প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ০৮ জানুয়ারী, ২০১৯
প্রিয় শিক্ষামন্ত্রী,
শুভেচ্ছা নিন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেবার শুরুতেই শিক্ষাকে ঘিরে জনপ্রত্যাশা বিনিময়ের সুযোগ নিতে চাইলাম। তাই আপনাকে এই খোলা চিঠি লেখা। সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রথম মতবিনিময়ে আপনি শিক্ষার মান উন্নয়নে সক্রিয় থাকার কথা বলেছেন। এটি এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের সামনে। কারণ অর্থনৈতিক উন্নয়নকে টেকসই ও অর্থবহ করতে শিক্ষার মান উন্নয়নের আর কোন বিকল্প নেই।
আপনি জানেন, শিক্ষার মান উন্নয়ন করতে প্রয়োজন দক্ষ ও আত্মবিশ্বাসী শিক্ষক। বাংলাদেশে প্রশিক্ষিত প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকের সংখ্যা বেশ কম। এমনকি ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করলে ঠিক তেমনি একটি চিত্র আপনার চোখে পড়বে। একই অবস্থা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে।
তাই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে সবচেয়ে বেশী মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন বলে মনে হয়। কারণ এই ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের যুগে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগ ধরে রাখা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। কাজেই আনন্দের মাঝ দিয়ে শিক্ষাদানের পদ্ধতি জানা শিক্ষকদের জন্য অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্রেণিকক্ষেই ঐ দিনের আলোচিত বিষয়টি বুঝিয়ে শিক্ষার্থীকে ঐ বিষয়ে প্রস্তুত করে না দিলে বাসায় ফিরে শিক্ষার্থী আর ঐ বিষয়টি শিখবে বলে মনে হয়না। কোচিং সেন্টার বা বাড়তি প্রাইভেট পড়ার মান্ধাতার আমলের সংস্কৃতিটি বদলানোর সময় এসেছে।
শিক্ষকদের বেতন-ভাতায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটেছে; যারা এসব সুবিধা এখনো পাননি তাদের দ্রুত সরকারি বেতন কাঠামোতে নিয়ে আসা দরকার। কারণ ব্যক্তিগত জীবন-যাপনে স্বচ্ছন্দ না হলে একজন শিক্ষকের পক্ষে শতভাগ আনন্দের সঙ্গে আনন্দময় শিক্ষা দেয়া সম্ভব হয় না।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা ফিরিয়ে আনা। সীমিত সম্পদ ও প্রায়ই একইরকম সামাজিক বাতাবরণে ভারত বিশ্বের দশটি দেশের একটি যেখানে সমাজ শিক্ষককে তার প্রাপ্য মর্যাদা দেয়। এটি গুরুত্বপূর্ণ এজন্যই যে আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন শিক্ষক ছাড়া জাতির একটি আত্মমর্যাদার মেরুদণ্ড তৈরি হওয়া সম্ভব নয়।
শিক্ষক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সাহিত্য, ইতিহাসের শিক্ষা ও সমাজ-মানবিক বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের আত্মস্থ করানোর কৌশলগুলো শিক্ষকদের নবায়ন করানোর প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে হয়। শৃঙ্খলা নৈতিকতা-বিনয়-শিষ্টাচার-প্রতিটি মানুষকে মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা করা এই জীবন-দর্শন শিক্ষকরাই শেখাতে পারলে; আর বিভ্রান্ত মোটিভেশনাল স্পিকারদের ফাঁপা শিক্ষাগুলো শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করতে পারবে না।
বিজ্ঞানের বিষয়গুলো কেবল মুখস্থ না করিয়ে শ্রেণিকক্ষে প্র্যাকটিক্যালি করে দেখালে বিজ্ঞানশিক্ষা আনন্দময় হয়ে উঠতে বাধ্য। গণিত শিক্ষার ক্ষেত্রেও অংকের পেছনের যুক্তিটি ছাত্র-ছাত্রীদের বুঝিয়ে বললে গণিত যে খুব আনন্দের একটি বিষয় তা শিক্ষার্থীরা উপলব্ধি করতে পারে।
বাংলা, অংক আর ইংরেজি এই তিনটি বিষয়ে দক্ষতা যোগাযোগে দক্ষ যৌক্তিক চিন্তার নাগরিক উপহার দিতে পারে। তাই প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীর এই তিনটি বিষয়ে বিশেষ দক্ষতা প্রত্যাশিত।
আর পাঠ্যপুস্তকের এই শিক্ষার বাইরে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংগীত, চিত্রকলা, ক্রীড়া, সৃজনশীল বিজ্ঞান প্রকল্প ও বিতর্ক চর্চার সুযোগ সৃষ্টি করা জরুরী। কারণ পাঠ্যপুস্তকের বাইরের এই সাংস্কৃতিক-বিজ্ঞান ও বিতর্ক- চিন্তার বিকাশ, সম্পূর্ণ মানুষ বিনির্মাণের পূর্বশর্ত। পাঠ্যপুস্তক ও পাঠ্যপুস্তকের বাইরের এই সামগ্রিক শিক্ষা জাতির মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত জরুরী।
এখন প্রশ্নফাঁসের মতো যে বিষয়টি রীতিমতো আতংকের পরিবেশ তৈরি করেছে। এটি দূর করতে শ্রেণিকক্ষেই সপ্তাহে প্রতি বিষয়ে একটি করে কুইজ পরীক্ষা নিয়ে; এসএসসি, এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষাকে কেবল কম্প্রিহেনসিভ বা সৃজনশীল প্রশ্নের আঙ্গিকে সাজালে; ওপেন বুক বা খোলা বই পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিলেও মেধা মূল্যায়নে কোন অসুবিধা হবার কথা নয়। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন ফাঁসের ধারণাটিই অর্থহীন হয়ে পড়বে।
আর পিইসি-জে এস সি'র মতো পরীক্ষাগুলো শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষাকে বোঝা করে তোলে। কাজেই এই পরীক্ষাগুলো বিলুপ্ত করা জরুরী। কারণ শিক্ষা যতক্ষণ আনন্দময়; ততক্ষণই শিক্ষার্থীরা শিখতে পারে। বই-পুস্তকের বোঝা যথাসম্ভব কমিয়ে; ভালো ফলাফলের ইঁদুর দৌড় থেকে সরে গিয়ে শিক্ষাকে সম্পূর্ণ মানুষ তৈরির মাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন।
সাধারণ শিক্ষা ধারার পাশাপাশি চলমান ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও মাদ্রাসা গুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শিক্ষাকে আনন্দময় রাখার পরিবেশ নিশ্চিত করা দরকার। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে বাংলা ভাষা শিক্ষাটাকে আরও গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। কেননা মাতৃভাষায় দক্ষতা না থাকলে ইংরেজি ভাষায় সৃজনশীল দক্ষতা অর্জন সম্ভব নয়। মাদ্রাসাতেও বাংলা ভাষা শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে। মাতৃভাষায় দক্ষতা না থাকলে আরবি ভাষায় সৃজনশীল দক্ষতা অর্জন সম্ভব নয়। এটা উপলব্ধি করাটাই কল্যাণজনক।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষায় গবেষণার প্রতি মনোযোগ বাড়ানো কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার ভারত-পাকিস্তানের মতো দেশের তুলনায় গবেষণায় অনেক পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। অথচ বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীরাই পশ্চিমের বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে গবেষণা ও উদ্ভাবনে সুকৃতির স্বাক্ষর রাখছে। তাই গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সুযোগ সৃষ্টি সময়ের দাবী। এক্ষেত্রে বাজেট ও প্রণোদনা বাড়ালে তা যে আত্মনির্ভর উন্নয়ন কৌশল অর্জনের মাধ্যমে সে বিনিয়োগকে মুনাফাসহ ফিরিয়ে দেবে; এটা তো গবেষণামুখী দেশগুলোর কেসস্টাডিতে সুস্পষ্টভাবেই দেখা গেছে।
বাংলাদেশের শিক্ষার মান উন্নয়নে আপনার প্রতিদিনের প্রচেষ্টা অর্থবহ হয়ে উঠুক; বাংলাদেশের একবিংশের শিক্ষার্থীরা আনন্দময় শিক্ষা ধারার স্বাদ পাক; এই শুভ প্রত্যাশা রইলো।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য