আজ বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

অদ্ভুত মুড়ির টিনের পিঠে চলছে শাবিপ্রবির পরিবহন দপ্তর

আজমিনা আফরিন তোড়া  

বাস চলছে। যাত্রী মোটামুটি প্রয়োজনের চাইতে বেশি, মানে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি। সুস্থ্ স্বাভাবিক গতিতে গাড়ি চলতে চলতে হঠাৎ কি হল, দেখি সব যাত্রী হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল নিজ নিজ জায়গা থেকে। সামনে তাকিয়ে সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম অন্য কোন যানবাহনের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়নি। তবে? বাস এমন ঝাঁকি দিয়ে থেমে গেল যে? বাস ড্রাইভার দ্রুত নেমে গেল বাস থেকে। সমস্যা কি? সমস্যা হল বাসের ইঞ্জিনের কোন একটা তারে শর্ট সার্কিট হয়ে তার কেটে গেছে।

ড্রাইভার সমস্যর সাময়িক সমাধানের জন্য মুঠোফোনে যোগযোগ করতেই ৫ মিনিটের মধ্যে কোত্থেকে হাজির হয়ে গেল আরো দুজন বাস ড্রাইভার। তিনজনে মিলে কি সব তার ধরে টানাটানি করেও কোন সুরাহা করতে না পারায় নষ্ট হওয়া বাসের ড্রাইভার ঘোষণা দিল বাস আর সামনে যাবে না। অতঃপর মধ্য শহরে বিশালাকার এক বাস অন্যান্য যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটিয়ে বেক্ষাপ্পাভাবে  রাস্তার মাঝ বরাবর পড়ে রইল। দৃশ্যটা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীবাহী বাসের।

এমন দৃশ্য সিলেট শহরের বিভিন্ন প্রান্তে প্রায়ই দেখা যায়!দীর্ঘ বছর ধরে ফিটনেস বিহীন বাস দিয়ে চালানো হচ্ছে ছাত্রছাত্রী আনা নেওয়ার কাজ।বিশ্ববিদ্যালয় প্রসাশন থেকে শুরু করে পরিবহন দপ্তর কারোরই সু নজর নেই এ ব্যাপারে।
 
এবার বলি আর এক অভিজ্ঞতার কথা! বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একদিন হাঁটছি হঠাৎ দেখি শ’খানেক ছাত্রছাত্রীর বিশাল এক জটলা। ভাবলাম কোন দূর্ঘটনা ঘটল কি না! সেই জটলা দেখি গুটি গুটি পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। ঘটনা বোঝার জন্য অপেক্ষা করতেই বোঝা গেল এই ‘জটলা’ অপেক্ষা করছে বাড়ি ফেরার লাস্ট বাসের জন্য। সেই বাসের যেই নির্দিষ্ট স্থান থেকে যাত্রী তোলার কথা ‘জটলা’ সেই জায়গা ছেড়ে বিপরীত দিক থেকে আসা বাসের দিকে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। ‘জটলার’ উদ্দেশ্য কিছুদূর সামনে এগিয়ে গিয়ে অন্যদের আগে বাসে চেপে কোন মত অন্তত দাঁড়ানোর একটা জায়গার বন্দবস্ত করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ১০ হাজার ছাত্রীর বিপরীতে বাস চলে মাত্র সাত থেকে আটটা। এই বাস সংখ্যা আবার প্রয়োজনভেদে বাড়ানো বা কমানো হয়। ছাত্র ছাত্রী বেশি থাকলে আটটা বাস। আর বিশ্ববিদ্যালয় লম্বা ছুটির আগে ও পরে প্রয়োজন অনুসারে বাসের এই সংখ্যা আরো কমানো হয়। তার উপর আবার প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন বাস নষ্টের অযুহাতে বিভিন্ন রুটে যাত্রী সেবা দেয়া বন্ধ রাখে। দেখা যায় শহরের মাঝখান দিয়ে ফাঁকা বাস যাচ্ছে, কিন্তু শিক্ষার্থী উঠতে চাইলে ড্রাইভার বলে বাস নাকি নষ্ট, ডিপোতে নিয়ে ঠিক করাতে হবে। একটা ছোট্ট বিষয় আমার মাথায় ঢোকে না, চলতি ফিরতি বাসে বসে তারা কী করে নষ্টের দোহাই দেয়! প্রতি বাসে সিট সংখ্যা ৫২ হলে আটটা বাসে সিট হয় মোট ৪০০ টার মত। তাও কতক বাসের সিট ভাংগা পড়ে আছে, ঠিক করার বালাই নেই! আদতেই মুড়ির কৌটার বিভিন্ন ধাতব অংশ দিয়ে প্রতিদিনই কারো কাপড়ে টান পরে নয়ত বেখেয়ালে হাত পা কাটে! এদিকে প্রতিদিন ৪০০ সিটের জন্য প্রতিযোগিতা করে প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী। এই প্রতিযোগিতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি যুদ্ধের থেকে কম কিছু না! প্রতিদিন বাসে সিট না পেয়ে মাসের শেষে ফাঁকা পকেটের কত ছেলেই তো ধার করা টাকা দিয়ে সিএনজি ভাড়া মেটাচ্ছে। সাথে একটা বিশাল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে বাসের দরজায় ঝুলতে ঝুলতে পাড়ি জমায় গন্তব্যে। এই ঝুলন্ত দশা থেকে যে ছোট খাটো দুর্ঘটনা ঘটেনি, এমন না! সম্ভবত প্রসাশন বড় কোন দুর্ঘটনার জন্য অপেক্ষায় আছেন যে বড় কোন ঘটনা ঘটলে তারপর না হয় বাস সংখ্যা বাড়ানো যাবে!

এমন বাসের দরজায় ঝুলন্ত বাদুড় দশায় শিক্ষার্থীদের ঝুলতে দেখলে মনে পড়ে ভিসি হাবিবুর রহমান স্যারের সময়ের এক ঘটনার কথা। সেই সময় ছাত্র ছাত্রীদের বাস ছিল মোটে ৪ কি ৫ টা। এখনকার মতই গাদাগাদি অবস্থা ছিল। শাবিপ্রবির ছাত্ররা সর্বকালে ঝুলতে ঝুলতে বাসে চড়ে তার প্রমাণ শাবির পাক্তন ছাত্র নাহিদুর রহিম চৌধুরী ভাই। তিনি ক্লাস শেষে বাসের দরজায় ঝুলতে ঝুলতে ফিরছিলেন। ধাক্কায় পড়ে গেলেন বাস থেকে এবং ড্রাইভার তা টের পাওয়ার আগেই নিচে পড়ে যাওয়া ছাত্রের গায়ের ওপর চালিয়ে দিলেন বাস। চালকের বোঝার কোন উপায় ছিল না যে একজন ছাত্র নিচে পড়ে গেছে কারণ বাসের গেট আর চালকের মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় না হলেও ১৫/২০ জন ছাত্র দাঁড়িয়ে যাতায়াত করে। ওই ঘটনায় ছাত্রের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। মৃত্যুর খুব কাছাকাছি চলে যাওয়া ছাত্রটি তৎকালীন ভিসির দ্রুত সিদ্ধান্তে হেলিকপ্টার এসে ঢাকায় এবং সম্ভবত পরে দেশের বাইরে চিকিৎসা নেয়ায় তাজা প্রাণটা বেঁচে যায়। ওই ঘটনায় ছাত্রদের রোষের মুখে তৎক্ষণাৎ ভিসিকে ছাত্রদের কাছে প্রতিজ্ঞা করতে হয় নতুন দুটো বাস প্রদানের। সেই বাস চলেও আসে সপ্তাহ দুয়েকের মাঝে। ইদানিং শাবিতে নতুন বাস চলতে দেখা যায়। ঝা চকচকে বাসগুলো শা শা করে চলাচল করে, তবে তা ছাত্রছাত্রীদের পাশ কাটিয়ে। কারণ বাসগুল শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। মাস চারেক আগেও শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অভিন্ন ভাসে যাতায়াত করত। কিন্তু ইদানিং এই তিন শ্রেণীর জন্য আলাদা আলাদা বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

শাবিপ্রবির শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের সংখ্যাটা সব মিলিয়ে ১২৬০ জনের মত। এই ১২৬০ জনের জন্য শাবিতে চলাচল করে মোট সাতটা বাস।২০১৭ সালেও এই বাসের সংখ্যা টা ছিল ৩। কিন্তু গত বছরেই নতুন চারটি বাস দেয়া হয় যার মধ্যে দুটি সাধারণ এবং দুটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। ১২৬০ জনের জন্য সাতটা বাস, ফলস্বরূপ প্রায়ই ওই বিশেষ শ্রেণীর বাসে দশ, পাঁচ এমন কি কখনো শুধু একজন নিয়েও চলাচল করতে দেখা যায়। শাবির নতুন ভিসি স্যার কিছু দিন আগে ছাত্রদের জন্য দুটো বাস দিয়েছিলে । বাস দুটি বিআরটিসির ভাড়া করা বাস নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বাস ছিল। কিন্তু বাস দুটো দশ দিনের মত ছাত্রদের সার্ভিস দেয়ার পর কি করে যেন তা উপর মহলের বাস হয়ে গেল। সর্বশেষ শাবির পরিবহন ব্যবস্থায় নতুন সংযোগ ছিল শিক্ষকদের নতুন দুইটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস। অথচ শক্ষার্থী বাসের সংখ্যা অপরিবর্তীত!

বিশ্ববিদ্যালয়ে বিআরটিস থেকে ধার করে যে বাসগুলো শিক্ষার্থীদের সেবা দিয়ে থাকে, তাদের প্রতিবাসের প্রতি ট্রিপের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষের গুণতে হয় প্রায় ১৪০০ টাকার মত। প্রতিদিন কেবল শিক্ষার্থীদের বাস সেবা দেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে গুণতে হয় এক লক্ষাধিক টাকা। যেই অর্থ বাঁচিয়ে কয়েক মাসেই কিনে ফেলা সম্ভব নতুন বাস। কিছু ছাত্র সংগঠন থেকে এই কথা দফায় দফায় বলা হলেও প্রশাসন থেকে করা হয়নি কোন সুরাহা। কেবল শান্তনা দেয়া হয়েছে এই বলে যে নতুন বাস কেনার জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। দু বছর আগে করা সেই কমিটি দু বছরেও একটা বাস কিনতে পারল না যা ছাত্রদের মধ্যে তুমুল হতাশা তৈরি করেছে। শুধু বাস সংখ্যাই না, বাসের রূট সংখ্যা বাড়ানোও বহুদিনের দাবি। শত শত শিক্ষার্থী শাহপরাণ রুটে চলাচল করে, অথচ সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের প্রতিদিন আসতে হয় নিজ খরচে।কোথায় রুট সংখ্যা বাড়াবে, তা নয়। গত পাঁচ বছরে তা আরো কমেছে। উল্লেক্ষ্য পাঁচ বছর আগেও একটি বাস শেখঘাট রুটে চলাচল করত যা উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে!

বিশ্ববিদ্যালয় চলে আমলাতান্ত্রিক উপায়ে। সেই জটিলতায় নতুন বাস আসতে দেরী হতেই পারে। সেক্ষেত্রে সাময়িক সমাধান হতে পারে শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারীদের বাসের ফাঁকা আসনে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের অনুমতি দেয়া। শিক্ষক ছাত্র এক আসে যাতায়াত করলে শিক্ষকের অমর্যাদা হয় না, বরং সম্পর্ক মধুর হয়। এই বাস্তবতাই আমাদের মুক্তি দিতে পারে সম্ভাব্য দুর্ঘটনার হাত থেকে।আমরা মুক্ত হতে পারি সম্ভাব্য দুর্ঘটনরা দুশ্চিন্তা থেকে।শাবির হাজার হাজার শিক্ষার্থী অপেক্ষায় আছে প্রসাশনের শুভ বুদ্ধি উদয়ের...

আজমিনা আফরিন তোড়া, সাবেক শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ