আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

চর্বির কারবারে হারিয়ে যাওয়া সুখ

মাসকাওয়াথ আহসান  

মানুষের জীবন যেহেতু একটাই; তাই সতত সুখের অনুসন্ধান মানুষের জীবনের প্রধান লক্ষ্য। এই সুখের জন্য খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার সামান্য নিশ্চয়তার বাইরে মানসিক শান্তি ও স্থিতাবস্থা অর্জন দরকার হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষেরা নির্জনতায় বসবাস করে; আজো।

গভীর বোধ ও জীবন দর্শন সম্পন্ন মানুষেরা মরুভূমি-পাহাড়-অরণ্য-সমুদ্র সংলগ্ন জায়গায় বসবাস করে। কারণ কথিত আধুনিক জীবনের সংজ্ঞা মিডিয়া ও বিজ্ঞাপন হয়ে তাদের কাছে প্রায় পৌঁছাতেই পারে না। কিন্তু সমতল এলাকাগুলো খুব সহজেই মিডিয়া ও বিজ্ঞাপনের খপ্পরে পড়ে যায়। এতে করে জীবনের সুখের যে সংজ্ঞা তা ব্যক্তি-মানুষ নির্ধারণ করার পরিবর্তে মিডিয়া ও বিজ্ঞাপন নির্ধারণ করে দেয়। অমনি সাফল্য ও আধুনিক জীবন যাপনের ভুল কলাকৌশল মাথায় নিয়ে মানুষ নেমে পড়ে ইঁদুর দৌড়ে। অনেক দৌড়ে ক্লান্ত ইঁদুর মিডিয়ার বিজ্ঞাপনের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ফাস্ট ফুড খেয়ে বেশ ধেড়ে ইঁদুর হয়ে জিমে দৌড়াদৌড়ি করে।

মরুভূমির নির্জনতার মাঝে কিংবা পাহাড়ের ঔদার্য মনে মেখে; অল্প খেয়ে অল্প পরে তুষ্ট মানুষ যখন ধরিত্রীর বিশালতার বিস্ময় উপভোগ করে; ঠিক তখন সমতলের পুরবাসী ট্রাফিক জ্যামে বসে "মেদ-ভুঁড়ি কী করি" নিয়ে চিন্তা করে; কিংবা কর্পোরেট চাঁদোয়ার নীচে বসে উচ্চাঙ্গ সংগীত শোনার ফাঁকে ফাঁকে পাশে বসা ভাবির কাছ থেকে ধন্বন্তরি ডায়েট প্ল্যান শোনে। সমতলের নগর জীবন দুটি ইজমে বিভক্ত; দারিদ্র্যে বিশীর্ণ মানুষের মোটা হবার চেষ্টা আর ধন-সম্পদে ধস্ত মোটা মানুষের পাতলা হবার চেষ্টা। এই লড়াইটির নানা একাডেমিক নাম আছে; কেউ কেউ একে শ্রেণী সংগ্রাম বলে। অল্প-আয়ের ক্ষীণ স্বাস্থ্য মানুষকে আদর করে প্রোলেতারিয়েত বলে। আর বিশাল আয়ের বিশাল গাড়ি-বাড়ি-ভুঁড়ির মালিককে আদর করে বুর্জোয়া বলা হয়।

চিকন মানুষ অন্য চিকন মানুষদের ঠকিয়ে মোটা হবার অসাধু প্রক্রিয়াকে দুর্নীতি বলা হয়। এই দুর্নীতি না করলে চিকন মানুষের মোটা মানুষ হবার জন্য শ্রেণী সংগ্রাম করার বা মোটা মানুষ জিম-সংগ্রাম করে পাতলা হবার চেষ্টা করতে হতো না। নিজের বাড়তি খাবার মানুষ যার খাবারের অভাব তাকে দিয়ে দিলেই এতো ইজম-ফিজমের প্রয়োজন হতো না। নিজের কিছু সম্পদ সম্পদহীনদের মাঝে নিয়মিত বণ্টনের ব্যাপারটাকে আবার ফিল্যানথ্রপি বলে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সম্পদের অধিকারী বিল গেটস যেটা করেন। নাতি-পুতি পর্যন্ত বসে খেয়ে মোটা হোক এই আশায় বসে না থেকে; গেটস সম্পদ বিতরণ করেন আফ্রিকার ক্ষীণ-স্বাস্থ্যের মানুষের মাঝে।

প্রত্যেক মানুষ স্বেচ্ছায় অন্য মানুষের ক্যালরি জোগানের চেষ্টা না করায়; নানা রকম ইজমের ব্যবসা বিস্তৃত হয়। কিছু লোক ধর্মীয় অনুভূতি সামনে এনে চিকন মানুষকে মোটা করার স্বপ্নের কথা বলতে বলতে চিকন মানুষের চাঁদার টাকায় মোটা হয়ে যায়। কিছু লোক শ্রেণী অনুভূতি সামনে এনে চিকন মানুষকে মোটা করার স্বপ্নের কথা বলতে বলতে বলতে তাদের চাঁদায় মোটা-তাজা হয়ে যায়। আর আছে রাষ্ট্র; সে চিকন মানুষকে মোটা করার স্বপ্নের কথা বলতে বলতে ব্যবসায়ী রাজনীতিক-আমলা-পুলিশ-সেনাবাহিনীকে মোটা তাজা করে।

এইখানে রাজনীতিকরা জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতি সামনে এনে ঐ যে চিকন মানুষকে মোটা করে দেবো ঐ ইশতেহার ও অঙ্গীকার করতে করতে চিকন মানুষের সম্পদ লুণ্ঠন করে নিজেরা মোটাতাজা হয়। এই ফাঁকি দেবার গালগল্পের পাশাপাশি মিডিয়া- ব্যবসায়ী-প্রশাসক-পুলিশ-সেনাবাহিনীকে চর্বির ভাগ দিতে হয় নিরন্তর ধাপ্পাবাজি টিকিয়ে রাখতে। মাঝে মাঝে ধর্মীয় অনুভূতির তালেবর ও শ্রেণী সংগ্রাম অনুভূতির তালেবরেরাও চর্বি চাঁদা চায় জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের তালেবর রাজনীতিকদের কাছে। এদেরকেও মোটা অংকের চর্বির ভাগ দিয়ে শান্ত রাখতে হয়। এই পুরো ব্যবস্থাটাই আসলে চর্বির কারবার। এটা করতে গিয়ে চিকন-মোটা সামষ্টিক সব মানুষের জীবনের সুখ-শান্তি হারিয়ে যায়।

অথচ অসাধু উপায়ে চর্বি জমানোর পর চর্বিবাজ লোকগুলো জিম করে-ডায়েট করে; কথিত আধ্যাত্মিক গুরুদের কাছে গিয়ে চর্বি চুরির অপরাধের কনফেস করে ভেউ ভেউ করে কাঁদে, আমাকে সুখ এনে দিন।

এ কারণে সমতলের চর্বি চুরির ইঁদুর দৌড়ে ধেড়ে ইঁদুর হবার বৃথা জীবন ফেলে অগ্রসর চিন্তার মানুষ জীবনের শুরু থেকেই অল্পে তুষ্ট জীবন যাপন করেন। সেটাকেই অধুনা পশ্চিমা বিশ্বে মিনিমালিজম বা মিনিমালিস্টিক লাইফ স্টাইল বলে।

আবার বিজ্ঞাপনের ইলিউশানে ভুল লাইফ স্টাইল বা জীবন চর্যায় ক্লান্ত মানুষ তাই ছুটি পেলে সমুদ্র বা পাহাড়ের কাছে নির্জনতা ও ঔদার্য শিখতে যায়। এই চর্বি-অলা পর্যটকদের কোলাহলে সমুদ্র-পাহাড়েরও প্রাণ ওষ্ঠাগত প্রায়।

এরকম হন্তদন্ত হয়ে সুখ খুঁজে বেড়ানোর চেয়ে জনারণ্যে একা বসে আত্ম-অনুসন্ধান করলেই উপলব্ধি করা যায়; নিজের বাড়তি সম্পদ ও চর্বি আশেপাশের সম্পদহীন ও পাতলা মানুষের মাঝে বিতরণ করে; তাদেরকে খানিকটা সুখি করা গেলেই সে সুখের আলো ঠিকরে হৃদয়ের অন্তপুরে প্রবেশ করে। সমাজ সামষ্টিকভাবে সুখি না হলে শত চেষ্টা করেও ব্যক্তিগত সুখ অর্জন সম্ভব নয়। সে জন্যই একটি আলোদায়ী বাক্য প্রচলিত রয়েছে, যদি শুধু নাও, কেবল তোমার হাত পূর্ণ হবে; আর যদি দাও, তোমার হৃদয় পূর্ণ হবে।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ