প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ০৫ ডিসেম্বর, ২০১৮
ভালো ব্যবহার খুব সম্ভব মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ। যে মানুষ এই সম্পদ অর্জনের চেষ্টা করেন; তার হৃদয় সভ্যতার আলোয় উদ্ভাসিত হয়। তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে; ভালো ব্যবহারই সভ্যতা। এই যে আমরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধি অর্জন এতো সব কঠিন কঠিন বিষয় অর্জনের কথা বলি; এইসব কঠিন বিষয়ই অত্যন্ত সহজ হয়ে ওঠে; যখন আমরা ব্যক্তি-মানুষ ভালো আচরণে সক্ষম হয়ে উঠি।
পৃথিবীর কোন জাতিই জন্মগত ভাবে ভালো ব্যবহার শিখে পৃথিবীতে আসেনি। তারা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, শিক্ষা-সংস্কৃতি অর্জন এসব কঠিন কঠিন বিষয়ের পিছে দৌড়াতে গিয়ে অনেক বর্বর আচরণ করেছে। তারপর এইসব কর্কশ আচরণের ভ্রান্তিটি বুঝে যখন নিজেদের আচরণ শুদ্ধতায় মনোযোগী হয়েছে; ঠিক তখনই সভ্যতার আলো তাদের মাঝে সামষ্টিকভাবে প্রজ্বলিত হয়েছে।
কিন্তু এর জন্য প্রথম প্রয়োজন হয়েছে ভুল স্বীকার প্রবণতা। আমার আচরণ ভুল হয়েছে; এটি স্বীকার না করলে আমার আচরণ কখনোই ঠিক হবে না। তার মানে আমি যতই সম্পদ অর্জন করি, ক্ষমতা অর্জন করি, যত শিক্ষা-সনদই জোগাড় করি; যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের ব্যবহার ভালো করার অনুশীলন করছি না; আমি অসভ্যই রয়ে যাবো।
আমাদের কালে এই অসভ্যতাটা খুব স্বাভাবিক ছিলো। শিক্ষক বেত দিয়ে পেটাতে পেটাতে ঘেউ ঘেউ করবে; তবেই আমরা লেখাপড়া শিখে গাড়ি-ঘোড়া চড়তে পারবো এই দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো আমাদের মনে। এর মাঝ দিয়ে আমরা শিখেছি, ঘেউ ঘেউ করে মানুষ পেটাতে পারলে; আমরা গাড়ি-ঘোড়ার মালিক হতে পারবো। এরপর গাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী দু'জনে মিলে ঘেউ ঘেউ করাই আমাদের প্রতিদিনের সাফল্যের সূচক।
আমরা জানতাম, সরকারি দপ্তরে কোন কাজে গেলে কেরানি থেকে-কর্মকর্তা ধাপে ধাপে ঘেউ ঘেউ করবে। পুলিশ রাস্তাঘাটে গালাগাল দেবে; আর খালি গায়ে রিকশাচালকটিকে আমার চোখের সামনে লাঠি দিয়ে পেটাবে। এসবই স্বাভাবিক আমাদের জীবনে।
আমরা জানতাম, ডাক্তারের কাছে গেলে সে গম্ভীরভাবে আমাকে ধমক দেবে; যেন জ্বর হওয়াটা অপরাধ হয়েছে।
আমরা জানতাম, দেশটা পলিটিক্যাল ক্যাডারদের বাপের তালুক; চাঁদা হিসেবে দোকান থেকে তুলে নিয়ে আসা জিনসের প্যান্ট আর কেডস পরে সে পশ্চাদদেশ দুলিয়ে ঘুরবে; শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে অস্ত্র-কিরিচ ঘুরিয়ে হারেরেরে করে তেড়ে আসবে; আমরা ক্লাসরুমে ঢুকে সিটকিনি তুলে দিয়ে প্রাণ বাঁচাবো।
আর আমরা এটাও জানতাম; এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নামের কুরুক্ষেত্রে শিক্ষকের দুর্ব্যবহার, পলিটিক্যাল ক্যাডারদের ঔদ্ধত্য সহ্য করে ডিগ্রি নিয়ে বের হতে হবে; নইলে বাবা-মা'র ভালোবাসার কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়বো।
সভ্যতার আলো নেই এমন জনপদে বেড়ে ওঠার এই যে বেদনাগাথা; তা আমরা কোনমতে সহ্য করে নিয়েছি। জঙ্গলে টিকে থাকার যোগ্যতা পেশির লড়াই করে টিকে থাকা। এ যে বাঁচা মরার লড়াই। ফলে আমাদের সঙ্গেই কোমল মনের যে সভ্যতর কিশোর-তরুণেরা ছিলো; তারা এই জঙ্গলে টিকতে পারেনি; অনেকে অভিমানী হয়ে আত্মহত্যা করেছে; সামগ্রিক সমাজ- শিক্ষা-রাষ্ট্র ব্যবস্থা অনেককে জীবন্মৃত করে রেখেছে।
বিশ্বে সামাজিক আচরণের ভুল স্বীকার করে ভালো ব্যবহার অনুশীলনের মাঝ দিয়ে সভ্য হয়ে ওঠা দেশগুলোর সমাজ না দেখলে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না দেখলে, রাষ্ট্রব্যবস্থা না দেখলে; সভ্য মানুষদের সঙ্গে মেলামেশা না করলে; আমার বোঝা হতো না; আমাদের চেনাজানা জঙ্গল-জগতের বাইরেও একটি জগত আছে; যেখানে অপরিচিত মানুষ হাসি মুখে সুপ্রভাত বলে; নিজে এগিয়ে এসে কথা বলে। কোন প্রশ্ন করলে, স্মিত মুখে উত্তর দেয়।
এই গাম্ভীর্য বিহীন জগত আমার কাছে ছিলো অজানা। কারণ আমাদের সমাজে গম্ভীর না হয়ে থাকা মানে গুরুত্ব কমে যাওয়া; লোকটার ওয়েট নাই। ভারী নাহলে আবার যোগ্য হয় নাকি!
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে কালেই পৃথিবীটা ঘুরে এটা খুব ভালোভাবে বুঝে গিয়েছিলেন; আমরা অত্যন্ত আদিম অবস্থায় রয়ে গেছি চিন্তায় ও আচরণে। তাই তার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শান্তি নিকেতনের শিক্ষাদানে মৌল আদর্শই ছিলো, সভ্য আচরণ শেখানো।
কিন্তু আমাদের সমাজ তা বুঝতে চায়নি; শান্তিনিকেতনী আচরণকে মেয়েলি বলে বেশ পৌরুষ জাহির করতে করতে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোকে করে তুলেছি হিংস্র পশুর চিড়িয়াখানা। যেখান থেকে পর্যাপ্ত পাশবিক আচরণ শিখিয়ে শিক্ষকতা, ডাক্তারি, পুলিশ, প্রশাসন, রাজনীতি সহ পেশার বিভিন্ন ক্ষেত্রে পশু সরবরাহের নিশ্চয়তা থাকে শতভাগ।
ইন্টারনেট যুগ এসে যাওয়ায়, এ যুগের কিশোর-কিশোরীদের সভ্য সমাজে না গিয়েও তা সম্পর্কে জানার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এতে করে নিজের সমাজ-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-রাষ্ট্রের অসভ্য আচরণ দেখে বিস্মিত হচ্ছে তারা। "অপমান" নির্ভর সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থায় তাদের মাঝে অপ্রাপ্তির বেদনাবোধ তৈরি হচ্ছে। সভ্যতার প্রত্যাশায় তারা দ্রোহী হচ্ছে, অভিমানী হচ্ছে; আত্মহত্যার হার বাড়ছে।
এখন এলোমেলো-ইতস্তত দোষারোপ করে এই বাস্তবতা উপেক্ষা করা যাবে না; ধীর-স্থির মস্তিষ্কে এই সংকট সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। মনে রাখতে হবে, অপ্রস্তুত-অসভ্য সমাজের এই অল্পবয়েসী নতুন সদস্যদের একটিই দাবি; তা হচ্ছে সভ্যতার দাবি।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য