আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

শিক্ষকতা পেশা দিন দিন ভারি হয়ে পড়ছে

ড. কাবেরী গায়েন  

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র প্রতীক আত্মহত্যা করেছেন। তাঁর বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শান্তা তৌহিদা। তিনি সরাসরি এজন্য তাঁর ভাইয়ের বিভাগের শিক্ষকদের দায়ী করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি সাতজন শিক্ষকের নাম উল্লেখ করেছেন তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে। জীবনের এই তুমুল ক্ষয়ে শোক জানানোর ভাষা নেই। একজন শিক্ষক হিসেবে অপরাধবোধ আর লজ্জায় মাথা নিচু করে থাকা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না।

হয়তো বিভাগীয় শিক্ষকদের অবহেলা এবং বৈরি আচরণের জন্যই প্রতীক আত্মহত্যা করেছেন। হয়তো এছাড়াও আরও প্রত্যক্ষ কারণ যুক্ত হয়েছে এই আত্মহননের জন্য। সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছি। জানলাম তিন সদস্যের এক কমিটি গঠিত হয়েছে। আলোর মুখ দেখুক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন। শিক্ষকদের অন্যায়, অনিয়ম বের হয়ে আসুক।

শিক্ষকতা পেশাটা দিন দিন ভারি হয়ে পড়ছে আমাদের জন্য, যাঁরা শিক্ষকতা ছাড়া আর কিছুই করতে শিখিনি। অথচ শিক্ষকতা পেশাটা তার আস্থার জায়গাটি হারিয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের, বিশ্বাসের জায়গাটা দ্রুতই লাপাত্তা হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে অপরাধী ভাবলেই যদি এই দায় চুকে যেতো, তাহলে সেই অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে নিতাম। কিন্তু, পরিস্থিতি অনেক দূর গড়িয়েছে। কলা ভবনের যে করিডোরে হাঁটবার জন্য বিদেশের ঝাঁ চকচকে বিশ্ববিদ্যালয় আঙ্গিনাকে আপন করতে পারিনি কোনদিন, ফিরে ফিরে এসেছি, সেই আঙ্গিনাকেও হঠাত-হঠাত অপরিচিত মনে হয় আজকাল। হয়তো আমরা পরস্পরের ভাষাটা আর বুঝে উঠতে পারছি না।

শিক্ষকরা খুব মানবিক ছিলেন, এমনটা আমি গল্পে-উপন্যাসেই পেয়েছি বেশি। নিজের জীবনে খুব বেশি পাইনি। আবার আমার শিক্ষক সময়ে, আমরা সবাই খুব কসাই প্রকৃতির এমনও নয় কিন্তু। অথচ আত্মহত্যা ঘটে চলেছে। হতে কি পারে, আমাদের সময়ে আমরা শিক্ষকদের যে কোন আচরণকে মেনে নিতেই শিখেছিলাম, যেমন মা-বাবার অত্যাচার-পীড়নকেও মেনে নিতাম? এখনকার ছেলেমেয়েরা না মানুক অপমান অবিচার কিন্তু তাঁদের সামনে তো এখন সারা বিশ্ব খুলে গেছে!

বোন তৌহিদাই জানিয়েছেন ভাই প্রস্তুতি নিয়েছিল বিদেশে পড়তে যাবার। তবে কেনো নিজেদের শেষ করে দেবার এই তাড়া? হতে কি পারে অন্তর্গত অন্য এক বিষাদও এই তরুণ প্রজন্মকে হননের দিকে ধাবিত করছে? তাদের জীবন কেনো কেবল ভালো রেজাল্টশেষে একটা ভালো চাকরির বৃত্তে আটকে গেল? স্বপ্নটা কি আরও একটু বড় হতে পারতো না?

বৃষ্টিতে পাতায় পাতায় কীভাবে বিন্দু বিন্দু ঝরে জল, চাঁদের আলোয় এই তুচ্ছ ধুলোভরা পথগুলোর পাশে লাল কোন ছোট ফুল বেগুনি হল কীভাবে তা দেখবার জন্য, কিংবা বন্ধুদের সাথে শশী ডাক্তারের কেনো আর তালবনে গিয়ে সূর্যাস্ত দেখা হয় না সে নিয়ে তুমুল তর্কে, কিংবা শম্ভুমিত্রের গলায় 'জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার' শুনে আদ্র হয় না আর তরুণ জীবন? ফের বাঁচতে ইচ্ছে করে না আরেকটি কবিতা পড়ার জন্য,একটা ভালো পেইন্টিং কিংবা বন্ধুদের করা অ্যামেচার নাটকটি দেখার জন্য কিংবা সহপাঠী মেয়েটি বা ছেলেটির চোখের মায়ায় আরেকটি বার বাধা পড়ার জন্য? কিংবা কিছু না করে একদিন শুধু রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর জন্য? বিসিএস-এ চাকরি পাওয়া কিংবা ভালো রেজাল্ট করে শিক্ষক হতে না পারলেই মরে যেতে হবে? এ কেমন জীবন তাহলে?

কোথায় যেনো গভীর অতল খাদ আমাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সেই খাদ তৈরিতে শিক্ষকদের দায় থাকতেই পারে। আমি বিশ্বাস করি, আছে। কিন্তু সেটুকুই সব নয় হয়তো।

আমাদের শিক্ষার্থীরা কেনো জীবনকে ভালোবাসতে পারছে না, কেনো কেবল রেজাল্ট আর সফল চাকরির বাইরেও যে এক জীবন আছে, সেই জীবনকে চিনতে পারছে না- আমি বিচলিত সেই বিন্দুতে। প্রতিযোগিতার গরলে মেধাবী-অমেধাবী তরুণ সব প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। অরিত্রীর পরে প্রতীক। আমি অসহায় হয়ে দেখছি। অভিযোগ মাথা পেতে নিচ্ছি। কিন্তু আরেকটা প্রাণ বাঁচানোর পথ তৈরি করতে পারছি না।

হাজার হাজার বছরের বিবর্তনের ধারায়, দৈবাৎ আমাদের জন্ম। কোটি কোটি জীবনের মিথষ্ক্রিয়া আর শ্রম-ঘাম-স্বপ্ন-সৃজনশীলতার ধারাবাহিকতায় আমরা এখানে। এই এক টুকরো বেঁচে থাকার বিস্ময়ই আমার কাটে না। অথচ এক ব্যর্থ শিক্ষক আমি, হয়তো একজনের জীবনেও এই বিস্ময় সঞ্চার করাতে পারিনি আজও।

প্রতীক এবং প্রতীকের মতো যে কোন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যাই তাই আমাকেও অপরাধী করে। জীবনের জয় ব্যাপ্ত করতে না পারার অক্ষমতা আমার শিক্ষক জীবনকে তুচ্ছ করে দেয়। আর আমার মানুষ জীবনকে করে তুচ্ছতর।

ড. কাবেরী গায়েন, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ