প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
আজম খান | ২২ জুন, ২০১৫
বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার চলমান ওয়ানডে সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচ মাঠে উপস্থিত থেকে দেখেছি। অর্জন করেছি অনেক অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতার খানিকটা বর্ণনা দিলে টের পাওয়া যাবে মানসিকভাবে কতখানি প্রস্তুত আমাদের দর্শকেরা। কীভাবে সাম্প্রদায়িক মনোভাব ধারণ করে আর এসব মানুষের পক্ষে সম্ভব অনেককিছুই; সম্ভব ভিনদেশি নাগরিককে হেনস্থা করা!
১/ স্টেডিয়ামে ঢুকার জন্য দীর্ঘ লাইন। দাঁড়িয়ে আছি সবান্ধব, কিন্তু লাইন এগুচ্ছে না। সমস্যা কি হচ্ছে বুঝার জন্য গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দায়িত্বে থাকা বিসিবির কার্ডধারী কর্মকর্তারা টাকা নিয়ে লোক ঢুকাচ্ছেন। ফলাফলে সিট হিসেব করে টিকেট বিক্রি করা হলেও অনেক দর্শক সিট না পেয়ে সিঁড়িতে বসে খেলা দেখেছেন। এক ভদ্রলোক তার স্ত্রী, আত্মীয়সহ খেলা দেখতে এসে নিজের সিটে অন্যকে বসা দেখতে পেয়ে সরিয়ে নিজেরা বসতে চাইলেন। ফলাফল- বসে থাকা যুবকেরা তাদের সাথে অশোভনীয় ব্যবহার করলেন। শুধু তারাই নয়। আশেপাশে বসে থাকা প্রায় সবাই তাদের একই ভাষা প্রয়োগ করলেন। দুই-একজন তাদের সমর্থনে কথা বললেও পেরে উঠা যায়নি। ভদ্রলোক বাধ্য হয়ে খেলা না দেখে বের হয়ে চলে গেলেন।
২/ মাঠ থেকে খেলা দেখে বের হওয়ার সময়ে যে অংশ দিয়ে মেয়েরা হেঁটে বের হয়, সে অংশে মানুষের ভীড় বেশী থাকে। স্টেডিয়ামে প্রবেশ করার লাইনেও একই প্রবণতা লক্ষ্যণিয়।
৩/ মাশরাফি রুবেলের হাতে বল তুলে দিয়েছে। সারা মাঠ জুড়ে চিৎকার “হ্যাপী’ হ্যাপী”। বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়কে টিজ করার ঘটনা অনেক শুনেছি, কিন্তু নিজ দলের খেলোয়াড়কে যে টিজ করতে হয় সেই দুর্লভ ইতিহাসের স্বাক্ষীও হতে হলো।
৪/ ভারতীয় দলের খেলোয়াড়দের মালু, মালাউন বলে যথেচ্ছাচার গালাগালি এবং এটা এতটাই নিয়মিতভাবে চারপাশ থেকে শুনতে পাবেন যে মানুষ হিসেবে আপনার নিজেকে সংখ্যালঘু মনে হবে।
৫/ রোজার দিন বিধায় অধিকাংশই রোজাদার। হাজার-হাজার বোতল হাতে মানুষ ইফতারির পরপর। বাংলাদেশের সিরিজ জয় প্রায় নিশ্চিত। এ সময়ে উল্লাসে হাজার-হাজার বোতল বাতাসে ভাসতে লাগলো। এরমধ্যে কয়েকটা গিয়ে পড়লো বাউন্ডারী লাইনের সামনে। ভাগ্য ভালো, সেদিকে কোন ফিল্ডার ছিল না। আপনি কাকে থামাবেন? কয়জনকে থামাবেন?
৬/ রোহিত শর্মা বাঊণ্ডারির কাছাকাছি ফিল্ডিং করছেন। এরমধ্যে সে জায়গায় লোহার বেড়া ওপাশে জমে গেলো শ’য়ে-শ’য়ে মানুষ। শুরু হলো অশ্রাব্য সব খিস্তি আর গালাগালি। গালাগালিগুলো ভাষাগত দিক থেকে হিন্দির সাথে আমাদের অনেক মিল। সহ্য করতে না পেরে রোহিত বেচারা এক সময়ে দর্শকদের দিকে ছুটে গেলো। গোটা বিশেক পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করলো।
৭/ স্টেডিয়ামে হাজার-হাজার মানুষ বসে থাকা প্লাস্টিকের চেয়ার পেটাচ্ছে, যে যেভাবে পারছে। কেউ হাত দিয়ে, কেউ বোতল দিয়ে, কেঊ পা দিয়ে। কয়জনকে থামানো যায়, কতজনকে যায়? আরাম করে স্টেডিয়াম জুড়ে সারা ম্যাচ চলাকালীন সময়ে চললো চেয়ার নষ্ট করার উৎসব।
ভারতীয় নাগরিক সুধীরের সাথে কিছু মানুষের অশ্রাব্য ব্যবহারের অভিযোগ এসেছে বিশ্ব মিডিয়ায়। উঠে এসেছে গায়ে হাত তুলার অভিযোগও। খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করছি আমাদের সংবাদপত্রগুলো বলছে অল্প কিছু মানুষের কারণে এই ঘটনাটি ঘটেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, তারা স্টেডিয়ামের ভেতরে উপস্থিত ৮০ ভাগ মানুষের মনোভাব খেয়াল করেছিলেন? দেখেছিলেন তারা কি করছিলেন? কোন ভাষায় কথা বলছিলেন? খুব সম্ভবত একটি নেগেটিভ জিনিসকে খানিকটা হালকা করে দেখালে অনেকের গায়েই তা লাগবে না, নিউজটির বেশী কাটতি হবে, এটাই উদ্দেশ্য।
অধিকাংশ আচরণই ছিলো সাম্প্রদায়িক এবং বর্ণবাদী। সুধীরের উপরে হামলার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু কিছু বাংলাদেশী সমর্থক নামের মানুষ যে তাকে স্টেডিয়ামের বাইরে ঘিরে ধরেছিলেন এবং অনেক আজেবাজে কথা বলেছেন তা কিন্তু সত্যি। বিডিনিউজের সাংবাদিক অভির কথাবার্তাতেই তা প্রমাণিত। মারধোরের ঘটনাটিও ঘটতে পারে, কারণ সুধীর একটি দোকানে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন সে ছবি কিন্তু আমরা ফেসবুকে দেখতে পেয়েছি।
ঘটনা যাই হোক না কেন, ব্যাপারটা পুরো জাতির জন্য লজ্জাজনক এবং গত দুইদিনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি স্টেডিয়ামে উপস্থিত ৮০ ভাগ মানুষই অত্যন্ত সাম্প্রদায়িক, বর্ণবাদী এবং ভয়াবহ মাত্রায় উচ্ছৃঙ্খল। এরা খেলা দেখে শুধু আনন্দের জন্য; দেশের প্রতি মায়া, মমতা কিংবা ভালোবাসা নিয়ে নয়।
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে বিগত কয়েক দশকে কি অসীম প্রকারে সাম্প্রদায়িকতা বেড়েছে, দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ, মমত্ববোধ কমেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দুইদিন পরপর সাম্প্রদায়িক হামলা, দুর্নীতির পরিধি বলে দেয় কোথায় যাচ্ছি আমরা। যেটুকু ভালোবাসা আমাদের মধ্যে দেখা যায় তার আবার অধিকাংশই লোকদেখানো। স্টেডিয়ামে উপস্থিত মানুষগুলো আকাশ থেকে লাফিয়ে পড়েনি। তারা এই দেশের মানুষ, এই দেশের সমাজের একেবারে উপস্থিত প্রতিবিম্ব।
যারা এদেরকে কিছু মানুষ, স্বল্প মানুষ উপাধি দিয়ে সমস্যাকে পাশ কাটানোর মধ্য দিয়ে নিজেদের হিট অক্ষুন্ন রাখতে চান তারাও কি সত্যিকার অর্থে দেশকে ভালোবাসেন? নাকি স্টেডিয়ামে উপস্থিত সেইসব দর্শকেরা এবং সেই সমস্ত সাংবাদিক, সংবাদপত্রগুলো একই গোয়ালের গরু?
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য