেন সিলেটের আলোচিত দানবীর রাগীব আলী। শুনেছি চা-এর উপর গবেষণা করে আমেরিকার এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি শেষ জীবনে প্রেমের মত এই পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন।
নামের আগে ড. লিখেন জনৈক টিভির মালিক। যার ভুবনমোহিনী সুরে বাংলার আকাশ বাতাস আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রায়ই কেঁপে উঠে! বেশ কিছুকাল আগে কাগজে একখানা প্রতিবেদনে পড়েছিলাম। এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় শ' তিনেকের বেশি পিএইচডি নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করেছে(ভুল বুঝবেন না, নামমাত্র মূল্য মানে নেহাত কম নয় ভায়া)। যারা কিনেছেন তাদের মধ্যে আছেন ব্যবসায়ী কাম রাজনীতিবিদ(আগামীদিনের সংসদ সদস্য), সরকারি-বেসরকারি-কর্পোরেট, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের অনেক গুণীজনেরা---যাদের ডিগ্রির সঙ্গে জীবন ও প্রমোশন নামক ব্যাপার-স্যাপার ওতপ্রোত বা ভাগ্যবিধাতা হিসেবে জড়িত। তিনশর তালিকায় আরও ছিলেন বিভিন্ন স্পর্শকাতর পেশার পদ অলংকৃত করা জাঁদরেলেরা। নাম বলছি না। নাম বললে নাকি আজকাল আর চাকরি থাকে না। চাকরি মানে কী বিজ্ঞজন মাত্রই বুঝেন। এরা সবাই নিশ্চয় সগৌরবে ড. লিখেন।
যা হোক, পাঠক আপনি ঠিকই ধরেছেন। এত গৌরচন্দ্রিকার কারণ আমারও খুব শখ ছিল একখানা পিএইচডি করার, রাতের অন্ধকারে দক্ষ সিঁধেল চোরের চৌর্যবৃত্তি পরিহার করে। যোগ্যতা নেই বলে বুঝি আর হলো না। নিজেকে শুধাই দুঃখ করো না বাহে, বাঁচো। পিএইচডিহীন জীবন রবীন্দ্রনাথেরও ছিল, নজরুলের ছিল, আমাদের রেড মওলানা, বঙ্গবন্ধুরও ছিল। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ পিএইচডি করেছিলেন বলে কস্মিনকালেও কোনো মুগিসউদ্দীন উজবুক দাবি করেননি।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য