প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
এখলাসুর রহমান | ০৩ জানুয়ারী, ২০১৯
৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ টি আসন পেলো মহাজোট, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দল মিলে পেলো ৭টি আসন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৫২ জন প্রার্থী নির্বাচনের দিন অনিয়মের অভিযোগ এনে নির্বাচন হতে সরে দাঁড়িয়েছ। বিভিন্ন পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে অধিকাংশ কেন্দ্রেই বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের কোন এজেন্ট ছিলোনা। প্রিজাইডিং কর্মকর্তা, পুলিশ ও সরকার দলের নেতাকর্মীরা অন্যের ভোটের ব্যালটে সিল মেরেছে। ধানের শীষে ভোট দিলে কেন্দ্র হতে বের করে দিয়েছে। আর ভোট দিতে হয়েছে টেবিলের উপর সবার সামনে। এতে করে ধানের শীষের সমর্থকেরাও ভয়ে নৌকায় ভোট দিয়েছে। যারা মামলার আসামী হয়ে পালিয়ে থেকেছে তাদের ভোটও চলে গেছে নৌকার ব্যালটে। একজন ১০০, ২০০ করে ভোট দিয়েছে। নাবালক বাচ্চাকে নিয়ে ভোট দিতে গেছে মা। সেক্ষেত্রে বাচ্চাকে দিয়েও ভোট দেয়ানো হয়েছে। বাচ্চা বাড়ি গিয়ে অপর বাচ্চাকে গিয়ে বলছে, আমি ভোট দিয়ে এসেছি। অপর বাচ্চা তখন মায়ের কাছে বায়না ধরলো, মা আমিও ভোট দেব। বাচ্চার কান্না থামাতে মা তখন ভোট কেন্দ্রে গিয়ে সেই বাচ্চা দিয়েও ভোটের ব্যালটে সিল মারিয়ে এলো। মৃত ব্যক্তির ভোটও কাস্ট দেখানো হল।
মামলা, হামলা দিয়ে ভীতি সৃষ্টি করে বিশেষ মার্কায় ভোটারদের ভোট দিতে না দেয়ার রীতি কি গণতন্ত্র সম্মত? নির্বাচনে একপক্ষ সরকার দল হবে ও আরেক পক্ষ বিরোধী দল হবে এমনটাই কি ভোটারদের প্রত্যাশিত ছিলোনা? বিরোধী দল বিহীন গণতন্ত্রে কি সরকার দলের বেপরোয়া হয়ে ওঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়না? এবারের নির্বাচন মনে করিয়ে দিল বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস তত্ত্বটি। যে তত্ত্বে একসময় বাংলাদেশে গড়ে উঠেছিল পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি, বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি ও ভারতে নকশাল বাড়ির আন্দোলন। তখন তারা দেয়ালে দেয়ালে লিখে রাখতো বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস।
এ তত্ত্বের প্রবক্তা চীনের কমিউনিস্ট নেতা মাওসেতুঙ বলতেন, শত্রুর অস্ত্র জোর করে কেড়ে নাও। এই অস্ত্র দিয়েই শত্রুকে ঘায়েল করো। এবারের নির্বাচনে যেভাবে ভোটারের ভোট কেড়ে নেয়া হলো ও তার ভোট দিয়েই তার প্রতিপক্ষকে জেতানো হল সেটা নিশ্চয়ই মাওসেতুঙের সেই তত্ত্বেরই বাস্তবত৷ তাই নয় কি?
বিভিন্ন সংসদীয় এলাকায় ২০ দলের প্রার্থীকে ৩০ ডিসেম্বরের আগের দিন পর্যন্ত যেতেই দেয়া হয়নি। তার মার্কার পোস্টার লাগাতে দেয়া হয়নি। মাইকিং করতে দেয়া হয়নি। প্রার্থী আসবেন এমন খবর শুনেই দা রামদা নিয়ে এলাকায় মিছিল করে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছ। নির্বাচনের দিনও ভোটকেন্দ্রের আশেপাশে অথবা কোন বাসাবাড়ির দেয়ালে ধানের শীষ প্রার্থীর কোন পোস্টার দেখা যায়নি। ভোটকেন্দ্রে ছিলোনা তাদের কোন এজেন্ট। এক্ষেত্রে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণায় এজেন্টের ঘর ফাঁকা থাকার কি ব্যাখ্যা দেবে নির্বাচন কমিশন?একাদশ সংসদ নির্বাচনে অধিকাংশ ভোটকেন্দ্রেই ধানের শীষের প্রার্থীর কেউ এজেন্ট হতে সাহস পায়নি?প্রকাশ্যে ভোট দেয়ার অনৈতিক পদ্ধতিতে সরকার দলীয় নেতাকর্মী ও পুলিশের ভয়ে ধানের শীষের সমর্থকরাও ভোট দিয়েছে নৌকায়৷হামলা, মামলা ও গ্রেপ্তার হতে বাঁচতে দলে দলে বিএনপি নেতাকর্মীরা দলে দলে যোগ দিয়েছে সরকার দল আওয়ামী লীগে। তাদের প্রকাশ্যেই বলা হয়েছে, যদি মামলা হতে বাঁচতে চাও আওয়ামী লীগে যোগ দাও ও নৌকায় ভোট দাও।
উন্নয়নের গণতন্ত্রকে জেতানোর এই তত্ত্বের কি নাম দেবে রাজনীতির তাত্ত্বিক গণ? স্বাধীনতা উত্তর সময়ে সমাজতন্ত্রী দাবীদারদের একটি অংশ সমাজতন্ত্রের একটি নতুন তত্ত্ব দিয়েছি। যার নাম ছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের গণবাহিনীও সক্রিয় ছিল বন্দুক তত্ত্বে। সেদিনের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের একজন আসম আব্দুর রব এবার নির্বাচন করেছে মেজর জিয়ার ধানের শীষ মার্কা নিয়ে। আরেক জন হাসানুল হক ইনু নির্বাচন করেছেন নৌকা প্রতীক নিয়ে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের এই দুই নেতা সেদিনের ও আজকের দিনের তুলনায় কি বলবেন এবারে?
এবারের নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির এই বিজয়ের নাম দিয়েছে উন্নয়নের গণতন্ত্রের বিজয়। তবে কি এই উন্নয়নের গণতন্ত্র বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আদলেই সৃষ্ট হলো? বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীরাও বলপ্রয়োগের পথ বেছে নিয়েছিল। আতংক সৃষ্টি করে ও বলপ্রয়োগের ক্ষমতা দৃশ্যমান করে তারা তাদের দলকে ও রাজনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে চেষ্টিত হয়েছিল তারা। কিন্তু সেদিনের সেই জাসদ আজ খণ্ড বিখণ্ড। বলপ্রয়োগের সেই পন্থা তাদের দলকে প্রতিষ্ঠিত হতে দেয়নি। রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রাম নয় ক্ষমতা দখল করে ক্ষমতার প্রভাবে গঠিত হলো খন্দকার মোশতাক আহমেদের ডি এল, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিএনপি, লে. জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টি। আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এসব দলের উত্থান ঘটেনি। ডিএলের কোন অস্তিত্ব নেই। জাতীয় পার্টিও গণবিচ্ছিন্ন ও একটি রাজনীতির নামে কমেডিয়ান চরিত্র রোল প্লে করে চলেছে। বিগত দিনে তারা বিরোধী দল ও সরকার দল দুটোই থেকেছে। এবারও তাই হতে চলেছে। তারা নির্বাচন করেছে মহাজোটের প্রার্থী হিসাবে। মহাজোটের বৈঠকে বসেই তারা বিরোধী দল হবে কিনা সে সিদ্ধান্ত পোক্ত করবে!কিন্তু তারা আবার কেউ কেউ মন্ত্রীও হতে চাইবে! এরশাদ আসম আব্দুর রবকে বিরোধী দলীয় নেতা বানিয়েছিল৷ তখন আজকের জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের এই নেতাকে বলা হতো গৃহপালিত বিরোধী দল। আর যারা গৃহপালিত বিরোধী দল বানিয়েছিল তারা ২০১৪ সালে নিজেরাও হলো ক্ষমতাপালিত বিরোধী দল৷ক্ষমতাপালিত এই জন্য যে জাতীয় পার্টি জাসদ কে মন্ত্রিত্ব দেয়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে মন্ত্রিত্ব দিয়ে ও বিরোধী দলীয় নেতা দিয়ে সরকার দল ও বিরোধী দল দুটোই করেছে। রাজনীতির তাত্ত্বিক গণ জাতীয় পার্টির এই দ্বৈত অবস্থানকে কোন সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করবে বলে আশা করি।
এদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দল নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের ৭জন সাংসদ হিসাবে শপথ নেবেনা বলছে। কিন্তু এবার মানুষ উন্নয়নের নামে এরকম নির্বাচন চায়নি। তারা সরকার দলের পাশাপাশি একটা গণতান্ত্রিক কার্যকর বিরোধী দলও চেয়েছিল। বিরোধী দল বিহীন গণতন্ত্র কি যথাযথ গণতান্ত্রিক হতে পেরেছে কোথাও? বিরোধী দল বিহীন সরকার দল কি ক্ষমতার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেনা?
প্রকাশিত ফলাফলে ঐক্যফ্রন্ট মাত্র ৭টি যার মধ্যে বিএনপি ৫টি এবং গণফোরাম দু’টি আসন পেয়েছে। তারা শপথ নেবেনা বলছে। সুতরাং বিরোধী দলকেও সরকার দলকেই ঠিক করে দিতে হবে মহাজোট হতে। একাদশ সংসদ নির্বাচন যে দশমের মতো আবারও একটি নামকাওয়াস্তে ও অকার্যকর বিরোধী দল দেবে সেটা নিশ্চিত হলো। ৩০ ডিসেম্বরের আগে নির্বাচনী প্রতিযোগিতা বাদ দিয়ে হামলা, মামলা, হয়রানি ও ভয় দেখিয়ে যেভাবে বিএনপি হতে আওয়ামী লীগে যোগদান করানো হল সেটা কি গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত নয়? অধিকাংশ এলাকায় বিএনপি কর্মীদের ভয় দেখিয়ে বলা হয়েছে মামলা, হামলা হতে বাঁচতে আওয়ামী লীগে যোগ দাও। যোগও দিয়েছে দলে দলে। এক্ষেত্রে যেসব মামলার আসামী বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিল তারা কি মামলা হতে অব্যাহতি পাবে? যদি তা-ই হয়, এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকাকে কি বলা যাবে তখন?
জোর করে ভোট দেয়ানো, প্রিজাইডিং কর্মকর্তার সামনে টেবিলে ভোট দেয়া, মামলার আসামী করে প্রতিপক্ষকে কেন্দ্রে আসতে না দিয়ে তাদের ভোট দিয়ে দিয়েছে অন্যেরা। এবারের নির্বাচন নষ্ট করে দিয়েছে নির্বাচন ও ভোটের মূল্যবোধ। গ্রামের অশিক্ষিত মজুর শ্রেণীর লোকেরাও এবারের নির্বাচন নিয়ে হাসাহাসি করে। ফেনীর এক বিশিষ্ট প্রার্থী জিতেছেন শুধু তাই নয়, একটি কেন্দ্রে তিনি ঐ কেন্দ্রের সব কটি ভোটই পেয়েছেন। অপরাপর প্রার্থীরা ঐ কেন্দ্রে একটি ভোটও পাননি। খুলনা-১ এর প্রার্থীর ক্ষেত্রে খবর পাওয়া গেল, তিনি তাঁর এলাকার মোট ভোটের চাইতে কয়েক হাজার ভোট বেশী পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। বিবিসি বাংলার এক সাংবাদিক এক কেন্দ্রে গিয়ে দেখেন ভোট শুরু হওয়ার আগেই সেখানে সব ভোটই দেওয়া হয়ে গেছে। খুবই ভাগ্যবান ঐ কেন্দ্রের ভোটাররা। খাটুনি করে তাঁদেরকে আর বুথে ঢুকে ব্যালট পেপারে সিল ছাপ্পড় মারতে হলনা তাদের। নির্বাচন কেন্দ্রিক এমন আরও অনেক চমকপ্রদ খবর সংবাদ পত্রের পাতায় পাতায় ও লোকের মুখে মুখে। ভয়ভীতি, হুমকি, শক্তি প্রদর্শন ও একের ভোট অন্যের জবরদখলই এবারের নির্বাচনে খুবই প্রকাশ্যভাবে সকলের কাছে দৃশ্যমান হয়েছে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য