আজ বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

অরিত্রির চলে যাওয়ায় আমরা জেগেছি

দেবজ্যোতি দেবু  

অরিত্রি, খুব সুন্দর নাম। নবম শ্রেণিতে পড়তো। নামের মত তার ভবিষ্যৎটাও সুন্দর হতে পারতো। কিন্তু সেটা আমরা হতে দেইনি। খুন করেছি তাকে। আমাদের মানসিকতা, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, আমাদের সার্টিফিকেটের প্রতি উন্মাদনা খুন করেছে তাকে। তাই এই খুনের দায় আমাদের সকলের। আমরা সবাই তার অপরাধী।

অরিত্রি ভিকারুননিসাতে পড়তো। রেজাল্টের দিক থেকে এটি বাংলাদেশের অন্যতম সেরা স্কুল। কিন্তু নৈতিক শিক্ষা! পড়ালেখায় ভাল হলেই কি একটা স্কুলকে সেরা বলে দেয়া যায়? একজন মানুষকে গড়ে তোলার পিছনে একজন শিক্ষকের যে ভূমিকা থাকা উচিত সেটা কি তাদের আছে? স্কুলের অধ্যক্ষ কিংবা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের কি সেই মানবিকতা বোধটুকু আছে? সেই শিক্ষাটা কি তারা নিজেদের মধ্যে ধারণ করেন? ভদ্রতা, শিষ্টাচার, মানবিকতা কি জিনিস সেটা কি তারা জানেন? শুধু ভিকারুননিসা কেন, অন্যান্য স্কুলগুলোও কি সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে? শিশু-কিশোরদের প্রতি তারা সকলেই কি মানবিক আচরণ করেন?

অরিত্রি অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনাকে 'খুবই হৃদয় বিদারক' বলে মন্তব্য করেছেন হাই কোর্ট। শিক্ষার্থীর সামনে বাবা-মাকে অপমানের ঘটনাকেও 'বাজে রকমের দৃষ্টান্ত’ বলে মনে করে হাই কোর্ট। অরিত্রি হত্যার প্রতিবাদ করতে অনেক অভিভাবক স্কুলের সামনে অবস্থান নিয়েছেন। তারা অরিত্রি হত্যার বিচার এবং অধ্যক্ষের অপসারণ চান। তাদের অভিযোগ, 'শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে সবসময়েই এ ধরণের বাজে আচরণ করে স্কুল কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির কাছে অভিযোগ করার পরও কোনো সমাধান পাননি তারা'। অতীতে সমাধান মেলেনি বলেই আজ অরিত্রিকে জীবন দিয়ে দেখিয়ে দিতে হলো, শিক্ষক পরিচয়ের আড়ালে ঐ স্কুলে কতোটা অমানবিক, কতোটা অসভ্য মানুষ কাজ করে। অন্যভাবে বলতে গেলে, অরিত্রিকে হত্যা করা হয়েছে বলেই আমরা জেগেছি! এমন ভাব করছি, যেন অরিত্রি ছাড়া বাংলাদেশের অন্য সকল শিক্ষার্থীরাই নিরাপদ ছিল এবং আছে!

হয়তো ভাবছেন, অরিত্রির 'আত্মহত্যা'কে আমি বারবার 'খুন' দাবি করছি কেন! বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, আপনার কি একবারের জন্যও মনে হচ্ছে না অরিত্রিকে আত্মহত্যার পথে জোর করে পাঠানো হয়েছে? একবারও কি মনে হয়নি অরিত্রিকে বাধ্য করা হয়েছে পরাজয় মেনে নিতে? যদি মনে হয়ে থাকে সেসব কথা, তাহলে এটাকে আত্মহত্যা বলবেন কিভাবে? এটাকে হত্যা মনে করেন না? এই হত্যায় স্কুল যতটা দায়ী, আমাদের অভিভাবকদেরও কি ততোটাই দায়ী মনে হয় না? যারা ভাল স্কুল, ভাল রেজাল্টের পিছনে দিন-রাত ছুটে বেড়ান। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে দায়ী মনে হয় না? যেখানে পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়ে বাচ্চাদের মেধার যাচাই করা হয়!

কখনো কি ভেবে দেখেছেন কেন এই স্কুলগুলো এতোটা বেপরোয়া হয়ে উঠছে? কখনো ভেবেছেন, কেন একজন অভিভাবককে স্কুল শিক্ষকের পায়ে ধরে কান্নাকাটি করতে হয়? অনেককেই বলতে শুনলাম, নকল করে ধরে পড়েছে। তাই তাকে ছাড়পত্র দেয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। বাহ! ছাড়পত্র কেন দিতে হবে? সে যদি সত্যিই অন্যায় করে থাকে তাহলে অকৃতকার্য দেখিয়েও তো শাস্তি দেয়া যেতো। সেজন্য তার অভিভাবককে অসম্মান করার অধিকার কে দিয়েছে শিক্ষককে? অভিভাবককে অসম্মান করার যৌক্তিকতাই বা কি? একটা কথা মনে রাখবেন, অপরাধের বোঝার দায়ে নয় বরং পিতা মাতার অসম্মান হতে দেখেই অরিত্রি মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছিল।

আমাদের ভাল স্কুল চাই, ভাল রেজাল্ট চাই, ভাল ডিগ্রি চাই। কারণ, এসব না পেলে বাচ্চারা ভবিষ্যতে ভাল সাবজেক্টে পড়তে পারবে না, ভাল চাকরি হবে না, ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হবে না। তাই বেছে বেছে নামীদামী স্কুল-কলেজের দরজায় লাইন দেই, ডোনেশনের নামে ঘুষ দেই। ভর্তি পরীক্ষায় টিকে যাবার জন্য, বার্ষিক পরীক্ষায় ঝুলিতে করে ভাল রেজাল্ট বয়ে আনার জন্য দিন রাত বাচ্চাদের বইয়ের পাতার ভিতর ডুবিয়ে রাখি। তাদের শৈশব, কৈশোরের আনন্দকে ভাল রেজাল্টের আশায় নষ্ট করে যাই নিজের অজান্তেই। আর ঐ যে ভাল স্কুলে ভর্তি করার মানসিকতা, এই মানসিকতার সুযোগ নিয়ে কথিত ভাল স্কুলগুলো দিনের পর দিন অমানবিক, অহংকারী, বর্বর হয়ে উঠছে। যার বলি হচ্ছে আমাদেরই অবুঝ সন্তানেরা।

আজ না হয় কাল অরিত্রির গল্প চাপা পড়ে যাবে নতুন কোন গল্পের আড়ালে। এক মাস পড়েই ভর্তি যুদ্ধে নামবেন আমাদের অভিভাবকেরা। তখন সবাই অবলীলায় ভুলে যাবে এই স্কুলের বর্বরতার কথা। তখনও সবার সামনে ঝুলে থাকবে ভাল স্কুলের তকমা। তখনো সবাই স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকবে ভারী একটা সার্টিফিকেটের। সেই মুহূর্তে এখনকার এই আন্দোলন, পরীক্ষা বর্জন কি কারো মনে থাকবে? কাজে লাগবে বর্তমান হৈচৈ, নিউজ, ফেসবুকের স্ট্যাটাস? লাগবে না। কারণ ঐ বর্বরগুলো জানে, ঘুরেফিরে ভাল রেজাল্ট আর ভাল স্কুলের মুলার কাছে বারবার পরাজিত হয়ে তাদের কাছেই ফিরে যাবো আমরা।

অবশেষে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সহ ভিকারুননিসার তিন শিক্ষিকার বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা দায়ের হয়েছে। এটা আইনি প্রক্রিয়া। কিন্তু এতে করে কি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে? বেঁচে যাবে আমাদের সকল শিক্ষার্থীরা? আমি অরিত্রি হত্যার বিচার চাই। পাশাপাশি বাংলাদেশের সকল শিক্ষার্থীর নিরাপদ এবং সুন্দর ছাত্রজীবনও চাই। যেখানে মধ্যযুগীয় শিক্ষা ব্যবস্থার বর্বরতা থাকবে না। থাকবে না ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ভাল রেজাল্টের পিছনে ছুটে যাওয়ার উন্মাদনা। বাচ্চারা পড়বে, পাশাপাশি উপভোগ করবে শৈশব কৈশোরের প্রতিটি মুহূর্তকে। তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শৈশব কৈশোরের সুন্দর সুন্দর গল্প দিয়ে ঝুড়ি ভরে রাখবে।

কি, পারবেন দিতে এমন স্মৃতিময় শিক্ষা জীবন?

দেবজ্যোতি দেবু, সংস্কৃতি কর্মি, অনলাইন এক্টিভিস্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ